logo

সুনীলদার ধর্ম ভালবাসা, ভালবাসাও তো অসুখ

  • September 9th, 2022
Arts and Literature

সুনীলদার ধর্ম ভালবাসা, ভালবাসাও তো অসুখ

নীলার্ণব চক্রবর্তী

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবরটা আমি পেয়েছিলাম হিমাচলের পাহাড়ের কোলে, একটি হোটেলে। জায়গাটির নাম রিওয়ালসর। সেখানে গিয়েছিলাম আমরা, বিয়ের ঠিক এক বছরের মধ্যে, দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমায়। হিমাচলের শহর মান্ডি, সেখান থেকে রিওয়ালসর কিছু দূরে। আমাদের হোটেলটি হল বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান প্রচারক পদ্মসম্ভবের দৈত্যাকার মূর্তিকে পাশ কাটিয়ে চড়াইয়ে উঠে গিয়ে। নীচে লেক, রিওয়ালসরের বিখ্যাত বিশাল হ্রদ। যে হ্রদে মাছ পোষা হয়, মারা-ধরা মানা। কী সব সাইজ সেগুলির। কুমিরাকৃতি বললে বাড়িয়ে বলা হয় অবশ্য। কুমিরশিশুর ন্যায় বললে কাছাকাছি হয়। আপনি মাছেদের খাবার দিতেই চাইবেন, তাদের আকৃতি আরও বৃদ্ধির সুযোগটা আপনি ছাড়বেন বা কেন! মাছগুলি আপনার ছোড়া বিস্কুট-বাদাম গবগবিয়ে খাচ্ছে দেখে দানব-নন্দন বা নন্দিনীদের খাওয়ানোর তৃপ্তি পেলেও পেতে পারেন। আমি ভাবতেও পারিনি, রিওয়ালসর, যেখানে পদ্মসম্ভব কুয়াশার মধ্যে বসে রয়েছেন মূর্তি হয়ে, এমন অপরিসীম আরামের হোটেল, নতুন বিয়ের সুঘ্রাণ-মত্ত হৃদয়ে এমন একটা খবর পাব যে, সুনীলদা আমাদের মধ্যে আর নেই।

তা ছাড়া তখন দুর্গোৎসব। দিনটা মহানবমী, আগের রাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, পর দিন বেলাবেলি এসেছে আমার কাছে সেই মৃত্যু-ফোন।

হ্যাঁ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা সুনীল গাঙ্গুলি বা আমাদের সুনীল’দা, মারা গিয়েছেন এটা নির্ভেজাল সত্যি। যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, কেউ তো আর পৃথিবীতে থেকে যাওয়ার জন্য আসে না বাবা, শোক করিও না, এসব কথা আমার সামনে তখন ধুলোর ঝড় হয়ে রিওয়ালসরের আকাশে পলাতক। পুরো ভ্রমণ তখন টক। ভাল লাগছে না, কিছুই তো ভাল লাগছে না। আমি সাধারণত কারওর শেষযাত্রায় যাই না। সুনীল’দার শেষযাত্রায় হয়তো যেতাম, কিন্তু শেষমেশ না গেলে, নাহ, সেই শেষমেশ না যাওয়ার যে সম্ভাবনা, সেইটা তৈরি হওয়াটা সম্ভব ছিল না বলে স্বস্তি পেয়েছিলাম, অন্তত এই একটি স্বস্তি ছিল এই ভ্রমণ-অঞ্চলে বসে। পদ্মসম্ভবের দিকে তাকিয়ে দীর্ণ ধন্যবাদটাও জানিয়ে দিয়েছিলাম। সুনীল’দার শেষের পথে ভিড়টা দেখেছি অবশ্য পরে, প্লাবন দেখেছি।

সুনীলদার সঙ্গে আমার সখ্য যে সু-ঘন ছিল, তা বলা যাবে না। বরং যেমন আমার স্বভাব, তেমনই ছিল তা দূরে দূরে। তাঁর ফ্ল্যাটবাড়ি পারিজাত-এ গিয়ে আমি জাতে ওঠার চেষ্টা করেছিলাম। তরঙ্গের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম নানা সময়ে। রবিবার গিয়েছিলাম বহু বার। তখন বড় কাগজে আমার লেখা ছাপা হয়। একটা লেখার নাম ছিল-- কাট মুন্ডু কাট। শিরোশ্ছেদ নিয়ে লেখা। মনে আছে, সেই লেখা এবং লেখার নামটা-কে সুনীলদা সবার সামনে প্রশংসা করলেন। পারিজাতের রবিবারের সকালে সব ছুটকোছাটকা থেকে রথীমহারথী, সকলেই আসতেন। আমার যাওয়া বসা তাকানো শরীরের ছোট ছোট চলন শ্বাসের ওঠা-পড়া-- সবই মনে হত বিসদৃশ, অ-খাপ-জনক। প্রবল এক হীনভাব আমায় ঘিরে থাকত। কেউ তেমন কথাও বলত না। দু’-এক বার দু’-এক জন চেনা লেখক-কবি আমায় সেখান থেকে বারও করে দিয়েছে, সুনীলদা তখন হয়তো ভিতরের ঘরে, সেই সুযোগে, এক কোপে। একটা ভার, আমার মাথার উপরে, পায়ের পাতায় পাতায়। দু’ হাতে, নখে নখে জড়ানো থাকত। কিন্তু সেই দিন সুনীল’দার প্রশংসা, কিংবা তার পর, একদিন সুনীলদা বললেন, এবার একটা বই করো। তার পর, একটি বড় প্রকাশনে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন, চিঠিতে লিখলেন-- এ সময়ের প্রতিশ্রুতিমান…। আমার দ্বিধা আস্তে আস্তে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে কুচো কুচো। আমি একদিন তার পর অনেক ঝরঝরে হয়ে পারিজাতে গিয়ে পৌঁছেছিলাম, তার পর, বেশি যেতে পারিনি, কারণ পারিজাতে আর তাঁকে পাওয়া সম্ভব ছিল না, পারিজাত নামে ওই ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে সিঁড়ি টাঙিয়ে সুনীল গাঙ্গুলি আকাশে উঠে গিয়েছেন যে।

রবিবারের পারিজাতে যাওয়ার প্রবল মানসিক বিড়ম্বনার কারণে অন্য দিনও সুনীল’দার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, তবে কদাচিৎ। অনেক কথা বলতেন তখন। একদিন বলেছিলাম, সুনীলদা আমি কিছু কবিতা ইংরাজি থেকে বাংলা করব, আপনি একটু দেখে দেবেন? বলেছিলেন, ঠিক আছে তবে সময় লাগবে, তুমি সময় দিতে পারবে তো?

আমি ঘাড় বাঁকিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ--। সুনীলদা একটু হেসে উঠেছিলেন।

তাঁর কাগজ কৃত্তিবাসে আমি অনেক লিখেছি। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রসদনে সুনীলদা আসতেন, কৃত্তিবাস প্রকাশ হত। জীবনটা যেন ফুলের বাগান হয়ে যেত। বইমেলায় আসতেন ভিড়ে ভাসতে ভাসতে। দেখে ভাল লাগত, আমি যদি সুনীলদা হতে পারি কোনও দিন, হতে পারি না কি…। খ্যা-খ্যা একটা হাসি আমার পিঠে চাবুক চালাত এই শুনে। ভিতর থেকে সে বলত, গর্ধভ একটা। ’ক ’ লিখতে তো কলম বিলীন, তুই কি না হবি শক্তিসুনীল। এদিক ওদিক কোথাও দেখা হলে চোখে চোখ পড়লেই বলতেন সুনীল’দা, খবর কী তোমার? মাথা ঝাঁকিয়ে ভাল বললেও, আসলে সেটা পাকা অভিনয় আমার। তখন খবরের কাগজের অফিসে বসন মাজছি। মাজছি তো মাজছি, নামমাত্র মাইনে। খবর ভাল না ছাই, আমি কলকাতার তলায় থাকি।

নীরেন্দ্রনাথ চক্তবর্তী সুনীল’দার মৃত্যুর পর বলেছিলেন, সুনীলের ধর্ম ভালবাসা। ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু ভালবাসা অসুখও।

আপনি বুঝতে পারছিলেন যে, ফুলের বাগানে বেশ কয়েকটি মত্ত হস্তী ঢুকে গিয়েছে, কিন্তু কী বা করবেন, আপনার ধর্ম যে—ভালবাসা। একটা অসুখও। ভালবাসার অসুখ আপনার দু’চোখ বেঁধে রেখেছিল। তা বর্ধিষ্ণু বুমেরাং, বড় উৎপীড়নের, বুঝেও সারা জীবন ডেথসার্কেল থেকে বেরিয়ে আসতে আপনি পারেননি সুনীল'দা।

না, আমি সুনীল গাঙ্গুলি হতে পারিনি, লিখে খ্যাতি পাওয়ার মন্ত্রটা উচ্চারণ করতে গেলে আমার কোটি বার আটকিয়ে যায় জিভ। সব সময় ভেবে গিয়েছি এমন কিছু একটা করব, যা কি না বিশ্বের সুবাস ওড়া। কিন্তু খ্যাতি ও বিশ্বশৈলী-- দুটি ঘোড়াকে রথে বেঁধে রাখতে লাচার আমি। তার উপর শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়েছি-- হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরে কেঁদে ফেলি। কিছুই হল না, সেই সব-- এই সুর। ঘর অন্ধকার করে ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে, চাইকোভক্সি শুনতে শুনতে, গেলাস গেলাস জল খাই। সুরার সাধ্য আমার কই বলুন তো আপনার মতো।

এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনটিতে তাঁকে রীতিমাফিক স্বপ্নে দেখি। এ দিনও তেমন হয়েছে। দেখলাম, আমায় সুনীলদা কোলে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে উপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছেন, আবার লুফে নিচ্ছেন। চলছে এমন…। কিন্তু এক বার ছুঁড়ে দেওয়ার পর, আমি আকাশে, পিছন থেকে কে যেন সুনীল’দাকে টেনে নিয়ে চলে গেল চন্দনের বনে, আমি পড়ে যাচ্ছি, নীচে কোনও কোল নেই, পাথর… পড়ে যাচ্ছি, স্বপ্নটা ভেঙে গেল। আমিও একটুর জন্য ‘রাখে হরি মারে কে’-র প্রবচনে বেঁচে গেলাম। বেঁচে আছি। বাঁচতে চাই, সুনীল’দা…

5 comments

  1. অর্ণব, চমৎকার। বোধ এবং অনুভূতিতে জারিত এই স্মৃতিচারণ।

  2. ‘ডেথ সার্কেল’ ‘মত্ত হস্তীর বিচরণ’ ‘ ‘ভালবাসা অসুখও’ — ইত্যাদি শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে লেখক ব্যাজস্তুতি করেছেন, না ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ( তিক্ত ?) প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা পরিষ্কার হলো না। নাকি ‘ভালোবাসার অসুখ’ , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ট্র্যাজিডির হিরো বানিয়েছে ? সব কিছুকে পাশে রেখে, একটু দূর থেকে তাঁর সৃষ্টিতে অবগাহন করলে অনেক রত্ন খুঁজে পাওয়াও যায় বলে মনে হয়।

  3. মন ছুঁয়ে গেল। ওনাকে ঘিরে থাকা কয়েক জনের বর্তমান অবস্থান দেখে মনে হয় ভালবাসা বিতরণে এত উদার না হলেই হতো।

  4. শেষ অনুচ্ছেদটা মনে দাগ কেটে দিল। চমৎকার !

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *