logo

বুদ্ধং শরণং (পর্ব-৬)

  • August 17th, 2022
Memoir

বুদ্ধং শরণং (পর্ব-৬)

সুমন চট্টোপাধ্যায়

পার্থ ভট্টাচার্য। সম্পর্কে বোধহয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের তুতো ভাই। কর্মজীবনে এর জন্য তিনি বাড়তি কোনও সুবিধে পেয়েছেন বলে শুনিনি, তাঁর প্রয়োজনও হয়নি। কেন না পার্থবাবু নিজেই ছিলেন আইপিএস, সুদক্ষ পুলিশ অফিসার। খাদিম কর্তার অপহরণের ঘটনাটি যখন ঘটে পার্থবাবু তখন সিআইডি-র সর্বময় কর্তা। পুলিশ মহলে কোনও দিনই আমার তেমন যাতায়াত ছিল না। কেন না আমি কোনও দিন ক্রাইম রিপোর্টার ছিলাম না। পার্থবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয় ভ্রাতৃসম প্রীতিময় চক্রবর্তীর সৌজন্যে। প্রীতিময় তখন চুটিয়ে ব্যবসা করে, ব্যবসার সূত্রেই চিনে যাতায়াত করে প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারের মতো। পুলিশ মহলের ওপর তলায় তার অপরিচিত বলে কেউ ছিল না। পার্থ রায় বর্মন হঠাৎ অপহৃত হওয়ার পরে কথায় কথায় প্রীতিময়ই প্রস্তাব দিল, ‘চলো পার্থদার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। এক্কেবারে জেনুইন খবর পাবে।’

পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই রোমহর্ষক বৃত্তান্তে আসছি পরে। তার আগে একটু ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে নিই। মেইন লাইন থেকে ঢুকে পড়ি কর্ড লাইনে। যে কোনও আখ্যানের এক ঘেয়েমি ঘোচাতে একটু স্বাদ বদলও তো প্রয়োজন হয়!

৪০ বছরের কেরিয়ারে শহর কলকাতায় আমি মাত্র তিনটি বড় অপরাধের রিপোর্টিং করেছি। বিনোদ মেহতার হত্যা, বৌবাজার বিস্ফোরণ এবং খাদিম কর্তা অপহরণ। তিনটিই রাজ্য তোলপাড় করা ভয়ঙ্কর ঘটনা যার তত্ত্ব-তালাশের উত্তেজনা বা রোমাঞ্চ রাজনীতি কভার করার মতো শুষ্কং কাষ্ঠং নয়, রীতিমতো গা গরম করা। একই সঙ্গে আবার অপরাধ-জগতের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটাও যমজ ভাইয়ের, উভয়েরই উভয়কে প্রয়োজন টিকে থাকার জন্য। ফলে অপরাধের জগৎ রাজনীতি বিযুক্ত ভূখণ্ড এ কথা মনে করার কোনও কারণই নেই।

চলুন শুরু থেকে শুরু করা যাক।

২০০১-এর মতো ১৯৮৪ সালটাও ছিল ইতিহাস বদলে দেওয়ার বছর। সে বছর পয়লা জুন গোটা দেশকে হতচিকত করে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী শিখদের পবিত্রতম ধর্মস্থান অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে হঠাৎ সেনা অভিযানে সবুজ সঙ্কেত দিলেন। তার পরিণাম স্বরূপ প্রধানমন্ত্রীরই দুই শিখ দেহরক্ষী বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিল ইন্দিরার দেহটাকে। রাজীব গান্ধী হলেন একক গরিষ্ঠতা পাওয়া কংগ্রেসের শেষ প্রধানমন্ত্রী। তারও আগে মার্চ মাসে কলকাতায় ঘটে গেল একটি গা শিউরে দেওয়া ঘটনা। বন্দর এলাকার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার বিনোদ মেহতাকে কর্মরত অবস্থায় নৃশংস ভাবে হত্যা করা হল গার্ডেনরিচের এক চোরা গলিতে। তার ঠিক দু’বছর আগে বামফ্রন্ট সরকার দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরেছে। বৃহস্পতি একেবারে তুঙ্গে, সঙ্গে মারমুখী জঙ্গিয়ানা। সেই জঙ্গিপনার মুখে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে রইল একটানা ৫৪ দিন। কাশিপুরে শত ঘোষের কাছে অপ্রত্যাশিত হারের পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন দৃশ্যপটের বাইরে।

বিনোদ মেহতার হত্যা স্তম্ভিত করে দিয়েছিল গোটা পশ্চিমবঙ্গকে। আমাদের সম্পাদক ঠিক করলেন এই হত্যার ঘটনা নিয়ে কয়েক কিস্তি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন বের করতে হবে, সঙ্গে যাবে এলাকার স্কেচ। কাজটির জন্য একটি ছোট দল গঠন করা হল। যাদের কাজ হবে অকুস্থল এবং সম্ভাব্য সব সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আনা। তারা বাজার করবে, রান্না করবেন অরুণ বাগচি। আমাকে এই দলে রাখা হয়েছে দেখে প্রথম চোটে বেশ অবাক হয়েছিলাম। কেন না তার আগে কখনও অপরাধের জগতে রিপোর্টার হিসেবে ঢুঁ মারিনি। দিন পাঁচেক ধরে লাগাতার হাড়ভাঙা খাটুনি খাটার পরে যখন দেখলাম প্রতিবেদনে কেবল অরুণ বাগচির নাম ছাপা হচ্ছে, রাগে গা রি রি করে উঠেছিল। এ তো এক্কেবারে দারোগার পুষ্টির জন্য হাঁসের ডিম পাড়া।

সেই প্রথম ‘মিনি পাকিস্তানের’ (বর্ণনার স্বত্ব ফিরহাদ হাকিম) সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয়। হত্যাকাণ্ডের পরে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছে গোটা এলাকা। তাঁদের মধ্যে আবার বেশিরভাগ সাদা পোশাকে। ফলে স্থানীয় মানুষ ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন, বাইরের লোক দেখলেই সপাটে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। গলি, তস্য গলি, মধ্য গগনে সূর্য থাকলেও তার রশ্মি গলিতে ঢোকে সরু সুতোর মতো। যে কানাগলিতে টেনে নিয়ে গিয়ে সশস্ত্র গুন্ডারা বিনোদ মেহতা ও তার দেহরক্ষীকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছিল পরপর দু’দিন গেলাম সেখানে। এমন পাণ্ডব বর্জিত সুনসান জায়গা যে বাইরে বড় রাস্তা থেকে বোঝার উপায়ই নেই সেখানে কী হচ্ছে। আহামরি তথ্য যে খুব একটা সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম তা নয়, তবে বন্দর-সংলগ্ন অপরাধ জগতের গর্ভগৃহে ঘোরাঘুরি করতে বেশ রোমাঞ্চই হচ্ছিল। কত রকম গুন্ডা-মস্তানের নাম শুনলাম, কোন এলাকায় কার দাগাগিরি বোঝার চেষ্টা করলাম, আগ্নেয়াস্ত্র আর বোমা-বারুদের কয়েকজন জোগানদারের নামও জানা গেল, চোরাবাজারে আসল আর নকলের পার্থক্য বোঝার টোটকাটাও এই সুযোগে শিখে ফেললাম। গল্পের শেষে বুঝতে পারা গেল, গার্ডেনরিচ এলাকায় যাবতীয় কুকর্মের পৃষ্ঠপোষক একজনই, কলিমুদ্দিন শামস। স্রেফ টাকার জোরে যিনি নিজের দল ফরওয়ার্ড ব্লককে বশে রেখেছেন। মেহতার আততায়ী হিসেবে হাওয়ায় ভাসছিল একটাই নাম, ইদ্রিস মিঞা।

আমাদের কাজ শেষ, বিনোদ মেহতার হত্যা রহস্য নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা শুরু হয়ে গিয়েছে আনন্দবাজারের প্রথম পাতায়। গার্ডেনরিচ-বিশেষজ্ঞ হয়ে যাওয়ার পরেই নাইট ডিউটি পড়ল আমার। রাত ১২টা নাগাদ হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল, ওপারে ফ্যাসফেসে গলায় সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ‘আসল খবরটা পেয়েছ কী?’

বুঝতে পারছি না, কোন খবরটার কথা বলছেন।

ইদ্রিস মিঞাকে পুলিশ লক-আপে পিটিয়ে মেরে দিয়েছে। এখন ওর বডি আছে মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। পারলে একবার ঘুরে এসো।

তিড়িং করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে ডেস্কের লোকেদের বললাম, আমি একটু বেরোচ্ছি। ফিরে আসার পরে বড় খবর হতে পারে।

একতলায় অফিসের মূল ফটকের সামনে টেলিগ্রাফের নাইট রিপোর্টারের সঙ্গে দেখা। আমাকে ও রকম হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখে তার মনে স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ হল। সে বারবার জানতে চাইল আমি এত রাতে যাচ্ছিটা কোথায়। ঢপ দিতেই হল, না দিয়ে কোনও উপায় ছিল না।

মেডিক্যাল কলেজে ঢুকেই সোজা মর্গে। বাইরে যে সব পুলিশকর্মী পাহারা দিচ্ছে তারা বেশ বন্ধু-প্রকৃতির। একটু খোঁচাতেই গোটা কাহিনিটা গড়গড় করে বলে ফেলল। একজন আবার টর্চ জ্বালিয়ে মর্গের মেঝেতে শায়িত ইদ্রিসের লাশটিও দেখানোর চেষ্টা করলেন। সেখান থেকে এলাম হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারবাবুর কাছে। রেকর্ড দেখে তিনি কনফার্ম করলেন, হ্যাঁ, একটা ডেডবডি এসেছে, নাম ইদ্রিস। কোনও তাপ উত্তাপই নেই ডাক্তারবাবুর গলায়। এটা যে কত বড় ভিআইপি লাশ তিনি তার খবরই রাখেন না। অফিসে ফেরার সময় মনে হল, ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই খবরের কাগজ পড়েন না।

ভেবেছিলাম খবরটা এক্সক্লুসিভ হবেই হবে। হল না। পরের দিন সকালে দেখি যুগান্তরের প্রথম পাতায় অনিল ভট্টাচার্যের বাই লাইনে ইদ্রিসের মৃত্যু নিয়ে একটি ছোট্ট খবর বেরিয়েছে। বিনোদ মেহতার হত্যার পিছনে এত দৌড়েও বাইলাইন জোটেনি। অথচ ইদ্রিস মিঞার জন্য আধ ঘণ্টা পরিশ্রম করেই প্রথম পাতায় বাই লাইন, তাও আবার অরুণ বাগচির লেখার পাশেই।

আনন্দ হয়েছিল খুব তবু স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই সে রাতে আমি চরম স্বার্থপরের মতো আচরণ করেছিলাম। সে সময় রাতের ডিউটিতে থাকা রিপোর্টারদের একটা কোড অব কনডাক্ট ছিল। যার সারকথা হল কেউ কোনও বড় খবর পেলে সকলের সঙ্গে সেটা ভাগ করে নেবে। সে রাতে এই অলিখিত রীতি আমি মানতে পারিনি। এক্সক্লুসিভ বড় খবর আসলে প্রণয়িনীর মতো, কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় কী? (চলবে)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *