logo

প্রিয় সখা হে, ছেড়ে গেলে…

  • August 12th, 2022
Reminiscence, Suman Nama

প্রিয় সখা হে, ছেড়ে গেলে…

প্রিয় সখা হে, ছেড়ে গেলে…

সুমন চট্টোপাধ্যায়

‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি, গানের সুরে৷’

গানটা বড়ই প্রিয় ছিল প্রিয়’দার৷ মাঝে মাঝেই গুন গুন করে গেয়ে উঠত নিজের মনে৷ বেশ সুরেই বসত ওঁর গলা৷

আদতে সেটা কি আর হল প্রিয়’দা? টানা ন’টা বছর চেতনাহীন হয়ে মরণের পারেই তো শুয়ে রইলে৷ হাসপাতালের বিছানায়৷ কত গান তো হল গাওয়া, কই একটিবারের জন্যও জাগলে না তো? কোন হা-হা রবে ন’বছর আগে একদিন সেই যে তার ছিঁড়ে গেল, কই হাজার চেষ্টা করেও কেউ তো তা জুড়ে দিতে পারল না?

ভাগ্যিস মরণের ওপারে শেষমেশ চলেই গেলে তুমি৷ আর গেলে বলেই না বিস্মরণের অতল গহ্বর থেকে ভেসে উঠে অন্তত দু’টি দিনের জন্য তুমি ফের কফিন-বন্দি থেকেও জীবন্ত হয়ে উঠলে! দ্যাখো দ্যাখো প্রিয়দা, টেলিভিশনে তুমি আবার হেড-লাইন হয়ে উঠেছ, আবার তোমার ছবি দেখাচ্ছে ওরা৷ শত্রু-মিত্র সকলেই কাঁপা-কাঁপা গম্ভীর গলায় কেমন তোমার গদগদ প্রশংসাও করছে, শুনতে পাচ্ছ? খবরের মধ্যেই তুমি কাটিয়েছ সারাটা জীবন, বিদায়টাও হোক না খবরের মধ্যে দিয়েই!

পিছনে ফিরে এখন মনে হয়, তোমাকে এমন নিবিড় ভাবে না চিনলেও বোধহয় আমার চলত৷ স্বজন-বিয়োগের যন্ত্রণাটা সেক্ষেত্রে এত তীব্র হত না বোধহয়৷ শিক্ষানবিশির কালে যে ক’টি গুরুমন্ত্র আমাদের শেখানো হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল, সবার সঙ্গেই সাংবাদিকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে কিন্তু সে কারও বন্ধু হবে না৷ একমাত্র তোমার বেলাতেই এই গুরুবাক্য আমি শিরোধার্য করতে পারিনি প্রিয়দা, চেষ্টাও করিনি৷ তুমি আমার ‘সোর্স’ তো ছিলেই, বন্ধুও অবশ্যই৷ সব কিছুর ঊর্ধ্বে তুমিই তো ছিলে আমার আত্মার পরমাত্মীয়৷ রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে আমার বাবা লোকনাথ৷

লিখতে বসে তোমাকে সর্বদা রেয়াত করেছি তা নয়, বিলক্ষণ গাল-মন্দও করেছি৷ সম্পর্কে সাময়িক শীতলতা এসেছে তবু ভ্রাতৃত্বের মজবুত শিকল একেবারে আলগা হয়ে যেতে দিইনি দু’জনের কেউই৷ ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি বড় বাঁকে আমরা পরস্পরের পাশে থেকেছি, নির্ভর করেছি একে-অন্যের ওপর৷ সেখানে কোথায় তোমার রাজনীতি আর কোথায়ই বা আমার রিপোর্টারি? সব ধান্দার ঊর্ধ্বে ছিল আমাদের এই পারস্পরিক পক্ষপাত৷

নইলে কি তুমি দীপাকে বিয়ে করা ঠিক হবে কি না, সেই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়টি সংসারে এত লোক থাকতে আমার সঙ্গেই আলোচনা করতে? দিল্লির রাজপথে আমার ছোট্ট গাড়িতে চড়ে চক্কর কাটতে কাটতে সেদিন তোমার প্রেমের সব কথা আমার কাছে উজাড় করে দিয়েছিলে তুমি, আমি কেবল চুপটি করে শুনে গিয়েছিলাম৷ সব কথার শেষে আমি যখন বললাম, ‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া’, তোমার চোখে-মুখে যেন বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেল৷ কোথাকার কোন হরিদাস আমি, তবু আমার একটি ক্ষুদ্র সম্মতিকেই সেদিন খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছিলে৷ বিয়ের-বাসরে পাত্রের হয়ে সাক্ষ্যদানের অধিকারটা তুমি আমাকেই দিয়েছিলে সংসারে কোটি খানেক পরিচিত মানুষের মধ্যে৷

সরকারি সাম্রাজ্যে আত্মসম্মান বজায় রেখে কাজ করাটা যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে, প্রাত্যহিক অবজ্ঞা আর লাঞ্ছনায় জীবন দুর্বিষহ, আমিও চাকরি ছাড়ার আগে তোমারই শরণাগত হয়েছিলাম উচিত পরামর্শটুকুর জন্য৷ দারা-পুত্র-পরিবারও তখন আমার মনোবাঞ্ছার কথা জানে না৷ কংগ্রেসে বিদ্রোহ করে চরম খেসারত দেওয়ার অভিজ্ঞতা ততদিনে তোমাকে বেশ সতর্ক করে তুলেছে, প্রিয়জনের বিদ্রোহ বাসনায় তাই তুমি সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলে৷ প্রথমে নিষেধ, তারপরে হিসেব-নিকেশ করার পরামর্শ দিয়েছিলে বারবার৷ শেষ-তক যখন দেখলে ভবী ভুলবার নয়, পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলে, ‘অন্তরাত্মাকে জিজ্ঞেস কর, সে যা বলবে সেটাই করিস’৷ ‘দ্য এম্পায়ার স্ট্রাক ব্যাক’৷ সেখানেও ‘রিসিভিং এন্ড’-এ তোমার মতো আমিও৷ ভায়ে-ভায়ে কী আশ্চর্য মিল রে বাবা!

প্রিয়দা, তুমি থাকতে থাকতে প্রকাশ্যে আরও একটি সত্য কথা কবুল করা বড়ই জরুরি৷ পেশাগত জীবনে যে সাহায্য আমি তোমার কাছ থেকে পেয়েছি, দ্বিতীয় কোনও রাজনীতির কুশীলবের কাছ থেকে তা পাইনি, প্রবাসে রিপোর্টিং জীবনের প্রারম্ভে তা আমাকে অনেক দূর এগিয়েও দিয়েছিল৷ তুমি কংগ্রেসে ফিরে এসেছিলে ইন্দিরা গান্ধীর জীবদ্দশাতেই। কিন্তু রাজনীতিতে তোমার পুনরুত্থান হয়েছিল রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে৷ তোমার প্রতি একই মায়ের দুই সন্তানের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত-ধর্মী৷ সঞ্জয় তোমাকে পছন্দ করতেন না, তোমাকে সরিয়ে তিনিই অম্বিকা সোনিকে সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতির পদে বসিয়েছিলেন৷

অথচ সেই তুমিই ছিলে রাজীবের খুব কাছের মানুষ, একটা সময়ে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি৷ টানা কয়েক বছর রাজনৈতিক নির্বাসনে থাকার পরে ১৯৮৪-র লোকসভা ভোটে হাওড়া থেকে জিতে তুমি লোকসভায় গিয়েছিলে৷ রাজীব তোমাকে একাদিক্রমে বাণিজ্য রাষ্ট্রমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি করেছিলেন৷ তোমার হাত ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বলয়ে আমিও দিব্যি ঢুকে পড়েছিলাম৷ রাজীব সে সময় যতবার পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসেছেন, একমাত্র আমিই তাঁর সফর-সঙ্গী মনোনীত হয়েছি। রাজীব-সনিয়ার সঙ্গে একমাত্র আমিই ঘুরেছি বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামে৷ ঘুরেছি, রিপোর্ট করেছি, তার সুবাদে হাততালিও কুড়িয়েছি বিস্তর৷ জর্ডনের প্রয়াত রাজা রাজীবকে সে সময় একটি জঙ্গা উপহার দিয়েছিলেন৷ গাড়ি-পাগল প্রধানমন্ত্রী দেশের মধ্যে সড়ক পথে চললে নিজেই সেই গাড়ি ড্রাইভ করতেন পিলে চমকানো গতিতে৷ চালকের আসনে রাজীব, পাশে সনিয়া, পিছনের সিটে তুমি, কখনও সখনও আমি৷ একজন যুবা রিপোর্টারের জীবনে এর চেয়ে বড় স্বপ্ন-পূরণ আর কীই বা হতে পারে প্রিয়দা?

শুধুই কি সরকারি সফর? তোমার উদ্যোগে দিল্লিবাসী প্রেসিডেন্সি প্রাক্তনীরা তো ৭ নম্বর রেস কোর্স রোডের লনে বেশ ধুমধাম করে রবীন্দ্র-জয়ন্তীও পালন করেছিলাম৷ পঁচিশে বৈশাখের দিন তিনেক আগে হঠাৎ তোমার মনে হল রাজীব গান্ধীকে রবি ঠাকুরের গান শোনানো যেতে পারে৷ আমি কলেজের প্রাক্তনীদের জড়ো করলাম, আগের দিন তোমার ১৬ নম্বর জনপথের সরকারি বাংলোয় প্রবল উদ্যমে রিহার্সাল হল, পরের দিন খুব সকালে সবাই হাজির হলাম প্রধানমন্ত্রী নিবাসে৷ কোরাসে গলা মিলিয়েছিলে তুমিও৷ ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ…’৷

তুমি না থাকলে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে, এ জীবনে আমার কখনও প্রবেশাধিকার মিলত কি? আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান- ১৯৯৪ থেকে প্রতি চার বছর অন্তর টানা তিনটি বিশ্বকাপ আমি দেখতে পেরেছি তোমারি সৌজন্যে৷ দেখা মানে গ্যালারির যে সে জায়গায় বসে দেখা নয়, প্রতিটি মাঠের ভিভিআইপি বক্সে বিশ্ব-ফুটবল আর রাজনীতির মহারথীদের মাঝখানে বসে থাকা৷ লস অ্যাঞ্জেলেসের পাসাডেনায় রোজ বল স্টেডিয়ামে আমরা বসেছিলাম সোনার বিশ্বকাপটির এক হাত দূরত্বে৷ আমাদের পিছনের সারিতে ছিলেন সিনিয়র জর্জ বুশ, তাঁর স্ত্রী বার্বারা৷ ফ্রান্সের মার্সেইতে তদানীন্তন জার্মান চান্সেলর হেলমুট কোল তো বসেছিলেন আমাদের সামনেই৷ ক্রোয়েশিয়ার কাছে সেই ম্যাচে হেরে জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার পরে অমন দীর্ঘদেহী চান্সেলর বাচ্চাদের মতো কেমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন বলো তো! আর টোকিওয়? আমরা দু’জনে দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম দু’জনের সঙ্গে৷ তখন ফিফার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ব্লাটার আর কিংবদন্তী ইংরেজ ফুটবলার ববি চার্লটন৷

সেই যে রক্তে বিশ্বকাপের দোলা তুমি লাগিয়ে দিলে আমি বুঁদ হয়েই রয়ে গেলাম৷ তুমি হাসপাতালে শুয়ে থাকলে, আমি তবুও গেলাম ব্রাজিলে, সাম্বার দেশে৷ কম দামের টিকিটে গ্যালারির টঙে বসে খেলা দেখতে হল, দুঃখ সেখানে ছিল না৷ বিশ্বকাপ হচ্ছে, আমি আছি, তুমি নেই৷ ক্ষণে-ক্ষণেই মোচড় দিয়ে উঠছিল বুকের পাঁজরে৷ ভাসছিল পুরোনো সব বিশ্বকাপের স্মৃতি৷ বিশ্বাস করো, কোপাকাবানা সৈকতের বিকিনি-সুন্দরীদেরও কেমন যেন পানসে লাগছিল!

প্রিয়দা আজ সকালে কিছুক্ষণ তুমি থাকবে কলকাতায়৷ কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে যাব না৷ বলা ভালো তোমার মরা-মুখ আমি দেখতেই পারব না৷ নিজের মায়ের মরা-মুখও আমি দেখিনি, দাদারটাও না হয় না দেখাই থাক৷

আর যদি বলো, গানের সুরে জেগে উঠবে মরণ হতে… হা ঈশ্বর এমন একটি বর কি তুমি সত্যিই দিতে পারো না!

(দীর্ঘ ন’বছর হাসপাতালে কোমায় থাকার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। লেখাটি তার অব্যবহিত পরে)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *