logo

ব্যামোর নাম অতিকথন

  • August 16th, 2022
Suman Nama

ব্যামোর নাম অতিকথন

সুমন চট্টোপাধ্যায়

বয়স বাড়ছে, ডিমেনশিয়া বোধহয়। স্মৃতিভ্রম। অনেক কিছু ভুলতে চাই, সেগুলো মস্তিষ্কে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে বসে থাকে, অনেক কিছু যা মনে করতে চাই মনে আসে না। কী জ্বালা বলুন তো দেখি।

সকাল থেকে সেই শিল্পীর নামটা মনে করার চেষ্টা করছি যাঁর জন্য আমায় গুরুঠাকুরের বেদম বকুনি শুনতে হয়েছিল। তিনি আমার বড় প্রিয় শিল্পী ছিলেন, আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় তাঁর মৃত্যুর খবর চার কলামে বেশ ভেজে ভেজা শিরোনাম দিয়ে ছাপতে চেয়েছিলাম। গুরুঠাকুর হঠাৎ যমদূতের মতো আবির্ভূত হয়ে পাতার ডামিটার উপর চোখ বুলিয়ে একেবারে খচে ফায়ার।

এঁর মৃত্যুর খবর যদি প্রথম পাতায় চার কলামে ছাপো তাহলে সুচিত্রা সেন মারা গেলে কি ষোলো কলামে ছাপবে? এই হলো বাঙালিদের ব্যামো, মাত্রাজ্ঞান নেই, তিলকে তাল করে দেখিয়েই স্বর্গসুখ।

গুরুঠাকুর তারপরে আমাকে আরও একটি নির্মম কাজ করতে বাধ্য করলেন। খবরটি প্রথম পাতা থেকে পাঁচের পাতায় নিয়ে আসতে হলো, গেল এক কলামে। সেদিন দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ভৃত্য প্রভুর আদেশ পালন করেছিল, তবে তাঁর মন্তব্যটি আমি কখনও ভুলতে পারিনি। মানুষ কেন হরবখত অত্যুক্তি বা অতিকথনের ফাঁদে পড়ে? এটা কি কোনও মানসিক ব্যাধি না স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া? এর সঙ্গে কি নিজের হীনম্মন্যতাবোধের কোনও যোগ আছে? সহজে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মোহই কি এর প্রধান তাগিদ? আমরা বঙ্গসন্তানেরা কি এই প্রবণতায় সত্যিই অন্যের তুলনায় বেশি আক্রান্ত? অতিকথনে না ভেসে আমরা কি গুণীজনকে শ্রদ্ধা জানাতে পারি না? হিজিবিজি এমন অনেক প্রশ্ন মাথায় ভিড় করে, কোনও সদুত্তর তো মেলেই না উল্টে আরও সব তালগোল পাকিয়ে যায়।

ফরাসিরা একে বলে জলের গ্লাসে ঝড় তোলা। কাকতালীয় ভাবে ইংরেজরাও একই কথা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে বলে — স্টর্ম ইন এ টি-কাপ। আমেরিকান- টেম্পেস্ট ইন এ টি-পট। ওলন্দাজ- মশাকে হাতি বলে চালানো। তুর্কি- পতঙ্গকে উট বানিয়ে দেওয়া। আমরা সুজলা-সুফলা-শস্য শামলা দেশের মানুষ, আমাদের দৌড় তিলকে তাল বানানো পর্যন্ত। স্বস্তির কথা একটাই, অত্যুক্তি সব্বাই করে, মনুষ্য প্রজাতির জীবনচর্চার সঙ্গে এই প্রবণতার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। কিন্তু কেন?

পণ্ডিতপ্রবরেরা এই প্রবণতাকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন, ‘কগনিটিভ ডিসটরশানস’, ‘ম্যানিপুলেশন’ এবং ‘প্যাথোলজি’। তৃতীয়টি গোদা বাংলায় মানসিক বিকার, মানে অসুখ। আমাদের অতল অবসাদগ্রস্ততায় এই অসুখ মাথা চাড়া দিয়ে সঙ্গত করতে পারে। নার্সিসিস্টরা এই ব্যধিতে আক্রান্ত, নিজেদের মহামানব ছাড়া তারা অন্য কিছু ভাবতে পারে না। আর আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ বিপর্যয় সম্পর্কে যা নয় তাই ভাবতে শুরু করে।

‘ম্যানিপুলেশন’ হলো সচেতন ভাবে কোনও কিছুকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো। বাচ্চারা যেমন দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই খেলাটা খেলে থাকে, হয় তাদের সাফল্যকে বিরাট বড় করে দেখায় নতুবা ব্যর্থতার কারণ বলতে গিয়ে কত রকম বাধার সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে, সেই গপ্পো করে। এখানে নিষ্পাপ দৃষ্টি আকর্ষণটাই মুখ্য, কারও অনিষ্ট করাটা লক্ষ্য নয়। আমরাও অনেক সময় বাচ্চাদের উৎসাহিত করতে তারা যা নয় সেই কথা বলে থাকি, অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়, আমরা তবুও দমি না।

‘কগনিটিভ ডিসটরশান’ হল অবচেতনে বাস্তবকে বোঝার অক্ষমতা। মানে অসম্ভবকে সম্ভব বলে ভাবতে শুরু করা। আমরা যখন অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি তখন নিজের উদ্বেগ প্রশমনের জন্য এটি সাহায্য করে, এক ধরনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভর করে আমরা তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। যখন শুনবেন কেউ বলছে, ‘সাহিত্যে আমি বরাবর ক্লাসে প্রথম হয়েছি, এই পরীক্ষাটি আমার কাছে জলভাত’ বুঝবেন এটি নিজেকে রবিঠাকুর ভাবার প্রবণতা। আবার যদি শোনেন কেউ বলছে, ‘সবাই বলছে আমার প্রেজেন্টেশনটা একেবারে ওঁচা হয়েছে, এরপর বন্ধুরা আমাকে আর নম্বর দেবে না, হয়ত আমি আর প্রোমোশনটাও পাব না’, জানবেন এটি অবচেতনে সম্ভাব্য ক্ষুদ্র সমস্যাকে টাইটানিকের মতো বিপর্যয় মনে করা। সবটাই ঘটে অবচেতনে, সচেতন ভাবে।

অতিকথনকে একেবারে বাদ দিয়ে কথকতা হয় না, সাহিত্যে তাই তার এত কদর। পটলডাঙার ভজহরি মুখোপাধ্যায় কিংবা ৭২ বনমালি নস্কর লেনের ঘনশ্যাম দাস বাঙালির অতি প্রিয় চরিত্র এই কারণেই, বাতেলায় তাদের জুড়ি মেলা ভার।টেনিদা, ঘনাদা হয়ে ব্রজ’দার গুল্প শুনতে বসি আমরা, দু’দণ্ড জিরিয়ে নিই। ইংরেজি সাহিত্যে মিথ্যের মধ্যে দিয়ে সত্য উদ্ঘাটনের হেডমাস্টার মার্ক টোয়েন, সেই ১৮৬৫ সালে ‘ Advice for good little boys’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন,’ Good little boys must not tell a lie when the truth will answer just as well. In fact real good little boys will never tell lies at all - not at all- except in cases of the most urgent necessities.’

কিংবা ধরুন টোয়েনের এই অকপট স্বীকারোক্তি, 'never yet told the truth that I was not accused of lying and every time I lie someone believes it. So I have adopted the plan, when I want people to believe what I say, of putting it in the form of a lie. That is the difference between my fictions and other people’s. Everybody knows mine is true.’

ধান ভানতে এত শিবের গীত গাইতে হল, ফেসবুকের একটি মন্তব্য পড়ে যা কি না আমাকে অনেক বছর আগে গুরুঠাকুরের ভ্যর্ৎসনার কথা মনে করিয়ে দিল। অতিকথনের লীলাক্ষেত্র এই সমাজ-মাধ্যমে দেখলাম কে যেন লিখেছেন, 'কিংবদন্তি শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়।’ আরতি কিংবদন্তি হলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে কোন বিশেষণে বিভূষিত করব, কিংবা লতা মঙ্গেশকরকে, ভাবতে ভাবতে দু’কলম লিখেই ফেললাম।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *