logo

আবে বুঝেছিলেন স্বজাতির মনের ক্ষত

  • August 16th, 2022
News

আবে বুঝেছিলেন স্বজাতির মনের ক্ষত

সুমন চট্টোপাধ্যায়

শিনজো আবের পরিবার চেয়েছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে, নিভৃতে কেবলমাত্র প্রিয়জনের উপস্থিতে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে। কিন্তু জাপানিরা তা হতে দিলেন না। গতকাল মঙ্গলবার আবের শেষ যাত্রায় কাতারে কাতারে মানুষ নেমে এলেন রাস্তায়, তাঁদের অনেকের হাতে সাদা ফুলের তোড়া। অন্তিম যাত্রায় আরও একবার প্রমাণিত হল, শিনজো আবের অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা, স্মরণকালে জাপানের কোনও প্রধানমন্ত্রী যার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেননি।

স্ট্রংম্যান পলিটিশিয়ানদের জীবন ও ক্রিয়াকলাপ যেমন কিছুটা হলেও রহস্যাবৃত থাকে আবের তা ছিল না। ফলে তাঁর মূল্যায়ন করা তুলনামূলক ভাবে সহজ, আরও বিশেষ করে এই কারণে যে শিনজো আবে তাঁর স্বপ্ন, অভীষ্ট বা কর্মপন্থা নিয়ে নিজেই অসংখ্য লেখালেখি করেছেন, ভাষণ দিয়েছেন, মুখের কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন ছাপার অক্ষরে। নানজিং হত্যাকাণ্ড নিয়ে আবের সংসদীয় কমিটি যে রিপোর্টটি তৈরি করেছিল, দীর্ঘদিন তা সংসদের মহাফেজখানায় পাওয়া যেত, তারপর হঠাৎ একদিন তা অদৃশ্য হয়ে যায়। সম্রাট হিরোহিতো যতদিন জীবিত ছিলেন, জাপানের কোনও রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সামরিক বাহিনীর ক্রিয়াকলাপ নিয়ে মুখ খুলত না, বিষয়টি ছিল এতটাই সংবেদনশীল। কিন্তু হিরোহিতোর মৃত্যুর পরে নতুন করে আগ্নেয়গিরির মুখ খুলে যায়, বিষয়টি আর স্পর্শকাতর থাকে না, জাপানি রাজনীতিবিদরা প্রকাশ্যেই এই বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন। তখনই প্রথম লোকচক্ষুর গোচরে আসে আর একটি অতি লজ্জার প্রসঙ্গ। ‘কমফর্ট ওমেন’। শিনজো আবের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শুরু এমন একটা পরিবেশের মধ্যেই।

পোশাকি নাম ‘কমফর্ট ওমেন’, সোজা সাপটা বলতে গেলে যৌন-দাসী, জাপানি ভাষায় যাদের বলা হয় ‘ইয়ানফু’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবব্যহিত আগে থেকে জাপানের আত্মসমর্পণ পর্যন্ত যে যে এলাকা জাপানি ফৌজের দখলে এসেছে সেখানেই তারা স্থানীয় মহিলাদের অনেককে গায়ের জোরে তাদের যৌনদাসী হতে বাধ্য করেছে— কোরিয়া, চিন, ফিলিপিন্স, বর্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়, মানচুকুও, তাইওয়ান। অধিকৃত অঞ্চলের ঠিক কতজনকে যৌনদাসী হতে বাধ্য করা হয়েছিল তার সঠিক হিসেব নেই, ঐতিহাসিকদের মতে সংখ্যাটা পঞ্চাশ হাজার থেকে দু’লাখের মধ্যে।

২০০৬ সালে শিনজো আবে যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলেন তার বহু আগে ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে গিয়েছে, জাপানি ফৌজের নৃশংসতা ও নারী-লালসা তখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। তবু প্রধানমন্ত্রী হয়েই আবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মরীয়া চেষ্টা শুরু করেন, বলতে শুরু করেন যৌন দাসীর কলঙ্কময় ইতিহাসে রাষ্ট্র হিসেবে জাপানের কোনও ভূমিকা নেই। হঠাৎ দেখা যায় ওয়াশিংটন পোস্টে পুরো পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে আবে সরকার সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। এরপরেই জোর ধাক্কা খান আবে। মার্কিন কংগ্রেসের যুগ্ম অধিবেশনে সর্বসম্মত ভাবে প্রস্তাব নিয়ে জাপানকে এই যৌন-দাসী প্রথার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। আবে বুঝতে পারেন তিনি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। প্রথম দফায় তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকেন মাত্র এক বছর, শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি সরে দাঁড়ান।

২০১২-য় দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফের ধীরে ধীরে স্বমূর্তি ধারণ করতে শুরু করেন শিনজো আবে। ১৯৯৩ সালে তাঁরই দল দাসী প্রথার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি বিবৃতি দিয়েছিল, যার নাম ’কোনো স্টেটমেন্ট’। ফের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আবে কী করে এই বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল তা তদন্ত করে দেখার আদেশ দেন। সঙ্গে সঙ্গে কোরিয়া, চিন, এমনকী জাপানি ঐতিহাসিক মহলে তৈরি হয় তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে লাঞ্ছিত মহিলাদের পরিজন মহলে। চারদিক থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, ব্যাপারটা হচ্ছে কী? জাপান কি তাহলে ক্ষমা প্রার্থনাকে এখন অস্বীকার করতে চায়? তাতেও দমেন না আবে। তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রথম প্রকাশকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় তারা যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইমপেরিয়াল জাপানি ফৌজের কলঙ্কজনক কাণ্ডকারখানা না ছাপায় অন্যদিকে স্কুল-কলেজে এই বিষয়গুলি কী ভাবে ছাত্রদের পড়ানো হবে তা নিয়ে শুরু হয় নতুন চিন্তা ভাবনা।

২০১৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসের যুগ্ম অধিবেশনে  আবে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পান, ভাষণ শেষে উষ্ণ করতালিও শোনেন। দেখা যায় ওই ভাষণে তিনি বিতর্কিত সব কিছু এড়িয়ে গিয়ে কোন কোন যুদ্ধে জাপান আমেরিকাকে পরাজিত করেছিল বা যুদ্ধের ফল অমীমাংসিত থেকে গিয়েছিল শুধু সেগুলির অবতারণা করছেন। সে বছরই ৫ অগস্ট জাপানের কাছে রাশিয়ার পরাজয়ের প্রসঙ্গ টেনে আবে বলে বসেন এই ফলাফল দুনিয়া জুড়ে খেটে খাওয়া মানুষকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছিল। এ কথা বলে আবে আসলে কোরিয়াকে একটা কষে থাপ্পড় মারলেন কেন না এই যুদ্ধের পরেই কোরিয়া জাপানি উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। ফলে প্রতিটি ধাপে আপাতদৃষ্টিতে যখন মনে হচ্ছিল আবে নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন আসলে তখনই তিনি চাইছিলেন একটু একটু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি অপরাধের তালিকা থেকে জাপানি রাষ্ট্রকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে আনতে। বোঝা যাচ্ছিল আবে আসলে ঘড়ির কাঁটাকে সত্তর-আশির দশকে পিছিয়ে দিতে চাইছেন জাপান যখন চিৎকার করে তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করত।

স্বাধীনতাকামী এবং আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন যে কোনও জাপানির কাছে আর একটি হৃদয় বিদারক উত্তরাধিকার হল দেশের সংবিধান যা জাপানিরা লেখেনি, ১৯৪৭ সালে আমেরিকা জাপানের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল এটাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। জাপানের কাছে এই সংবিধানের মূল কাঁটাটি হল নয় নম্বর ধারা যেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে একমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া জাপান দেশের বাইরে যুদ্ধ করতে পারবে না। ফলে লোকে বলত, এটা মার্কিন দলিল, জাপানের সংবিধান নয়। বিশ্বের কাছে এই সংবিধানই ছিল জাপানকে সবক শেখানোর দৃষ্টান্ত। জাপানিরা সেটা জানতেন কিন্তু অসহায় তাঁরা, কিছুই করণীয় ছিল না। তবে মার্কিনীদের তৈরি হলেও এই সংবিধান কিন্তু  জাপানের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অনেকেই জানেন না, জাপানের কিন্তু অতি আধুনিক ও দারুন শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনী রয়েছে, কোনও দেশ আক্রমণ করলে তা প্রতিহত করার ক্ষমতা তার বিলক্ষণ আছে। শিনজো আবের অভীষ্ট ছিল সংবিধান থেকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া, যার জন্য তিনি সর্বস্ব পণ করেছিলেন, মার্কিন প্রশাসনকে বোঝানের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হননি। অথচ প্রতিরক্ষাখাতে জাপানি বরাদ্দ বছরের পর বছর কেবল বেড়েই চলেছে। এর অর্থ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ৭৫ বছর কেটে গিয়েছে, জাপান কোথাও কখনও অশান্তি করেনি অতএব আজ না হয় কাল জাপানের পায়ের বেড়ি খুলবেই। সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছে সূর্যোদয়ের দেশ।

সবার ওপরে জাপানের কলঙ্ক-মোচনের প্রয়াসের অন্তরালে শিনজো আবে নিজের পরিবারের কলঙ্ক-মোচনেরও চেষ্টা করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাঁর মাতামহ নবুসুকে কিশিকে তিন বছর জেল খাটতে হয়েছিল কেন না ট্রাইবুনাল তাঁকে প্রথম শ্রেণির যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করেছিল। সেই মাতামহই কিন্তু ১৯৫৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। নিজের লেখা বইয়ে আবে লিখেছেন ছোটবেলায় বন্ধুবান্ধবেরা তাঁর দাদুর নাম করে টিটকিরি দিত। হয়তো তখনই আবের মনটা তৈরি হয়ে যায়, তিনি সঙ্কল্প করেন বড় হয়ে ক্ষমতায় আসলে তাঁর প্রথম কাজ হবে মাতামহের কলঙ্ক-মোচন, সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভূমির।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *