logo

আবের জনপ্রিয়তার উৎস কী

  • August 16th, 2022
News

আবের জনপ্রিয়তার উৎস কী

সুমন চট্টোপাধ্যায়

শিনজো আবের আকস্মিক এবং অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুর পরে আমরা একদিন জাতীয় শোক পালন করলাম। তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, কোনও সরকারি পদে নেই, তবুও। কেন?

প্রথম কারণ, স্বাধীনতার পরে ভারত-জাপান সম্পর্ক বরাবর শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ থেকেছে, কোনও বড় সমস্যা এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিঘ্নিত করেনি। সাম্প্রতিককালে সেই বন্ধুত্ব দৃঢ়তর হয়েছে, জাপান বাড়িয়ে দিয়েছে অকুণ্ঠিত সাহায্যের হাত, এই মুহূর্তে ভারতে জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি। এ ব্যাপারে শিনজো আবের ব্যক্তিগত সদিচ্ছাও অনস্বীকার্য।কাকতালীয় ভাবে যে জনপদে দলীয় প্রচার করতে গিয়ে আবে মারা গেলেন সেই নারায় ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে এক ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রথম গিয়েছিলেন স্থানীয় তোদাজি মন্দিরে বিশালাকায় একটি বৌদ্ধমূর্তির চক্ষু উন্মীলনে। তাঁর নাম ছিল বীরসেন। বৌদ্ধ-ধর্ম পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সঙ্গেই ভারতকে মৈত্রীর বন্ধনে বেঁধে দিয়েছিল, তার মধ্যে জাপান অন্যতম।

আধুনিক সময়ে যাঁদের সফর জাপানকে ভারতের কাছে নিয়ে এসেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসু, রাধাবিনোদ পাল, সকলেই যশস্বী বঙ্গসন্তান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপানকে শাস্তি দিতে অনেকটা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের ধাঁচে যে ওয়ার ট্রাইবুনাল বসানো হয়েছিল, রাধাবিনোদ তার সদস্য ছিলেন এবং চূড়ান্ত রিপোর্টে ‘ডিসেন্টিং নোট’ দিয়েছিলেন। সেই থেকে জাপানিরা রাধাবিনোদের প্রতি এতটাই কৃতজ্ঞ যে টোকিও শহরে তাঁর মূর্তি বসেছে, জাপান-বন্ধু ভারতীয় হিসাবে জাপানিদের কাছে এই বঙ্গসন্তানেরই স্থান প্রথমে। জাপানে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা বিলক্ষণ জানেন এটা তর্কাতীত সত্য।

তাঁদের এই যে গ্লানিময় অতীত, তার জন্য বিশ্বের দরবারে এমন ঘোর বেইজ্জতি সামুরাইদের দেশ কখনও মেনে নিতে পারেনি, তুষের ধিকধিক আগুনের মতো একটি গভীর ক্ষত থেকে এখনও তাঁদের অন্তঃস্থলে রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে নিরন্তর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি যেমন নাৎসি অতীতকে কালাধারে পাঠিয়ে, হিটলারের অত্যাচারের জন্য পুনঃপুনঃ ক্ষমা চেয়ে ফের ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসাবে মাথা চাড়া দিয়েছে জাপান সেটা পারেনি। জাপান মনে করে তারা অন্যায় অবিচারের শিকার যা তাদের প্রাপ্য ছিল না। শিনজো আবে জাপানিদের আহত আবেগকেই তাঁর রাজনীতির পুঁজি করে দেশের ইতিহাস নতুন করে লেখাতে চেয়েছিলেন। এটাই তাঁর জনপ্রিয়তার সার কথা, এই কারণেই সাম্প্রতিককালে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী থেকেছেন।

আবের জন্ম প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারে, তাঁর বাবা একদা জাপানের বিদেশমন্ত্রী ছিলেন। উত্তাল পঞ্চাশের দশকে তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। যুদ্ধকালীন অপরাধের দায় থেকে তিনি কোনওক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। আবের স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক দরবারে জাপানকে ফের স্বমহিমায় শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং হঠাৎ শ্লথ হয়ে যাওয়া জাপানি অর্থনীতিকে এক ধাক্কায় চাঙ্গা করে তোলা। মনমোহনের যেমন মনমোহনমিক্স, আবের অর্থনীতিকে বলা হতো আবেনমিক্স। দ্বিতীয় কাজটিতে তিনি চমকপ্রদ ভাবে সফল, প্রথম কাজে সফল হতে তিনি মাথা কুটে মরেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন বারেবারে।

শিনজো আবের সেই মরণপণ প্রচেষ্টার কাহিনিটি বেশ চিত্তাকর্ষক। নব্বইয়ের দশকে বাবার শূন্য আসনটি পূর্ণ করে আবে সংসদের সদস্য হয়েছিলেন। প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে ছোট্ট একটি সংসদীয় কমিটি গঠিত হয় যারা তাদের রিপোর্টে বলে ‘নানজিং হত্যালীলা’ নাকি হয়ইনি। তখনই প্রথম আভাস পাওয়া যায় জাপানি রাজনীতিতে এমন এক তারকার উদয় হচ্ছে যিনি অপ্রীতিকর ইতিহাস ম্যাজিকশপে ভুলিয়ে দিয়ে নতুন করে জাপানের ইতিহাস রচনা করতে চান।

উইকিপিডিয়া খুলুন, নানজিং ম্যাসাকারের তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ পেয়ে যাবেন। এই গণহত্যালীলা এবং আনুষঙ্গিক গণ-ধর্ষণ, অবাধ লুটতরাজের ইতিহাসকে মিথ্যে বলা ভারতীয় প্রেক্ষিতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হয়নি বলার সমতুল। সাংহাইতে জাপানি ফৌজ প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল, তার প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল তখন চিনের রাজধানী নানজিংয়ে। অন্তত দু’লাখ নিরীহ মানুষ মারা গিয়েছিল, গণ-ধর্ষণের ঘটনা হয়েছিল অন্তত ২০ হাজার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে সব জায়গায় পৈশাচিক হত্যালীলা হয়েছিল তার প্রথম সারিতে আছে নানজিংয়ের নাম। ছু মন্তর করে সেই নানজিংকে ইতিহাসের পাতা থেকে ভ্যানিশ করার মতো হাস্যকর প্রয়াস আর কিছু হতে পারে না। আবের ছেলেমানুষি ছলাকলা একেবারেই অর্থহীন।

নখ-দাঁত ভেঙে দেওয়া জাপানের শান্তিকামী মুখটা দেখতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে সাম্রাজ্যবাদী জাপানি ফৌজের নৃশংসতার কথা আমাদের প্রায় মনেই থাকে না। অথচ নির্মম সত্যটা হল নৃশংসতায় জাপানি ফৌজ নাৎসি বাহিনীর প্রায় সমগোত্রীয় ছিল। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করার জন্য বেশি দূরে নয়, শুধু আন্দামানে গেলেই চলবে। বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম প্রহরে এই আন্দামানে পৌঁছে গিয়েছিল জাপানিরা। সেখানে বিনা প্ররোচনায় তারা স্থানীয় মানুষদের ওপর কী বীভৎস অত্যাচার করেছিল, পুরোনো বাসিন্দারা তা মনে করলে এখনও আঁতকে ওঠেন। আন্দামান অবশ্যই আর একটা নানজিং হয়নি যদিও ভারতের মূল ভূখণ্ডে একবার প্রবেশ করতে পারলে তারা যে আমাদের দেশেও কয়েকটি নানজিং ঘটিয়ে ফেলত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বঙ্গবাসীর চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য কলকাতার ওপর কয়েকটি মামুলি বোমা ফেলেই জাপানি বোমারু বিমানগুলি ফিরে গিয়েছিল, আর আসেনি। হিরোশিমা, নাগাসাকি তার আগেই ইস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধের অভিমুখ নাটকীয় ভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। জাপান বাধ্য হয়েছিল হাঁটু মুড়ে আত্মসমর্পণ করতে। (চলবে)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *