- August 13th, 2022
সমস্যা নয় সুযোগ
সুমন চট্টোপাধ্যায়
‘আপনার আর কিচ্ছুটি দেওয়ার নেই, কিচ্ছুটি নয়।’ ওয়েবসাইটের জন্য আমার গ্রাহকানুসন্ধানের পোস্টটি পড়ে বেঙ্গালুরুবাসী ভদ্রলোকের সেই ট্রেনের ভিখিরির কথা মনে পড়ে গিয়েছে যে শুধু হাত পেতে থাকে, দু’টো পয়সার আশায়। দ্বিতীয় একজন লিখেছেন, গ্রাহকমূল্য তেমন হলে তিনি ভিখিরিকে দিয়ে দেবেন, আমার ওয়েবসাইটে কদাচ নয়। কেন? না ‘আপনি কোনও দিন নিরপেক্ষ ছিলেন না, এখনও নন।’ তৃতীয় একজন জানতে চেয়েছেন, ‘এটা যে একটা ‘স্ক্যাম’ হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?’
ভ্যর্ৎসনা, সন্দেহ, অভিযোগ, নিঃশর্ত সমর্থন বন্ধুদের প্রতিক্রিয়ায় সবটাই প্রতিফলিত। তবে পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়া বন্ধুরাই বুদ্ধ-জমানার শেষ পাঁচ বছরে রাজ্য বিধানসভায় সিপিএমের মতো বিপুল ভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠ। এটা তৃপ্তিদায়ক, কিছুটা শ্লাঘার বিষয়ও বটে, আমার আজকের বৈচিত্র্যহীন, নিস্তরঙ্গ জীবনের অভীষ্ট অক্সিজেন। যাঁরা সমর্থনের আশ্বাস দিলেন তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ, যাঁরা স্পষ্ট ভাষায় ধিক্কার জানালেন তাঁদের সৎসাহসকেও আমি কুর্নিশ জানাই।
বন্ধুদের মন্তব্যে একটি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে অসংখ্যবার। ‘নিরপেক্ষতা।’ পাশে থাকব, যদি নিরপেক্ষ থাকেন, যদি লাল-গেরুয়া-সবুজ কালির বদলে কালো কালিতে লেখেন, যদি চটি না চাটেন ইত্যাদি। আমার ইচ্ছের ওয়েবসাইটের কনটেন্ট কী হবে, কী ভাবে তা পরিবেশিত হবে আমার আগের লেখায় আমি তার আভাসটুকু পর্যন্ত দিইনি। এখনও দিচ্ছি না। কেন না আমি যে ওয়েবসাইট করব সেই সিদ্ধান্তটিই এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত নয়। যদি করিও তাতে কী থাকবে সেটাই আমার বিজনেস সিক্রেট। অথচ রামায়ণ লেখা হওয়ার আগেই রামের চরিত্র নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে কেন?
কারণটিও আমার জানা। আমি আমার কর্মজীবনের জীবনের পুরোটাই প্রধানত রাজনৈতিক সাংবাদিকতা করেছি, নেতা-নেত্রীদের নিয়ে অসংখ্য নিবন্ধ লিখেছি, তাদের সঙ্গে ওঠাবসাও করেছি নিরন্তর। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ইস্যুতে আমার অবস্থান কারও মনে হয়েছে সঠিক, কারও মনে হয়েছে পক্ষপাতদুষ্ট। ফুলের স্তবক যত পেয়েছি ইষ্টক বর্ষণ তার চেয়ে কম কিছু পাইনি। পক্ষপাতের অভিযোগ আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এমন দাবি আমি কখনও করিনি। সময় গেলে বুঝতে পেরেছি অনেক সমালোচনা যথার্থ হয়নি, অনেক প্রশংসা গিয়েছে অপাত্রে। তূণ থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীর আজ আর ফেরানোর কোনও উপায় নেই, ফলে আমার সম্পর্কে যাঁর মনে যে ধারণাই তৈরি হয়ে থাকুক না কেন আমাকে তা নতমস্তকে মানতে হবে, তা সে গায়ে যত ফোস্কাই পড়ুক।
এতদিন যা করে এসেছি, জীবনের বাকি সক্রিয় দিনগুলিতে সেটাই করে যেতে হবে এমন মাথার দিব্যি তো আমি কাউকে দিইনি। আত্মানুসন্ধান করলে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটি আমার ক্ষেত্রে ঘটে গিয়েছে বলে মনে হয় তা হলো রাজনীতির প্রতি ঘোর অরুচি। টাইফয়েড থেকে ওঠা রোগীর মুখে যেমন অরুচি হয়ে থাকে আমার অরুচির গভীরতা তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি। রাজনীতিক অথবা রাজনীতি কোনওটাই আমাকে আর আকৃষ্ট করে না, মনে মনে আমি এদের তালাক দিয়ে দিয়েছি অনেক দিন। অনেকের কাছে আমার এই বিবর্তন ভূতের মুখে রাম নামের মতো শোনাতে পারে। কিন্তু ঈশ্বর-ভীরু আমি ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, এটাই সত্য, সত্য ব্যতীত আর কিছুই নয়।
হলটা কেন এমন? সম্ভাব্য অনেক কারণ থাকতে পারে। হয়তো অর্থনীতির ‘ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন’ কাজ করেছে আমার ক্ষেত্রে, প্রক্সিমিটি হ্যাজ ব্রেড কনটেম্পট। দ্বিতীয় কারণ আমার কর্মজীবনের বেশিরভাগ জুড়ে আমি যে স্তরের ও যে উচ্চতার রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘর করেছি, মিশেছি, শিখেছি, প্রভাবিত হয়েছি তাঁরা প্রায় সবাই বৈতরণীর ওপারে চলে গিয়েছেন, এই মহাশূন্যতা আর ভরাট হয়নি। এখন যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা ভিন্ন জাতের, ভিন্ন গোত্রের, ভিন্ন মানসিকতার লোক, আমি এই নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারি না, সত্যি কথা বলতে কি চাইও না।
সবচয়ে বড় কথা, রাজনীতির ময়দানে ঘুরে বেড়ানো আগে বড় আনন্দের বিষয় ছিল, গায়ে গণতন্ত্রের ফুরফুরে হাওয়া লাগত। এখন সেই ময়দানে পাতা অসংখ্য মাইন, একটু অসতর্ক হলেই সব্বোনাশ! হয় চাকরিটি নট হয়ে যাবে, নয় বিজ্ঞাপন বন্ধ হবে, পুলিশি নজরদারি শুরু হবে, নয়তো গুমঘরে চালান করে দেওয়া হবে। এ দেশের মানুষ রাজনীতির কারবারিদের শ্রদ্ধা-ভক্তির আসন থেকে নামিয়ে দিয়েছে অনেককাল আগেই, বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে তাদের অবস্থান একেবারে তলানিতে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়, যে রাজনীতিক যত ক্ষমতাবান তাঁকে ভয় তত বেশি। আগে বলত বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা এখন বাঘমামার জায়গাটা দখল করে নিয়েছেন রাজনীতিকরা, বিশেষ করে শাসককূল।
অতএব কোনও রকম আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে না গিয়ে গোড়াতেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, যে ভারতবর্ষে আমরা জন্মেছি, বড় হয়েছি, শিক্ষা, তারপরে কর্মজীবন কাটিয়েছি, সেই দেশটাই আর নেই। জওহরলাল নেহরুর মতো একজন একদা এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো একজন মুখ্যমন্ত্রী, এই স্মৃতিটুকুও আজ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সব ক’টি প্রতিষ্ঠান যেখানে মেরুদণ্ডহীন কর্তাভজায় পর্যবসিত হয়েছে সেখানে মিডিয়া ব্যতিক্রমী আচরণ করবে এই প্রত্যাশাই অযৌক্তিক নয় কি? বিশেষ করে আজকের বৃহৎ মিডিয়া গোষ্ঠীগুলি যখন ধীরে ধীরে কর্পোরেট শাসিত হয়ে পড়েছে। বাকি সব প্রতিষ্ঠানের মতো মিডিয়াও তাই প্রেডিক্টেবল। আমরা সবাই জানি কে কোথায় কেন কী লিখছে বা বলছে। পাপি পেটকা সওয়াল, করবেই বা কী? সাংবাদিকতা বলতে আমরা যা বুঝেছিলাম এবং সেই আকর্ষণে এই পেশায় যোগ দিয়েছিলাম সেটা এখন শবদেহ হয়ে পড়ে আছে সৎকারের অপেক্ষায়। কোভিডে মারা যাওয়া বেওয়ারিশ লাশের মতো।
এই পরিস্থিতিতে তাহলে করণীয়টা কী? একটা রাস্তা হল পাগলা জগাই হয়ে সাত জার্মানের সঙ্গে লড়াই করা। দেশের নানা প্রান্তে এমন কিছু জগাই এখনও আছে যারা পেশার মূল ধর্মটুকু আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করছে প্রাণপণে, শত অসুবিধে সত্ত্বেও। আমার বয়সটা বিশ বছর কম হলে আর শরীরের সব যন্ত্রপাতি সচল থাকলে আমিও ওই জগাইদের দলে নাম লেখাতাম। কিন্তু যেটা পারব না তা নিয়ে বারফাট্টাই করতে যাব কেন?
আমি একটি কথাকে গুরুবাক্য মেনে সারাটা জীবন পথ চলার চেষ্টা করেছি। সেটা হল, দেয়ার ইজ নো প্রবলেম ওনলি অপরচুনিটি। অর্থাৎ সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করাটাই জীবনের আসল চ্যালেঞ্জ। রাজনীতি কিংবা রাজনীতিকদের ছায়া না মাড়িয়ে সাংবাদিকতা করা যায় না, আমি এই যুক্তি মানি না। বরং আমি মনে করি রাজনীতির একই কাহন শুনতে শুনতে অথবা দেখতে দেখতে পাঠক এবং দর্শক ক্লান্ত, বিরক্ত, বিক্ষুব্ধ। অনেক রাজনীতি হল, এ বার যদি সত্যিই কিছু করি তার ভরকেন্দ্রে রাখব মানুষকে, আমি, আপনি, আমরা সবাই। একটা মন ভালো করা বিকল্প পথের সন্ধানে আছি আমি। উদ্যমটা আমার, আমার সঙ্গে হাতেগোনা যে ক’জন কাজ করবে তাদেরও। সাফল্য অথবা ব্যর্থতার শিলমোহর বসানোর মালিক আপনারা।
এমন কিছু করা যাক যার অভিধানে ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটিই থাকবে না। তাই কে কতটা নিরপেক্ষ এমন প্রশ্ন তোলারও অবকাশ থাকবে না।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ আবার দিয়ে রাখি। এখনও পর্যন্ত এটা অলস মস্তিষ্কের অলস ভাবনা। সাকার হবেই সে নিশ্চয়তা নেই।