logo

দিনের শেষে ঘুমের দেশে

  • August 16th, 2022
Health World

দিনের শেষে ঘুমের দেশে

নিজস্ব প্রতিবেদন: ভোরের মিঠে আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে সবে চোখের পাতা ছুঁয়েছে, প্রথম ট্রামের ঘটাং ঘট আওয়াজ কিম্বা আকাশবাণীর সিগনেচার টিউন বেজে উঠেছে চারপাশের প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়ে। আপনি তখন কী করছেন? উঠে বসছেন সটান, ঝরঝরে শরীরে প্রসন্ন মনে? নাকি, কোনওক্রমে বিছানা ছাড়ছেন ঝিমোতে ঝিমোতে, যখন একঝাঁক রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে ঘরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে, ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে বেজে ক্লান্ত, তখন? খিঁচড়ে থাকা মন নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন দিনগত পাপক্ষয়ের জন্য?

আপনি যদি প্রথম দলে পড়েন, টুঁই করে দুটো চক্কর কেটে নিন উল্লাস ভরে! আপনারা ভোরের পাখি, যাদের সার্কেডিয়ান রিদম বা নিদ্রা- জাগরণের ছন্দটি দিনের স্বাভাবিক শ্রম- বিশ্রামের চক্রটির তালে তাল মিলিয়ে চলে।

আর যারা ওই দ্বিতীয় দলের লোক, আপনারা হলেন গিয়ে, সাধু বাংলায় যাকে বলে বিশ্ব- ল্যাদখোর! দিনের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে বিকেল পড়লে তবে কাজে মন বসে আপনাদের, সন্ধে গড়িয়ে রাত যত ঘন হয়, কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে তত। প্যাঁচার মতো।

সম্প্রতি ‘মলিকিউলার সাইকিয়াট্রি’ নামক সাময়িকপত্রে ঘুম ও জেগে থাকা নিয়ে একটি বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে যার ভিত্তিতে স্যান্ডি লা’মট একটি প্রবন্ধ লেখেন সিএনএন পত্রিকায়। ইউকে-র বায়োব্যাঙ্ক স্টাডিতে ৫০ লক্ষাধিক ব্রিটিশ নাগরিকের জিনগত এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খবরাখবর জমা আছে, যার মধ্য থেকে ৮৫ হাজারেরও বেশি মানুষের নিদ্রা-তথ্য নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে দেখা গিয়েছে, যে সমস্ত মানুষের ঘুমের রুটিন যত এলোমেলো তাদের মানসিক শান্তি তত বিঘ্নিত, উৎকণ্ঠা-অবসাদের প্রবণতা ও ততই বেশি। পেঁচা বেচারাকে দিনের বেলা জাগিয়ে রেখে কাজকর্ম করালে তার যে দশা হবে,

এদেরও অবস্থা হয় তেমনই, বলেছেন নিদ্রা বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টেন নাটসন। শরীরের নিজস্ব ঘড়ির ছন্দ যখন প্রকৃতির দিবারাত্রির কাব্যের সঙ্গে মেলে না, তখনই যে নানা অসৈরণ ঘটে সে ব্যাপারে একমত বরিষ্ঠ অধ্যাপক ড. জেসিকা টিরেলও। এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন সেই সব শ্রমিকরা যাদের কাজ করার নির্ধারিত সময় সতত পরিবর্তিত হয়, কাজের শর্ত অনুযায়ীই। এই মানসিক অস্থিতি, যাকে টিরেল বলছেন সামাজিক 'জেট ল্যাগ', তা ভোর-ভোর ঘুম থেকে ওঠা ব্যক্তিকে তেমন ভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। বিমানচারী যাত্রী যখন পৃথিবীর বিভিন্ন টাইম জোনের মধ্যে যাওয়া-আসা করেন, প্রাকৃতিক সময় এবং তার একান্ত নিজস্ব শরীর ঘড়ির মধ্যে অসঙ্গতি তৈরি হয়। আর সমাজ-স্বীকৃত প্রাত্যহিকতা আর ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব নিদ্রা-জাগরণের ছন্দ না মিললে যে অসঙ্গতি তৈরি হয়, সেটাই সামাজিক জেট ল্যাগ। সোম থেকে শুক্র আপিসের তাড়নায় রাত্তির ১১ বাজতে না বাজতে বিছানা নেওয়া আর সকাল ৭টার মধ্যে বিছানা ছাড়া হওয়া ব্যক্তিটি যখন শনি-রোব্বার রাত ২টো অবধি নেটফ্লিক্স দেখে বেলা ১১টায় প্রাতঃরাশ সারেন, এক ধরনের সামাজিক জেটল্যাগে আক্রান্ত হিসেবেই তাঁকে ধরা যেতে পারে।

ভোর-ভোর যারা উঠে পড়ে, তারা দীর্ঘতর সময় সূর্যালোকের সংস্পর্শে থাকে। উদবেগ, বিষাদ থেকে মনকে মুক্ত করতে উজ্জ্বল প্রাকৃতিক আলোর বিশেষ ভূমিকা আছে বলে ম্যাডাম নাটসন মনে করেন।

এই প্রবন্ধে ঘুমের পরিমানের পাশাপাশি মানও আলোচিত হয়েছে। অপর্যাপ্ত, অগভীর ঘুম এবং মানসিক অস্থিরতা-অবসাদ ডিম-আগে-না-মুরগি-আগে জাতীয় পরিস্থিতি তৈরি করে। বিভিন্ন গবেষণায় এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে প্রমাণিত হলেও কোনটা কারণ, কোনওটাই বা ফল তা জোর দিয়ে বলা যায়নি।

ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিনীদের এক-তৃতীয়াংশই অনিদ্রাজনিত শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। সমস্যা এতটাই ভয়াবহ যে অনিদ্রাকে আমেরিকার জনস্বাস্থ্য মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিডিসি। শুধু আমেরিকা নয়, এ সমস্যা বিশ্বব্যাপীও এক ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি নামক একটি আন্তর্জাতিক এনজিও পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্তত ৪৫ শতাংশকে অনিদ্রা-জনিত সমস্যায় আক্রান্ত বলে মনে করছে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে রক্তচাপ, মধুমেহ, হৃদরোগ, এমনকী কর্কট রোগের মতো শারীরিক সমস্যা এবং অবসাদ, স্মৃতিভ্রংশ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পায়, মেদবাহুল্য ঘটে, যৌনক্ষমতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। পথ দুর্ঘটনা, চিকিৎসা বিভ্রাট, কলকারখানায় বিপর্যয়, কাজের জায়গায় ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনাও কয়েকগুণ বেড়ে যায় শরীরে ঘুমের চাহিদাপূরণ না হলে। সার্বিক ভাবে জীবনযাত্রার মান এবং কর্মদক্ষতা, দুয়ের ওপরেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওষুধবিষুধ খেয়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান তো হয়ই না, বরং ওষুধের ওপর নির্ভরতা ক্রমে আসক্তিতে পরিণত হয়। বরং, কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থিওরি (সিবিটি) নামে বহুলপরিচিত মনস্ত্বাত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতিটি পুরোনো অনিদ্রা রোগীদের দৈনন্দিন কিছু অভ্যেসে বদল আনার মধ্য দিয়ে দ্রুততর ও দীর্ঘতর ঘুম নিশ্চিত করতে, তাঁদের ঘুমের কার্যকারিতা অন্তত ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সিএনএন-এরই অন্য একটি প্রবন্ধে স্যান্ডি লা'মট আলোচনা করেছেন নিদ্রাবিধি নিয়ে।

সুষম খাদ্য ও শরীরচর্চার পাশাপাশি পর্যাপ্ত নিদ্রাও সার্বিক সুস্থতার অন্যতম চাবিকাঠি। যথাযথ ঘুমের জন্য শরীর ও মনকে ধীরে ধীরে তৈরি করতে হয়। ঠিক যেমন এই কোভিড-ধ্বস্ত সময় আমাদের বারংবার হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরার মতো স্বাস্থ্যবিধি মানতে অভ্যস্ত করে তুলেছে, তেমনই ধৈর্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিম্নলিখিত আটখানি সহজ নিয়ম মেনে চললে ঘুমকে বাগে আনা তেমন শক্ত কাজ নয় বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

১) ঘুমের উপযুক্ত আবহ তৈরি করতে হবে। আরামদায়ক বিছানা এবং ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা ঘুমের সহায়ক।

২) ঘুমের জন্য কিছু পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হয়। ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করে খানিকক্ষণ বই পড়লে, মৃদু কোনও সুর শুনলে, শ্বাস-প্রশ্বাসের হালকা ব্যায়াম কিম্বা মেডিটেশন করলে মন শান্ত হয়, সহজে ঘুম আসে। দিনটা কাজের হোক বা ছুটির, নির্দিষ্ট সময়ে শুতে যান ও বিছানা ছাড়ুন।

৩) শোওয়ার ঘর হবে ছায়ায়-কালোয় মাখা। মেলাটোনিন নামের নিদ্রাসহায়ক হরমনটি ক্ষরিত হয় আঁধারে। যে কোনও আলোতে, এমনকী আপনার স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ নিসৃত ওই মৃদু নীল আলোতেও মেলাটোনিন ক্ষরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাহলে ওই যে বই পড়ার কথা বলা আছে ২ নম্বর পয়েন্টে, তার কী হবে? মৃদু আলোয় কাগজে ছাপা বই পড়বেন, ট্যাব কিম্বা ই-বুক নৈব নৈব চ। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের নিদ্রা বিষয়ক গবেষক ডঃ সেভোলড পোলোটস্কি বলছেন যে কোনও এলইডি-জাত আলো এক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

৪) নিদ্রাকক্ষ হতে হবে নিঃশব্দ। শহুরে কোলাহলের মধ্যে যাঁদের বসবাস, তাঁদের শ্রুতির গতিমুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে বৈদ্যুতিন পাখার আওয়াজ কিম্বা হালকা কোনও গানের সুর। হোয়্যাটস্যাপ বা ইমেল মেসেজের টুংটাং শব্দে মাঝরাতে যাতে ধড়মড়িয়ে ঘুম না ভাঙে, সে ব্যবস্থাও করতে হবে ঘুমোতে যাওয়ার আগে।

৫) ক্যাফেইন স্নায়ুকে উজ্জীবিত করে, শুতে যাওয়ার অন্তত ঘণ্টাছয়েক আগে থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ক্যাফেইনযুক্ত খাদ্য-পানীয় থেকে। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে বলছেন, দুপুর ৩টের পর থেকে চা-কফি-সোডা-চকোলেট বিষবৎ বর্জনীয়।

৬) ঘুমকে কাছে টানতে গেলে দূরে রাখতে হবে সুরাকেও। আপাত ভাবে স্নায়ুকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দিলেও, ভঙ্গুর অগভীর প্রাথমিক স্তরেই আটকে থাকে সে ঘুম, স্বপ্নসম্ভব দ্বিতীয় স্তর হয়ে গভীর নিশ্ছিদ্র চূড়ান্ত স্তর অবধি যেতে পারে না।

৭) সুষ্ঠু খাদ্যাভ্যাসও ঘুমকে ত্বরান্বিত ও নির্বিঘ্ন করে। খাবার তৈলাক্ত ঝাল মশলাদার হলে সহজে হজম হয় না, অতিরিক্ত মিষ্টি হলে অস্থিরতা তৈরি হয়, এবং উভয় ক্ষেত্রেই হরমোনের ক্ষরণ বিঘ্নিত হয়, ঘুম আসতে দেরি হয়, এলেও তা গভীর হয় না। তাহলে কী ধরনের খাবার খাওয়া উচিত ঘুমের আগে? ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে, একমুঠো বাদাম কিম্বা মেলাটোনিন-সমৃদ্ধ চেরিফল কয়েকখানা, পটাশিয়াম-ম্যাগনেশিয়াম যুক্ত কলা বা ক্যাফেইন-বর্জিত চা।

৮) শয়নকক্ষকে হতে হবে 'শুদ্ধ'। মনে রাখবেন, নিদ্রা-মৈথুন ভিন্ন অন্য কোনও কাজের জায়গা বিছানা নয়। আজকের নিও-নর্মালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়মে পরিণত হয়েছে, কিন্তু তার জায়গা শোওয়ার ঘরের বিছানা নয়। গল্পের বই পড়া বলুন কিম্বা ছেলেপুলের সঙ্গে খেলাধুলো, কোনওটাই বিছানায় নয়, মনে রাখবেন। আপনার মস্তিষ্ক যেন আপনার শোওয়ার ঘরকে কেবলমাত্র নিদ্রাকক্ষ হিসেবেই চিহ্নিত করে, এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

উপরের নিয়মগুলি মেনে চলার পাশাপাশি এটাও ভুললে চলবে না যে ঘুমের প্রয়োজন সব বয়সী মানুষের একরকম নয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমের প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সিডিসি-র দাওয়াই অনুযায়ী সদ্যোজাত শিশু ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা ঘুমোবে, কিশোর-কিশোরী ঘুমোবে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ঘুমোবেন অন্তত ৭ ঘণ্টা।

ঘুম মানে বিশ্রাম, শ্রমের বিপ্রতীপে যার অবস্থান আজন্মলালিত সংস্কারবশত শ্রমকে মহিমান্বিত করি বটে আমরা, ঘুমকে খানিক হেলাফেলাই করে থাকি। ভুলবেন না, শ্রম-বিশ্রামের ভারসাম্যেই একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন গড়ে ওঠে। পর্যাপ্ত বিশ্রামের মধ্যেই যে লুকিয়ে আছে শ্রমের রসদ!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *