- August 13th, 2022
যত তারা তব আকাশে
বিশেষ প্রতিবেদন: রাতের আকাশ দেখতে ভালোবাসেন? সে আকাশে নিষ্পলক ফুটে থাকা অগণন অযুত নক্ষত্ররাজি মুগ্ধ করে আপনাকে?যুগপৎ বিভ্রান্ত ও শিহরিত করে মহাজাগতিক ঘটনাবলীর অন্তর্লীন রহস্য ও যুক্তি? প্রশ্নগুলির উত্তর সদর্থক হলে, ২০২২ আপনার কাছে জ্যাকপট জিতে নেওয়ার বছর। অন্তত আটখানা মহাজাগতিক চমক অপেক্ষা করে আছে এ বছর আপনার জন্য।
গোটা বছরটি জুড়ে রাতের আকাশ থাকবে বিস্ময়ে, রহস্যে, অভূতপূর্বতায় ঠাসা। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হবে দু'বার, পৃথিবীর মেদুর ছায়া গায়ে মেখে শুভ্রশশী হয়ে উঠবে রক্তলাল, লক্ষকোটি পৃথিবীবাসী সে অনির্বচনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকবে। চাঁদের আলো ম্লান হওয়ায় সেদিন ঝলকে ঝলকে উল্কাপাত দেখা যাবে আকাশজুড়ে। উজ্জ্বলতম পাঁচ প্রতিবেশী গ্রহ দৃশ্যমান হয়ে উঠবে খালি চোখেও। মহাজাগতিক পরিবেশ স্বাভাবিক থাকলে, দূরতর ইউরেনাসও দেখা দেবে সবুজরঙা এক আলোকবিন্দু রূপে।
কৌতুহলী দর্শকের জন্য নীচে রইল নবাগত বছরটির কিছু চোখ-জুড়ানো, চোখ-ধাঁধানো মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের তালিকাঃ
১) ২৪ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল- এই সময়কালে পড়শী গ্রহ শুক্র, মঙ্গল ও শনির যেন এক রাজকীয় উদযাপন চলবে আকাশজুড়ে। উত্তর-দক্ষিণ উভয় গোলার্ধ জুড়েই সে সমারোহ দৃষ্টিগোচর হবে, কাক-ডাকা ভোরে যাঁরা শয্যাত্যাগ করেন সেই সমস্ত মানুষের কাছে। সূর্যোদয়ের ঘণ্টাখানেক আগে দক্ষিণ-পূর্ব দিগন্তের নিম্নভাগে এই তিন গ্রহকে দেখা যাবে এক ত্রিভুজাকার অন্তরঙ্গতায়। মার্চের ২৭ ও ২৮ তারিখ কাস্তেরূপী চাঁদও সামিল হবে তাদের আড্ডায়।
এক সকাল থেকে পরবর্তী সকাল পর্যন্ত ঠায় চোখ রাখলে গ্রহদের স্থানান্তরণও দৃশ্যমান হয়ে উঠবে অন্তরীক্ষে। ত্রিভুজের কোণগুলি ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকবে এপ্রিলের পয়লা দিনটি পর্যন্ত, তারপর পাশাপাশি আসতে আসতে তিন থেকে পাঁচ তারিখের মধ্যে শুক্র-শনি-মঙ্গল এই ত্রিমূর্তিকে দেখা যাবে সরলরেখায়। শনি-মঙ্গলের মাখামাখি ঘনিষ্ঠতাটা তুঙ্গে উঠবে চার তারিখ, দুয়ের মাঝে থাকবে কেবল পূর্ণচাঁদের প্রস্থবিশিষ্ট এক বক্ররেখার দূরত্ব।
২) ৩০ এপ্রিল- আংশিক সূর্যগ্রহণ। দু'খানি আংশিক সূর্যগ্রহণ পরিলক্ষিত হবে ২০২২ এ, চাঁদের আড়ালে ঢেকে যাবে সূর্যের অংশ বিশেষ। প্রথমটি দেখা যাবে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণভাগে,আন্টার্কটিকার কিছু জায়গায়, প্রশান্ত ও দক্ষিণ মহাসাগরের কোনও কোনও অংশে। পৃথিবী আর সূর্যের মধ্য দিয়ে পার হবে চাঁদ, রাত ৮টা বেজে ৪১ মিনিটে সূর্যগোলকের ৬৪% চাঁদের আড়ালে ঢেকে গিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছবে এই গ্রহণ। আন্টার্কটিক উপদ্বীপের পশ্চিম কূলে দক্ষিণ মহাসাগরের ওপর থেকে এ গ্রহণের দৃশ্যমানতা হবে সর্বাধিক। তবে চিলি ও আর্জেন্টিনার সুদূর দক্ষিণের গ্রহণ-শিকারীরা মোটামুটি ৬০% চন্দ্রাবৃত রূপ দেখতে পাবেন সূর্যের।
গ্রহণ-লাগা সূর্যকে আপাতদৃষ্টিতে খানিক অনুজ্জ্বল মনে হলেও, খালি চোখে এই আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখলে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চোখ। অতএব এপ্রিলের ৩০ তারিখ যাঁরা গ্রহণ দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁরা অবশ্যই চোখ ঢেকে নেবেন নিরাপদ চশমায়, সে চশমা যেন তৈরি হয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে।
৩) ৩০ এপ্রিল থেকে ১ মে- এপ্রিলের শেষ দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিগন্তে মাথা তুলতে থাকবে বৃহস্পতি, তার সবটুকু চাকচিক্য নিয়ে। পর্যবেক্ষকরা প্রতিদিন উষার প্রাক্কালে দেখতে পাবেন তাকে। বৃহদাকার বৃহস্পতি প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যাবে অত্যুজ্জ্বল শুক্রের দিকে। ৩০ এপ্রিল ভোরের আলো ফোটার আগেই এত কাছাকাছি পৌঁছবে তারা পরস্পরের, যেন দু'টি গ্রহে মিলে এক হয়ে গেছে। নানারকম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যাঁরা এই মহাজাগতিক মিলনের সাক্ষী থাকবেন, উত্তর দিগন্তে দৃশ্যমান মঙ্গল ও শনিকেও তাঁরা পেয়ে যাবেন ফাউ হিসেবে।
সুবিধাজনক একটা পর্যবেক্ষণ স্থল বেছে নেবেন, দৃষ্টি হবে সুদূরপ্রসারী, কোথাও ধাক্কা খাবে না, কোনও বাধা পাবে না। সময় নির্বাচনটি এক্কেবারে সঠিক হলে তবেই এ বিস্ময়কর অপার্থিব দৃশ্য ধরা দেবে চোখে। সূর্যোদয়ের পর আলোয় ভেসে যাওয়া দিগন্তে নয়, এ দৃশ্য পরিপূর্ণ ভাবে ধরা দেবে প্রাক-সূর্যোদয় মুহূর্তে। অপেক্ষা শুরু হবে সূর্য ওঠার স্থানীয় সময়ের অন্তত আধঘণ্টা আগে থেকে।
৪) ৫, ৬ মে- উল্কাপাত দেখতে ভালোবাসেন? আপনাদের জন্য সুখবর আছে মে মাসের শুরুতে। এটা অ্যাকোয়ারিডজ উল্কাপাতের তুঙ্গমুহূর্ত তৈরি হবে এ সময়ে। এটা অ্যাকোয়ারিডজ হ্যালির ধূমকেতুর বর্জ্য দিয়ে তৈরি। মে মাসের পঞ্চম দিনে উষার উন্মেষের আগে এ উল্কাপাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্তটি দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। আগের রাতের কাস্তে- চাঁদটি চরাচরে মিলাবে সময়ের আগেই, মহাকাশের নিশ্ছিদ্র আঁধারে তাই উল্কাপাতের সবচেয়ে অনুজ্জ্বল মুহূর্তটিও দৃষ্টি এড়াবে না।
এই উল্কাপাতের উৎসস্থল দক্ষিণ দিগন্তে। দক্ষিণ গোলার্ধের পর্যবেক্ষকরা, অতএব, খানিক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন বলেই মনে হয়। আকাশ ঝকঝকে নির্মেঘ থাকলে তাঁরা ঘণ্টায় অন্তত ২০ থেকে ৩০টা উল্কাপাত প্রত্যক্ষ করতে পারবেন, উত্তর গোলার্ধের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা নেমে আসবে ১০ থেকে ২০টায়।
৫) ১৫, ১৬ মে- পৃথিবীর আড়ালে চাঁদ ঢেকে যায় যখন, রজতাভ শশধর হয়ে ওঠে তমসাচ্ছন্ন কিম্বা রক্তাভ, সে হল চন্দ্রগ্রহণ। ২০২২-এ মোট দুখানি পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ হবে, প্রথমটি হবে মে-র ১৫ ও ১৬ তারিখে, তারিখটি নির্ভর করবে আপনার স্থানিক অবস্থানের ওপর, দেখা যাবে দুই আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার কোনও কোনও জায়গা থেকে।
উত্তর আমেরিকার পূর্বভাগ এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অধিবাসীরা শুরু থেকে শেষ পুরোটা দেখতে পাবেন এ গ্রহণের। ১৫ তারিখে রাত ৯টা ৩২ নাগাদ শুরু হয়ে ১৬ তারিখ ১২টা ১১ মিনিটে তীব্রতম ও নাটকীয়তম লাল রঙটি ধারণ করবে সেদিনের গ্রহণোন্মুখ চাঁদ।
মে মাস উত্তর গোলার্ধে ফুল ফোটার মরসুম। মে মাসের পূর্ণচাঁদ তাই কুসুম-চাঁদ বা ফ্লাওয়ার মুন নামে খ্যাত। আগামী মে-র এই চন্দ্রগ্রহণটিকে ফ্লাওয়ার মুন এক্লিপ্স বা কুসুমচন্দ্রগ্রহণ নামে ডাকা হচ্ছে এখন থেকেই।
৬) ১৮ থেকে ২৭ জুন- এ ক'দিন প্রত্যুষের প্রাক্কালে শয্যাত্যাগ করলে মহাকাশ-দ্রষ্টারা দেখতে পাবেন এক অসামান্য মহাজাগতিক দৃশ্য। মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি এই পাঁচ গ্রহ এবং নির্মেঘ আকাশ থাকলে ইউরেনাসকেও দেখা যাবে খালি চোখেই। সোনায় সোহাগার মতো আদুরে চাঁদটিও এই সময়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসবে প্রত্যেকটি গ্রহকে। ২৪-২৫ নাগাদ অর্ধশশী তুষার-গ্রহ ইউরেনাসের কাছাকাছি গিয়ে আলোকিত করবে তাকেও। দূরবীন দিয়ে ইউরেনাস-নামক সবুজ বিন্দুটি দেখতে ভুলবেন না! রুপসী শুক্রের সঙ্গে চাঁদের মোলাকাত ২৬-এ, ২৭-এ বুধের পালা।
৭) ২৫ অক্টোবর - ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এবং পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও গ্রিনল্যান্ডের জায়গায় জায়গায় এদিন আংশিক সূর্যগ্রহণ প্রতিভাত হবে। ইউরেশিয়ার স্থানবিশেষে ভাগ্যবান দর্শকরা সূর্যের প্রায় ৮৬% অবধি ঢাকা পড়ে যেতে দেখতে পাবেন চাঁদের আড়ালে। সকাল ৮টা ৫৮ থেকে প্রবল প্রতাপান্বিত দিবাকরকে ঢেকে দিতে শুরু করবে চাঁদের সিল্যুয়েট, বেলা ১১টার মধ্যে ঢাকা পড়বে বেশিরভাগ অংশটাই। এই সময়কালটিকে ইউ.টি.সি. অর্থাৎ ইউনিভার্সাল টাইম কো-অর্ডিনেটডের হিসেবে ধরতে হবে। আমেরিকায় এই আংশিক সূর্যগ্রহণ ঘটবে রাতে। অতলান্তিকের পশ্চিম ভূখণ্ডের বাসিন্দারা ২০২৩ এর ১৪ অক্টোবরের আগে আর সূর্যগ্রহণ প্রত্যক্ষ করতে পারবেন না। সেটি হবে বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ, আগুনের একটি বৃত্ত প্রতিভাত হবে মহাকাশে সেদিন।
৮) ৭, ৮ নভেম্বর- মহাজাগতিক ঘটনাবহুল এ বছরের দ্বিতীয় পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণটি দৃশ্যমান হবে দুই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ায় এবং ইউরোপের স্থানবিশেষে। আবার চাঁদ হয়ে উঠবে টকটকে লাল। ৮ তারিখ রাত ৩টে ০৩ থেকে আঁধারে আচ্ছন্ন হতে শুরু করবে চাঁদ, ৩টে ৪১ মিনিটে আঁধার কাটিয়ে আলোয় ফিরবে আবার।
এই চন্দ্রগ্রহণটির সঙ্গে সঙ্গেই এ বছরের মতো পরিসমাপ্তি ঘটবে অপূর্ব সব মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের।