logo

বাবুল মোরা নাইহার ছুটো যাইয়ে

  • August 13th, 2022
News

বাবুল মোরা নাইহার ছুটো যাইয়ে

সুমন চট্টোপাধ্যায়

সাত-সাতটি বছর পার হয়ে গিয়েছে তবু নরেন্দ্র মোদীর সেই উদাত্ত আর্জি এখনও কানে বাজে। একবার নয় বেশ কয়েকবার। 

‘মুঝে বাবুল চাহিয়ে।’ ‘মুঝে বাবুল চাহিয়ে।’

প্রার্থী তো নয়, যেন দুর্মূল্য হীরক-খণ্ড।

আসানসোলবাসী মোদীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। সুপ্রিয় বড়াল ওরফে বাবুল সুপ্রিয় গেলেন লোকসভায়। ২০১৯-এ তাঁর জয়ের ব্যবধান বেড়ে গেল কয়েক গুণ।

প্রথমবার সাংসদ হয়েই কেন্দ্রে রাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন, দ্বিতীয়বারও। তারপর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের পরে কেন্দ্রীয় সরকারে যে ব্যাপক রদবদল হল, আসানসোলের সাংসদ তা থেকে বাদ পড়লেন। বাবুল চাহিয়ে থেকে হয়ে গেলেন বাবুল ভাগিয়ে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে এই নামজাদা গায়ককে মোদী কেন অর্ধচন্দ্র দিলেন তার সদুত্তর এখনও পর্যন্ত মেলেনি। হতে পারে বিধানসভা ভোটে টালিগঞ্জ আসনে গো-হারান হেরে যাওয়া একটি কারণ। হতে পারে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁদের মন্ত্রী করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে বাবুলকে ব্যতিক্রম ঠাওরানোর কোনও কারণ প্রধানমন্ত্রী দেখেননি, বাকিদের সঙ্গে তাঁকেও বিদায় জানিয়েছেন। আবার এমনও হতে পারে সাত বছর আগে চকচক করতে দেখে মোদীর যাকে সোনা বলে বিভ্রম হয়েছিল এখন তিনি বুঝতে পারছেন আসলে সেটা ইমিটেশন গয়না।

আসলে বাবুল-জাতীয় সেলিব্রিটিদের রাজনীতিতে কোনও গুরুত্ব নেই। এঁরা হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন, একদিন আবার হঠাৎ হওয়ায় উড়ে যাবেন। সে জন্যই বাবুল ছেড়ে দেওয়ায় বিজেপি-র যেমন ভয়ঙ্কর কোনও ক্ষতি হবে না, বাবুল আসায় তৃণমূল কংগ্রেসেরও তেমনি সাঙ্ঘাতিক কিছু লাভ হওয়ার কথা নয়। ড্রয়িং রুমের টেবিলে ফুলদানিতে রাখা কাগজের ফুল এঁরা, সুদৃশ্য কিন্তু নির্গন্ধ। এখন তৃণমূলে এতসব ভারী মাথার ভিড়, তাঁদের মাঝে বাবুলের ঔজ্জ্বল্য আলাদা করে চোখেও পড়বে না।

গায়ক থেকে রাজনীতিকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য অনেক সময় পেয়েছিলেন বাবুল, টানা সাত বছর। স্পষ্টতই এ কাজে তিনি সফল হতে পারেননি। বাবুলের রাজনীতি করার পিছনে আদর্শগত বিশ্বাসের কণামাত্র ছিল না, আক্ষরিক অর্থেই তিনি ‘অ্যাক্সিডেন্টাল পলিটিশিয়ান’। এক বিমানযাত্রায় রামদেবের পাশে বসে গপ্পো করার সময়ে যোগগুরু তাঁকে বিজেপি-র টিকিটে ভোটে লড়ার প্রস্তাব দেন। বাবুল সঙ্গে সঙ্গে তাতে সম্মতি জানান। তার অর্থ, পকেটে এক বিতর্কিত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সুপারিশপত্রটুকু ছিল বাবুলের রাজনীতি করার প্রাথমিক পুঁজি এবং একমাত্র অনুপ্রেরণা। বিজেপি অথবা আরএসএস-এর নীতি বা আদর্শের প্রতি আনুগত্য নয়। বস্তুত রাজনীতিতে প্রবেশের সময়ে গেরুয়া শিবির সম্পর্কে বাবুলের স্পষ্ট ধ্যান ধারণাও ছিল না। রাজনীতির রুক্ষ ময়দানে তাঁর প্রবেশ অতিথি শিল্পী হিসেবেই।

বাবুলের ট্র্যাজেডি হল, এত বছর রাজনীতিতে থাকার পরেও তিনি সেই অতিথি শিল্পীই রয়ে গেলেন। বিজেপি করলেন, বিজেপি হতে পারলেন না। সাংগঠনিক রাজনীতি থেকে নিজেকে সন্তর্পণে সরিয়ে রাখলেন, দলের রাজ্য সভাপতির সঙ্গে ঝগড়া-ঝাঁটি করে কয়েকবার কাগজে খবর হওয়া ছাড়া। যে কোনও ধুরন্ধর রাজনীতিক বাবুলের জয়গায় থাকলে, কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব, কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে পাথেয় করে সংগঠনের অন্দরে ও বাইরে নিজস্ব একটা জনভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। বাবুলকে কখনও এ সব ব্যাপারে উৎসাহী বলেই মনে হয়নি। জনসভা ও দলীয় সভায় ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ বলেই তিনি কাটিয়ে দিলেন সাতটি বছর। ফলে তিনি আসানসোলের এমপি হয়ে রয়ে গেলেন রাজ্য বিজেপি-র নেতা হয়ে উঠতে পারলেন না।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে হঠাৎ বরখাস্ত হওয়ার পরে বাবুলের অপরিণত ছেলেমানুষি ফের প্রমাণ করে দিয়েছে রাজনীতি করলেই রাজনীতিক হওয়া যায় না। এ কথা সবাই জানে ক্ষমতার রাজনীতিতে আজকাল কেউই স্বেচ্ছায় মন্ত্রিপদ ছাড়ে না, তাঁকে ছাড়তে বলা হয়। এই তিরস্কার অথবা অপমান রাজনীতিকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সবাই কম-বেশি তার সঙ্গে বাধ্য হয়ে আপস করে চলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সর্বশেষ রদবদলে অনেককেই বাদ দেওয়া হয়েছে, একমাত্র বাবুলই প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁকে ইস্তফা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমন অপরিণত আচরণের তুলনা মেলা ভার।

জীবনে প্রথম ভোটে জিতেই কেন্দ্রে মন্ত্রী হলে নিজের অপরিহার্যতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘদিন প্রথমবার সাংসদ হওয়া কাউকে মন্ত্রী করা হত না, হলেও ডেপুটি মিনিস্টার বা উপমন্ত্রী। প্রশাসনে অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে হত ধীরলয়ে পদোন্নতি। উপমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রমন্ত্রী, তারপর কোনও বিভাগের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী, সবশেষে পূর্ণমন্ত্রী। এই যেমন প্রণব মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ইনিংস শুরু করেছিলেন উপমন্ত্রী হিসেবেই। অনেক দিন হল এই প্রচলিত প্রথা ডকে উঠেছে, এখন যা খুশি তাই হয়। ফলে যন্ত্রানুষঙ্গের সঙ্গে নির্ভুল সুরে গান গাওয়া ছাড়া যিনি জীবনে আর বিশেষ কিছু করেননি, তিনিও একদিন আকাশ থেকে টুপ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর চেয়ারে বসে পড়তে পারেন। বাবুল সুপ্রিয়র ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে আর কী!

জীবনের মতো রাজনীতিতেও ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি’। ‘বহিয়া চলেছে সুসময়’ সারাক্ষণ হবে না, হতে পারে না, কারও ক্ষেত্রে হয়ওনি। রাজনীতিবিদদের দুর্দিন কাকে বলে অন্তত তিন জন বঙ্গজ রাজনীতিকের ক্ষেত্রে আমি তা খুব কাছ থেকে দেখেছি— প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, প্রণব মুখোপাধ্যায় ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস আজ বিধানসভা ভোটের সাফল্যের পরে ‘ফ্লেভার অব দ্য সিজন’। অথচ একটা সময় ছিল যখন মমতা একা লোকসভায় দলের সাংসদ ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা এঁরা তিন জনেই যে যাঁর দুঃসময় কাটিয়ে আবার স্ব-মহিমায় ফিরে এসেছিলেন। মন্ত্রিত্বের ক্ষীরের পাত্র আমার সামনে থেকে কিছুতেই সরানো যাবে না, এ বড় আজব আব্দার, মামাবাড়ির আব্দারের চেয়েও হাস্যকর।

মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার ধাক্কায় মনে হচ্ছিল বাবুলের যেন বুদ্ধিশুদ্ধিও লোপ পাচ্ছে। একবার তিনি বললেন, রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন। তারপর জানালেন, দল করবেন না কিন্তু আসানসোলের সাংসদ থাকবেন। তারপর বললেন অন্য কোনও দলে তিনি যাবেন না, তৃণমূল কংগ্রেসে তো নয়ই। যাত্রাপালার শেষ অঙ্কে শ্বেতশুভ্র পোশাক পরে তাঁকে দেখা গেল ঘাসফুলের পতাকা হাতে। সাত বছর রাজনীতির আঙিনায় থেকে রাজনীতিকদের একটি খারাপ স্বভাব তিনি ভালোই রপ্ত করেছেন। আজ যাকে সাদা বলব কাল সেটাকেই বলব কালো, পরশু হলুদ, তরশু সবুজ.......

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *