logo

পুজো, আসা না আসা

  • August 13th, 2022
Reminiscence, Suman Nama

পুজো, আসা না আসা

সুমন চট্টোপাধ্যায়

পুজো এলো। এলো বুঝি? সবাই যখন বলছে, নিশ্চয়ই এলো।

আমি মফঃস্বলে বড় হয়েছি, পুজো যে আসছে তা টের পেতাম প্রকৃতির ইঙ্গিতে, মনের অন্দরের তা থৈ তা থৈ আনন্দে। পুজো মানে লেখাপড়া থেকে দিন কতকের মুক্তি, নতুন জামা কাপড়, লম্বা ছুটি আর সেই ছুটিতে লিলুয়ায় পিতামহের আবাসে তুতো ভাই-বোনেদের সঙ্গে কলকাকলিতে মেতে ওঠা। কাউকে বলে দিতে হতো না পুজো আসছে, পুজো নিজেই বলে দিত আমি আসছি।

শরতের হাওয়ায় তখন হিমের পরশ থাকত, মাথার ওপরে আকাশে নির্জলা, ঘন নীল পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের অলস ঘোরাফেরা, পায়ের তলায় শিশির-সিক্ত প্রাণোচ্ছ্বল ঘাস। মা বলতেন, খালি পায়ে শিশির মাখা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটা নাকি ভালো, আমি অবশ্য ভালো-মন্দের তোয়াক্কা না করেই খালি পায়ে হাঁটতাম, বড্ড ভালো লাগত। শিউলিতলা ভরে থাকত ঝরা ফুলে, তলার মাটি পর্যন্ত দেখা যেত না। টগর ফুলগুলো পিটিপিট করে তাকিয়ে থাকত কিছুটা যেন হীনম্মন্যতাবোধেই। শরৎ মানে শিউলি, শিউলি মানে শরৎ। আঁজলা ভরে শিউলি কুড়িয়ে বাড়ি এসে মায়ের হাতে তুলে দিতাম, এই নিবেদনটুকুই ছিল আমার মাতৃ-আরাধনা। মন্ত্রহীন, উপাচারহীন, নিরুচ্চার, তবু ভক্তি আর ভালোবাসার সবটুকু নিংড়ে নিয়ে দেওয়া।
তারপর ১৯৮৪ সালে হঠাৎ আচম্বিতে মা চলে গেলেন চূড়ান্ত অবিবেচকের মতো, কিচ্ছুটি না জানিয়ে। তখন আমার বয়স ২৭। আর তারপর থেকেই পুজোর আসা-যাওয়া আমার কাছে নিছকই একটি বাৎসরিক ঘটনায় পর্যবসিত হল, আলাদা করে তার আর কোনও তাৎপর্যই অবশিষ্ট রইল না। আমার গর্ভধারিনী, রক্ত-মাংসের মা-ই যখন অসময়ে বিদায় নিলেন তারপরে আর কোনও মায়ের আমার প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারলাম, ঘরে মা থাকলে তবেই বাইরের মৃন্ময়ীকে বড় আপনার মনে হয়, অন্যথায় নয়।
পুজো আমার কাছে এখন কেবল বহু দূরের খণ্ড-খণ্ড স্মৃতি, বেশিরভাগটাই সুখের, কিছুটা বিষাদের। ছেলেবেলায় বিজয়া দশমীর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠত, অবশ্যম্ভাবী বিচ্ছেদ বেদনায় প্রাণটা ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠত, মনে হতো গলার কাছে কিছু একটা যেন আটকে আছে। বাবার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেবী-বিসর্জন দেখতে যাওয়ার দুঃসাহস আমার হতো না, খাঁ খাঁ মণ্ডপে একলা প্রদীপের জ্বলন্ত শিখাটিকে মনে হতো যেন আমি-ই। এ ভাবে দেখলে মৃন্ময়ী মা আমার মায়ের চেয়ে ভালো, বলে কয়ে নির্ধারিত দিনে ছেলেপুলে সঙ্গে করে বাপের বাড়ি আসেন আবার নির্ধারিত দিনে ফিরে যান। আর আমার মা? এই ছিলেন, এই নেই। ঠিক যেন পি সি সরকারের ইন্দ্রজাল!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *