logo

ঢপের আমি, ঢপের তুমি…

  • August 16th, 2022
News

ঢপের আমি, ঢপের তুমি…

সুমন চট্টোপাধ্যায়

নর্থ অ্যাটলান্টিক বেঙ্গলি কনফারেন্স সংক্ষেপে এনএবিসি। উত্তর আমেরিকা ও কানাডার অনাবাসী বাঙালিদের বাৎসরিক পুনর্মিলন উৎসবের পোশাকি নাম এটাই। যে সংস্থাটি এই সম্মেলনের নিয়ন্ত্রক তার নাম কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল, সংক্ষেপে সিএবি। বহু বছর আগে নিউ ইয়র্ক শহরে এই সংস্থার জন্ম হয়, তাদের উদ্যোগেই শুরু হয় বাৎসরিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন। সার্কাস পার্টি যেমন শীত এলে এক শহর থেকে অন্য শহরে তাঁবু ফেলে, এনএবিসি-ও তেমনি শহর থেকে শহরে বছর বছর চর্কি কাটে। জুলাইয়ের গোড়ায়। মার্কিন স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে।

লাস ভেগাসে শেষবার এনএবিসি হয়েছিল ২০১৪ সালে। সস্ত্রীক আমি সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলাম, গিয়েছিলেন অমিত মিত্রও। সেবারও বিজনেস সামিটের নামে হাস্যকর একটি ছোট্ট সমাবেশ হয়েছিল, অমিতবাবু সেই বেণুবনে মুক্তো ছড়িয়ে বড় আহ্লাদিত হয়েছিলেন। ফল হয়েছিল লবডঙ্কা, এক ডলার বিনিয়োগও আসেনি। কেন আসেনি তার সদুত্তর আছে যদিও এখনই সে প্রসঙ্গে প্রবেশ করছি না। আমি শুধু ভাবছি, এ কেমন রাজ্য সরকার যে জেগে ঘুমোয়, ফল শূন্য হবে জেনেও আমার-আপনার টাকা দিয়ে ভস্মে ঘি ঢালে?

অবশ্য এই বাংলায় শূন্যের কদর কতখানি তা আমরা শিক্ষক নিয়োগ কেচ্ছা থেকেই বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। মনে পড়ছে বাগদাশ্রী চন্দন মণ্ডলের কথা, প্রভূত মালের বিনিময়ে যে হরির লুটের বাতাসার মতো চাকরি বিলোত একটাই শর্তে, পরীক্ষা শেষে সাদা খাতাই জমা দিতে হবে, আঁচড়টি কেটেছ কি, নো চাকরি নট কিচ্ছু। আর অপাত্রে, অকারণে গৌরী সেনের খরচ-খরচা? সে তো গুরু একটু আধটু হবেই, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেতের মতো সুখ আর কোথায় আছে বলো? জানো না বাপু বাংলা বাজারে মেলায় গেলে চাকরি হয়, কোনদিন শুনবে আলিপুরের টাকশালটাই রাজ্য সরকার কিনে নিয়ে নিয়েছে। ভোটে ছাপ্পার নিখুঁত তালিম নেওয়া আছে যাদের, নোট ছাপানো তো তাদের কাছে বাঁয়ে হাতকা খেল!

এনএবিসি-তে আমি প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৯৪ সালে, জ্যোতিবসুর সফরসঙ্গী হয়ে, নিউ ইয়র্কের উপকণ্ঠে কোথাও একটা সেই সম্মেলন হয়েছিল। তারপর ২৮ বছরে ডজন খানেকবার আমি এই উৎসবে গিয়েছি, বেশিরভাগ সময় আমন্ত্রিত হিসেবেই। এনএবিসি-র তরফে পাতে দেওয়ার মতো বিজনেস সামিট হয়েছিল একবারই, বস্টন শহরে। জ্যোতি বসুর সরকার নয়া শিল্পনীতি ঘোষণার পরে সেই প্রথম অনাবাসীদের মধ্যেও বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখে পড়ার মতো চিত্ত-চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছিলাম। তখন বস্টনবাসী শিল্প-উপদেষ্টা পার্থ ঘোষ জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন বাণিজ্য-বৈঠক সফল করার জন্য, ধরে নিয়ে এসেছিলেন ম্যাকিনসের বড় কর্তা রজত গুপ্ত আর পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। শিল্প ও বাণিজ্য জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সঙ্গে একাসনে বসে আমাকেও বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আনন্দবাজারের প্রতিনিধি হিসেবে সেই তখন থেকেই রাজ্য সরকারের শিল্পায়নের ইচ্ছার সঙ্গে আমার সঙ্গত করা শুরু, যা তুঙ্গে উঠেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দশ বছরের প্রথম অর্ধে। তারপর ধীরে ধীরে এই উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছি, কুকুরের ল্যাজ যখন কিছুতেই সোজা করা যাবে না তখন ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মতো আমারও লম্ফ-ঝম্ফ করা হাস্যকর, বৃথা সময় অপচয়। এই অভিশপ্ত রাজ্যকে শিল্পানুকূল করে তোলা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মিলিত শক্তির পক্ষেও সম্ভব নয়, বদ্ধ জলাশয়ে ব্যাঙের জীবন-যাপনই আমাদের বিধির লিখন, কারও ক্ষমতা নেই তাকে খন্ডায়।

প্রধানত পার্থবাবুর উদ্যোগেই সেবার রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনা এবং তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সরকারের তরফে কী কী অবশ্য কর্তব্য তা সংকলিত করে একটি চমৎকার ‘পোজিশন পেপার’ তৈরি হয়েছিল, স্বপ্নের দলিল বলে তার নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘বস্টন প্লেজ।' শপথ মহাকরণে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে রইল কিছুকাল, তারপর কালাধারে চলে গেল। হুবহু একই পরিণতি হয়েছিল প্রথমে আর্থার ডি লিটল পরে ম্যাকিনসের সুপারিশেরও, তর্জন-গর্জন যতটা হল তার তুলনায় বর্ষণ হল ছিটেফোঁটা। বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়তে কোষাগারের যত টাকা গলে গেল, সমানুপাতিক হারে বিনিয়োগ আসল না। তবু তো বাম জমানায় হলদিয়া পেট্রোকেমিকেলস এসেছিল, মিৎসুবিশি জাপানের বাইরে সবচেয়ে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল হলদিয়ায় তাদের রাসায়নিক কারখানায়। তারপর গত ১১ বছর ধরে শিল্পের নামে আমরা কেবল ছেলে ভোলানো অঙ্কের হিসেব ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ফি-বছর শুনতে পাই কুহেলি ছবির সেই জনপ্রিয় গানটির মতো লাখ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ নাকি পশ্চিমবঙ্গে আসছে, আসছে, আসছে, এই তো জামা-জুতো পরে বিনিয়োগ বাংলার বিমান ধরার জন্য প্রস্তুত। তারপর কোনও এক বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে তারা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর তাদের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। গত ১০ বছরে প্রতিবার শিল্প সম্মেলনে যত টাকার বিনিয়োগ আসছে বলে দাবি করা হয়েছে, তার এক চতুর্থাংশও যদি বাস্তবায়িত হতো, লন্ডন না হলেও কলকাতা নিদেনপক্ষে সিঙ্গাপুর তো হতোই। এখন পুরোটাই ‘ঢপের আমি, ঢপের তুমি, ঢপ দেখে যায় চেনা।’

বিগত ৫০ বছরে পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ই একমাত্র বঙ্গসন্তান যিনি নিউ ইয়র্ক থেকে উজিয়ে এসে নিজের মাতৃভূমিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন এবং সবার অলক্ষ্যে এখনও করে চলেছেন। তাঁকে আমি ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনি বলেই বলতে পারি, বাংলার প্রতি পূর্ণেন্দুর নাড়ির টান আছে। অন্য রাজ্য হলে এমন ছেলেকে একেবারে জামাই আদর করে মাথায় তুলে রাখা হতো, বাম জমানায় তাঁকে পায়ের তলায় পিষে মারার চেষ্টা কিন্তু কম হয়নি। হলদিয়া পেট্রোকেমিক‍্যালের নিরঙ্কুশ মালিকানা পূর্ণেন্দুর হাতে কিছুতেই ছাড়তে চায়নি বাম সরকার, পরিচালন ব্যবস্থায় অচলাবস্থার জন্য নতুন শিল্প রুগণ হয়ে গিয়েছে, তবু বাম নেতারা তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি জানাননি। নিজের হক বুঝে নিতে পূর্ণেন্দুকে হেগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে দৌড়তে হয়েছে। পরিবর্তনের সরকার কায়েম হওয়ার পরে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ( যিনি একটি রুগণ সরকারি সংস্থার মানব সম্পদ বিভাগে কিছুকাল কাজ করার রেকর্ডকে শিল্পে পি এইচ ডি ভাবতে ভালোবাসেন) বেশ কিছুদিন পূর্ণেন্দুর ক্ষেত্রে অগ্রজ বামেদের মতোই অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়োচিত হস্তক্ষেপে হলদিয়া পেট্রোকেমিক‍্যাল বেঁচেছে, বেঁচেছেন পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ও। হলদিয়া আজ শুধু ব্যবসায়িক ভাবে সফল নয়, পরোক্ষভাবে অসংখ্য মানুষের জীবিকার লাইফ লাইন, শিল্প-শ্মশানে সাফল্যের একমাত্র লাইট হাউস। এটাই শিল্পক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

অনাবাসীদের ঘরে ঘরে পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় নেই, বস্তুত আর একটিও নেই। সুযোগের মৃগয়াক্ষেত্র মার্কিন মুলুকে অনাবাসী বঙ্গসন্তানেরা অনেকেই সফল, তবে মা লক্ষ্মীর আরাধনায় নয়, বিবিধ পেশায় এবং সারস্বত সাধনায়। বারে বারে এনএবিসি-তে হাজির হওয়ার সুবাদে লক্ষ করে দেখেছি এই উৎসবে গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে তাঁরাই ভিড় করেন। হোটেলের পার্কিং লট ভরে ওঠে তাঁদের দামি দামি সব গাড়িতে, নিজেদের মধ্যে তাঁরা আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজি বলেন যা শুনলে আমার মতো বঙ্গবাসী ভেতো বাঙালির পেট গোলায়। তাঁদের পুত্র-কন্যারা তো বেশিরভাগ বাংলা বলতেই পারে না, বঙ্গ-সংস্কৃতি তাদের জন্য নয়। তবু বলব এক ছাদের তলায় কয়েক হাজার সফল বাঙালি দুনিয়ায় আর কোথাও আপনি দেখতে পাবেন না, দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়। অন্তত আমার তো হয়ই।

তবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে এ সব কথা বলে ফেলায় আমাকে বীভৎস রকম হ্যাপায় পড়তে হয়েছিল কলকাতায় ফিরে। সেই অবিশ্বাস্য গপ্পো আগামীকাল। (চলবে)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *