logo

হাফসোল-৬

  • August 16th, 2022
Man-Woman

হাফসোল-৬

অসময়ের জুঁইফুল

অর্পিতা বোস

সে বছর শীতে বাবার সাথে মাসিমণির বাড়িতে যখন পৌঁছলাম দুমকাতে, তখন দুপুর ক্ষয়ে গেছে। দরজায় পা দিতেই মাসিমণি একগাল হেসে বললেন, ‘আমি জানতাম জুঁই তুই এ সময়ই আসবি প্রতিবারের মতো পরীক্ষা শেষে।’ সোফাতে বসতেই মাসিমনি বলে উঠলেন, ‘জুঁই তুই তো একদম সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখতে হয়ে গেছিস রে। এ বার যেন কোন ক্লাস হলো?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘এ বার সেভেন হবে। আমি এখন বিগ গার্ল।’

মাসিমনির হাসির সাথেই কানে এল এক অপূর্ব কণ্ঠস্বর। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওপরে গান গাইছে কে?’ ‘তোর রাঙাদার বন্ধু, আবির। ধানবাদে থাকে। মাঝেমাঝেই দু-চারদিন এসে কাটিয়ে যায়। বড় ভালো গান গায়।’
মাসিমণির আর কোনও কথাই কানে যাচ্ছিল না আমার। এক অদৃশ্য অজানা সুরের সম্মোহন। অস্থিরতায় বলে উঠলাম, ‘মাসিমণি আমি একটু ওপরে যাব?’

-‘কেন রে?’

-‘ভীষণ সুন্দর গাইছেন। একটু শুনেই চলে আসব, রাঙাদা তো আছেই।’

-‘আচ্ছা যা।’

এক দৌড়ে পৌঁছে গেছি চিলেকোঠার ঘরে। 

দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। সারা ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ভর্তি। গান কিন্তু থামল না। তখনও উদাত্ত কন্ঠে গান চলছে — আমার নয়ন ভুলানো এলে… আমি কী হেরিলাম….

মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভেসে গেলাম সেই সুরে। গান শেষ হলেও এক আবেশে সব ভুলে গেছিলাম। ঘোর কাটল রাঙাদার কথায়, ‘জুঁই! কখন এলি?’

ঘোর কাটতেই লজ্জা লাগল খুব। জড়তা কাটাতে কথা ঘুরিয়ে রাঙাদাকেই শাসনের ভঙ্গিতে বলে উঠি, ‘সিগারেট খাচ্ছিস! পড়াশোনা না করে?  মাসিমণিকে বলে দিচ্ছি  দাঁড়া...’

কথাটা শেষ করেই ঘর ছাড়তে পেছন ফিরি। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার কথাগুলোকে একটুও পাত্তা না দিয়ে অচেনা কণ্ঠ বলে ওঠে,

‘আসার সময় একটু খাবার জল এনো তো।’

দু’চোখে আগুন ঝরিয়ে নীচে নামছি। কানে এল প্রাণখোলা হাসির শব্দ ।

নাহ্, নালিশ আর করা হয়নি। বরং ধীরে ধীরে জমে উঠেছিল আলাপ। সময়ের সাথে সে আলাপের গভীরতা ছুঁয়েছিল প্রেম। ফিরে এসেছিলাম প্রথম প্রেমকে মননে নিয়ে। চিঠির শব্দেরাই ছুঁয়ে থাকত দু’জনকে।

এরপর আবার দেখা পরের বছর মাসিমণির বাড়ির পুজোতে। আবিরদাও এসেছিল। একান্তে প্রথম দেখা পুকুরপাড়ের আবছায়ায়। চিঠির উত্তর না পাওয়ার অভিমানগুলো ফোঁপাতে ফোঁপাতে অভিযোগে মিশছিল। হঠাৎ দুটো জড়িয়ে ধরা হাতকে ছাড়ানোর সাধ্যা ছিল না। রাগ-অভিমান-অভিযোগ সব হারিয়ে গেছিল প্রথম স্পর্শের আবেশে। মাতাল হয়ে যাওয়া চোখ বন্ধ তখন। খুব কাছাকাছি চলে আসা নিকোটিনের গন্ধের আবেশ নিয়ে সেবার বাড়ি ফিরেছিলাম।

তারপর দু’বছর যাওয়া হয়নি মাসিমণির বাড়ি। আবার যখন গেলাম, তখন মনে তুমুল ঝড়। মাঝের সময়টা কী ভাবে কেটেছে কেউ জানে না। পুরোনো চিঠির শব্দে ঠোঁট রেখেই যেন নিকোটিনের গন্ধটা অনুভব করতাম । চিঠি না পাওয়ার অভিমানের মেঘ আর বহুদিন পর আবার দেখা হওয়ার আনন্দের বাতাস নিয়ে মন তখন উথালপাথাল। মাসিমণির বাড়ির দরজায় দাঁড়াতেই কানে এল সেই স্বপ্নের সুর, ‘আমি আপন মোহের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা...’

আজন্মলালিত সেই স্বপ্নের কণ্ঠস্বর বুকের ভিতর একরাশ প্রজাপতির পাখা মেলল। 
মাসিমণিকে প্রণাম করেই ছুট দিলাম সিঁড়ির দিকে। দরজার ফ্রেমে দাঁড়াতেই থমকে গেলাম। আমাকে দেখেই থেমে গেল গান। এক বিষাক্ত জলীয় বাষ্প যেন ভিজিয়ে দিল আমাকে। আমার স্বপ্নপুরুষের পাশে বসা এক সুন্দরী। রাঙাদা বলল, কখন এলি?

কথারা হারিয়ে গেছে তখন আমার। রাঙাদাই হেসে পরিচয় করালো, এ হলো আবিরের হবু বউ। নাম তনুশ্রী। সামনের বৈশাখে ওদের বিয়ে।

অনেক চেষ্টা করেও হাসতে পারলাম না। কাঁদিওনি। এমন চমকে শুকিয়ে গেছিল কান্নাও। আবিরদাই পরিচয় করাল, এই হলো অসময়ের জুঁইফুল।

হাতজোড় করে হাসল সুন্দরী। স্থবির আমার চোখে ভেসে উঠল আবিরদার চিঠির অক্ষরেরা — প্রেমকে কখনই নিজের করে নিতে নেই। দূরে থাকলেই সে প্রেম বেঁচে থাকে চিরকাল।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *