logo

মহারাজ একী সাজ হে

  • October 12th, 2022
Suman Nama

মহারাজ একী সাজ হে

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আজ রাজা কাল সে ফকির এ গল্প আমরা জানি। তাই বলে এমন বাপি বাড়ি যা স্টাইলে মহারাজের সিংহাসনচ্যুতি ! হাতে পড়ে থাকল পেন্সিল। মানে সিএবি সভাপতির পদটুকু।সে তো মহাসমুদ্রে অবগাহন করতে করতে হঠাৎ পানা-পুকুরে সাঁতার কাটা।

আজকাল ইন্টারনেট খুললেই কেবল জ্যোতিষ আর জ্যোতিষ, আজ শনি বক্রী হবেন, কাল শুক্রদেব মিথুনে প্রবেশ করবেন, পরশু বৃহস্পতির কৃপায় মালামাল হয়ে যাবে বৃশ্চিক, মীন, ধনু, হনু রাশির জাতককুল, এমন ফালানা, ঠিকানা, ঢ্যামনা, আরও কত কি! মহারাজ ঈশ্বরভক্ত, পাড়ার পুজোয় ঢাক বাজান, গলায় ও বাহুবন্ধে মন্ত্রতন্ত্র জপা নানাবিধ হার, তাবিজ, মাদুলি ধারণ করেন। হয়ত তাঁর মহাকুন্ডলিতে লুকিয়ে থাকতে পারে এমন উল্কা পতনের প্রকৃত রহস্য।

এ শহরে হাতে গোনা কয়েকজন ক্রীড়া সাংবাদিক আছেন যাঁদের পকেটে সৌরভের হঠাৎ গন্ধহীন হওয়ার আসলি কিসসা অবশ্যই সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখা আছে। তাঁদের মহারাজানুগত্য এতটাই গভীর আর ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে বফর্স কামানের গোলার মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেও তাঁদের পেট থেকে টুঁ শব্দটি বের করে আনা সম্ভব হবেনা।সৌরভ যতদিন ক্রিকেট খেলেছেন, বিশেষ করে ভারতের হয়ে, ততদিন স্বজাতি ক্রিকেট লিখিয়েদের কাছে তাঁর অবস্থান ছিল ইংলন্ডের রাজ-রাজেশ্বরের সমগোত্রীয়, দ্য কিং ক্যান ডু নো রং, ডিড নো রং, উইল ডু নো রং।

মহারাজকে সর্বদা আড়াল করা সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্বের নির্মম দায়বদ্ধতা পদে পদে স্খলিত হলেও অন্য একটি কারণে সেই স্খলনকে অগ্রাহ্য করা হত।আইকন-হীন স্থবির বঙ্গসমাজে, বিশেষ করে বাচ্চাদের কাছে সৌরভ ছিল ধ্রুবতারা, তাকে দেখে কিছুটা সঙ্গত কারণেই আমরা বারেবারে আবেগে আন্দোলিত হতাম। লর্ডসের ড্রেসিং রুমের বারান্দায় ঘরের ছেলেকে আদুল গায়ে সুদর্শনচক্রের মতো জার্সি ঘোরাতে দেখে আমরা সেই অক্রিকেটোচিত স্পর্ধার কাছে নতমস্তক হয়েছি, তাকে উদ্বেলিত সোনার অক্ষরে বাঙালির ফিরে পাওয়া গৌরবের কেতন ওড়ানো বলে মনে করেছি। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন ওই বেহালার ছেলেটি, বারে বারে আমরা লিখেই গিয়েছি, লিখেই গিয়েছি, এমতো মূল্যায়ন যে অতিরঞ্জিত ও অতি-সরলিকৃত, এভাবে যে কাউকে সর্বকালের সেরা বলে দেগে দেওয়া যায়না, আমরা সে সব ভ্রুক্ষেপও করিনি। আমাদের ভাই ওই এক পিস কোহিনূরই আছে, যেভাবে যখন ইচ্ছে করবে মাথায় করে রাখব। সৌরভ মাঠ থেকে অবসর নিয়েছে তাও অনেক বছর হয়ে গেল, প্রজাদের রাজভক্তি এক ছটাকও টলে যায়নি, বেহদ্দ চামচাগিরির সেই ট্র্যাডিশন এখনও সমানে, সম পরিমানেই চলছে।

স্তাবকের কাজ স্তাবক করিবে, তাতে আমাদের কর্ণপাত অথবা দৃষ্টিপাত নিষ্প্রয়োজন।এ সবের বাইরে আরও একটি প্রশ্ন আছে যা গুরুত্ব পাওয়া উচিত অথচ পায়না। সৌরভের উত্থান-পতন, গমন-নির্গমন, যাই ঘটুক না কেন, তার সঙ্গে কান টানতে মাথা আসার মতো অনিবার্যভাবে রাজনীতি যুক্ত হয়ে যায় কেন? কই শচিন,রাহুল,কপিল,গাভাসকার, এদের কারও ক্ষেত্রেতো এমনটি হয়না? রাষ্ট্রপতির মনোনীত প্রার্থী করে কংগ্রেস একদা শচীনকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল। দৃশ্যতই শচীন এই অযাচিত স্বীকৃতি উপভোগ করেননি, বুড়ি ছোঁয়ার মতো করে সংসদে হাজির হয়েছেন, তাঁর নীরব প্রস্থান তেমনভাবে কারও নজরেও আসেনি। সৌরভের ক্ষেত্রে বারেবারে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় কেন? যেমন এখন শুরু হয়েছে সৌরভকে মাঝখানে রেখে তৃণমূল আর বিজেপির ক্লান্তিকর চাপান উতোর।

শচীন, রাহুলের মতো সৌরভও কোনও দলে নাম লেখাননি, কিন্তু দলের বাইরে থেকেও তিনি আলবাৎ ‘রাজনীতি’ করেন, করে চলেছেন অনেক দিন ধরেই। কেউ নিজের অরাজনৈতিক সত্ত্বাটি সত্যিই অমলিন রাখতে চাইলে তিনি তাঁর জীবনচর্যা দিয়েই তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, কোনও রাজনৈতিক দল কখনও তাঁকে বিরক্ত করবেনা, চেষ্টা করলেও গোপনে রণেভঙ্গ দেবে। কিন্তু কেউ যদি পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ নিয়ে রাজনীতির অলিন্দের মহারথীদের সঙ্গসুখ বারেবারে উপভোগ করতে চান, সেই সুবাদে নিজের অভীষ্ট পূরণ করেন, তাঁকে নিয়ে রাজনৈতিক চর্চা হবেই। সৌরভকে নিয়ে এই চর্চা সাম্প্রতিক অতীতে বারেবারে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। গাছের খাব আবার তলারও কুড়োব নীতি নিয়ে কিছুটা পথ অবশ্যই চলা যায়, বরাবর যায়না, যেতে পারেনা। একটা বিন্দু অবশ্যই আসবে যখন দাতা আর গ্রহিতার চালাকি সহ্য করবেনা। সৌরভের ঠিক সেটাই হয়েছে।

বামফ্রন্ট জমানায় দু’একজন মাঝারি মাপের সিপিএম নেতার সঙ্গে সৌরভের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, তার বেশি কিছু নয়। সিপিএম মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য সময় সময় এমন আদেখলাপনা দেখাতেন মনে হোত সৌরভের হাতের ব্যাগটি নিজের হাতে তুলে নিতে পারলে তিনি ধন্য হয়ে যাবেন। সৌরভ তখন পুরোদস্তুর ক্রিকেটে মজে, রাজনীতি তখন তার কাছে গ্রেগ চ্যাপেলকে কীভাবে তাড়ানো যায় সেই ছকটুকু তৈরি করা ব্যতীত আর কিছুই নয়।

লক্ষণীয় পরিবর্তনটি এল নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে। দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী সৌরভকে তাঁর মন্ত্রিসভায় ক্রীড়া মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানান, দামোদর শেঠ সহজবোধ্য কারণেই এত অল্পেতে খুশি হননি। এইখানেই যদি সৌরভ যতি টানতে পারতেন, অর্থাৎ বুঝিয়ে দিতেন তিনি মাঠের লোক মাঠেই থাকতে চান, তাহলে আজ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতনা। হয়ত এখনই তার ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতি হওয়া হতনা, তবে অবাঞ্ছিত বিতর্ক এড়ানো যেত।

লোভ সংবরণ অথবা সংযম যাই বলুন এমতো অগ্নি-পরীক্ষায় সৌরভ সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলেন। বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত মাখামাখি অব্যাহত থাকল, তাঁদের সামনে তিনি গাজরটি ঝুলিয়ে রেখে দিলেন। গত বিধানসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রীর ব্রিগেডের জনসভায় মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে সৌরভকেও দেখা যাবে বলে জোর প্রচার হয়েছিল। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিজেপির নেতারা মরীয়া চেষ্টা চালিয়েছিলেন, সৌরভ পাঁকাল মাছের মতো ঠিক ছিটকে গেলেন। কিছুদিন আগে সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ রক্ষা করে অমিত শাহ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন মহারাজকে পাওয়ার আশা তাঁরা তখনও ছাড়েননি।

সৌরভ প্রথমবার বিসিসিআই সভাপতি হয়েছিলেন যখন তখন অচিরে সেতুবন্ধন হওয়ার আশা উজ্জ্বল ছিল, সৌরভই তা প্রচ্ছন্নভাবে জীইয়ে রেখেছিলেন। একবার হলেও হতে পারে, বারবার ঘুঘু ধান খেয়ে যাবে তা কী হয়? শুধু নেব, বিনিময়ে সুরভিত হাসি ছাড়া কিছুই দেবনা এমন অঙ্ক কি মেলানো যায়? ব্যবসায়ী বাড়ির ছেলে সৌরভ চন্ডী গঙ্গোপাধ্যায়ের বোঝা উচিত ছিল রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্টের ঘর শূন্য রয়ে গেলে মালিক একদিন মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেবেই।

19 comments

  1. দারুণ সত্যি লেখা !
    ‘কুমির তোর জলকে নেমেছি’….গোছের চালাকি দিয়ে — ‘ গাছেরও খাব, আবার তলারও কুড়োবো,’ সত্যিই বেশিদিন চলে না।
    তবে রাজ্যরাজনীতিতে মাননীয়া দিদি আবার সৌরভকে নিয়ে দাবার ঘুঁটি সাজাবেন কিনা সেটাই দেখার। সে দেখা যাবেখন। এখন তো সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নির্ভীক প্রতিবেদনের জন্য ওঁকে মস্ত একটা কুর্নিশ জানাই।🙋‍♀️

  2. আরও একটি পয়েন্ট – বিরাট কোহলির সাথেও যে ব্যবহার করে সরানো হয়েছিল সেটা বিরাট যে স্টেচারের প্লেয়ার তার হয়তো ওটা পাওনা ছিল না ! অনেক অনেক ডেলিকেটলী হ্যান্ডেল করা উচিত ছিল সে কোহলির এটিটিউড নিয়ে যাই বাজারি রিপোর্ট থাক না ক্যানো – সে এই মুহূর্তে দেশের যুবসমাজের সব থেকে বড়ো আইকন, বিশ্বসেরা প্লেয়ারও বটে ! ক্যাপ্টেন হিসাবে অসফল তাও চরম নিন্দুকও বলবে না .. তাই কালচক্র ঘোরে বা ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে ..

  3. অসাধারণ বিশ্লেষণ। আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না, এই মানসিকতা আজকের দেওয়ানেওয়া পাইপয়সা বুঝে নেওয়ার যুগে কতটা অচল, সৌরভের হঠাৎ পতন, চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিয়ে গেল।

  4. অনেকদিন পর আবার হাত খুলে লিখলে। অনেকটা একটা ওভারের ছটা বল সোজা গ্যালারিতে পাঠানোর মতই।

  5. আবারও একবার তোমার কলমে আঁকা ছবি হৃদয় স্পর্শ করে গেল। অদ্ভুত শক্তিশালী কলম ততোধিক সুন্দর মসৃণ ও যথাযথ বিশ্লেষণ। সৌরভ গাঙ্গুলি আমার অত্যন্ত পছন্দের ক্রিকেটার কিন্ত অতি চালাকির খেসারত দিতে হল তাঁকে। যদিও শোনা যাচ্ছে ICC Presidential election এ তিনিই হবেন ভারতের প্রার্থী। হলে খুশি হব, after all বাঙালী তো !

  6. দারুণ লিখেছেন। বাঙালি তো কাউকে ভগবান বানানোয় ওস্তাদ।

  7. আবারও একবার তোমার কলমে আঁকা ছবি হৃদয় স্পর্শ করে গেল। অদ্ভুত শক্তিশালী কলম ততোধিক সুন্দর মসৃণ ও যথাযথ বিশ্লেষণ। সৌরভ গাঙ্গুলি আমার অত্যন্ত পছন্দের ক্রিকেটার কিন্ত অতি চালাকির খেসারত দিতে হল তাঁকে। যদিও শোনা যাচ্ছে ICC Presidential election এ তিনিই হবেন ভারতের প্রার্থী। হলে খুশি হব, after all বাঙালী তো !

  8. অনবদ্য….
    শুভ বিজয়াদশমীর প্রণাম দাদা।🙏🏻

  9. এটাতো ডালমিয়া আমল থেকে সুরু তখন তিনি privileged class, বাম আমল নিয়ে তো লিখেছেন,ভুল না করলে academy টা বোধহয় সেই সময়ের, পরবর্তীতে সরকারি দপ্তরে গিয়ে CAB র শীর্ষে এরপর তো সবার জানা।

  10. অসাধারণ বিশ্লেষণ।সত্যিই হয়ত তিনি ক্ষমতা উপভোগ করতে চেয়েছিলেন!তবে বিনা স্বার্থে তাঁকে রাখা হবে কেন?এই ঘটনা নিয়ে আবার বঙ্গ রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠল।

  11. এটা একটি ‘বাপি বাড়ি যা’ মার্কা লেখা। দারুণ!

  12. এমন নির্মোহ নিরপেক্ষ বিশ্লষনের জন‍্যই আপনার লেখা সেই আটের দশকের শুরু থেকেই যখন যেখানে লিখেছেন বা যে চ‍্যানেলে বলেছেন সেখানেই আপনাকে খুঁজে নিয়েছি। আপনার অবর্তমানে ঘাড়নাড়া হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ করা সাংবাদিকতা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেশুনে ক্লান্ত।

  13. constructive criticism is most welcome but do not criticize for the sake of criticize. Absolutely baseless write up which clearly indicates your personal frustration.

  14. One of your best pieces so far. Very unpleasant truths about the person but Truth all the same, told boldly without mincing words. Such write-ups are a rarity in the quagmire of chamchabaji journalism media have bogged down into today. Keep it up Suman. Try to extricate value journalism from that morass. My best regards.

  15. One of your best pieces so far. Very unpleasant truths about the person but Truth all the same, told boldly without mincing words. Such write-ups are a rarity in the quagmire of chamchabaji journalism media have bogged down into these days. Keep it up and try to extricate value journalism from that morass . Best regards.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *