logo

প্রিয় বন্ধুর বিষণ্ণমধুর স্মৃতি

  • January 12th, 2021
Reminiscence, Suman Nama

প্রিয় বন্ধুর বিষণ্ণমধুর স্মৃতি

প্রিয় বন্ধুর বিষণ্ণমধুর স্মৃতি

সুমন চট্টোপাধ্যায়

কী রে মামু, এটা কি ঠিক করলি? শেষ পর্যন্ত এমন ঘোর অসময়ে খবরের কাগজে তোর স্মৃতি রোমন্থন করতে হবে আমাকে? এমন একটা হৃদয়-বিদারক শাস্তি কি সত্যিই আমার প্রাপ্য ছিল? বুকে হাত দিয়ে বল তো, এটা কি বন্ধুর কাজ হল, মামু? তাও আবার তিন দশে তিরিশ বছরের পুরোনো বন্ধুর?

দিন-ক্ষণ আবছা হয়ে গিয়েছে, তবে বছরটা পরিষ্কার মনে আছে এখনও৷ ১৯৮৫৷ দিল্লির অশোক রোডে সিপিএমের সেন্ট্রাল কমিটির আপিসের বাইরে তোর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল৷ আমি তখন দিল্লিতে একেবারেই নবাগত, তুই পাক্কা দিল্লিওয়ালা৷ জাঠ আর পাঞ্জাবিদের দেশে ‘সেনগুপ্ত’ পদবী শুনে পরম আহ্লাদে নিজেই এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিয়েছিলাম৷ আমার মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে গুরুগম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছিলি, ‘আপনি নয় ভাই, তুমিই যথেষ্ট৷’

‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ হয়ে গেল শীতের বিকেল ফুরিয়ে যাওয়ার চেয়েও অল্প সময়ে৷ তার পর আমরা পরস্পরের ‘মামু’ হলাম৷ এখনও তাই আছি, সেটাই থাকব৷ টাইমস অব ইন্ডিয়া পরিবারের সদস্য হয়ে এসে প্রথম যখন শুনলাম সহকর্মীরা তোর নাম আর পদবীর আদ্যক্ষর মিলিয়ে তোকে ‘এএসজি’ বলে সম্বোধন করছে সেই হিন্দি গানের লাইনটা মনে পড়ে গিয়েছিল, ‘শালা ম্যায় তো সাহাব বন গয়া!’

তিরিশ-একত্রিশ বছর আগে তোর সঙ্গে প্রথম যখন সাক্ষাৎ হল তোর বয়সও তখন ওই তিরিশ-একত্রিশ৷ আমার বছর তিনেক কম৷ তুই তখন কাজ করিস বাম-ঘেঁষা পেট্রিয়ট কাগজের রাজনৈতিক ব্যুরোতে, আমি পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক বিক্রিত বাংলা দৈনিকে৷ তোর পোশাক-আশাক, মুখের রেখায় কপট গাম্ভীর্য, সিরিয়াস কথাবার্তা, গুরুগম্ভীর চালচলন, পকেটে চারমিনারের প্যাকেট দেখে প্রথম চোটে মনে হয়েছিল তুই নিশ্চয়ই ‘মাকু’, ‘পেট্রিয়টে’ কাজ করিস শুনে সন্দেহটা গাঢ়ই হয়েছিল৷ তার পরে যখন শুনলাম যৌবনটাকে স্বেচ্ছায় বয়ে যেতে দিচ্ছিস, বিয়ে-থা করিসনি, করার কথা ভাবছিসও না, বিভ্রম হয়েছিল তুই পার্টির হোল-টাইমারও হতে পারিস৷ অনেক দিন ধরে কাছ থেকে তোকে ভালো করে মাপার পরে বুঝতে পারলাম তুই মাকু-টাকু কিছু নোস, আমার মতোই আনখশির একজন ‘লিবারেল বুর্জোয়া’ আর সত্যান্বেষী পেশাদার সাংবাদিক৷

বড় জমাটি দিন ছিল সে সব, কি বল মামু? আমার তো মনে হয় আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে পরের দশ বছর, যে সময়টায় মামা-ভাগ্নে সেজে আমরা পরস্পরের সঙ্গে লেপটে থাকতাম, সেটাই ছিল ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে নাটকীয়, সবচেয়ে উত্তেজক, সবচেয়ে রোমহর্ষক দশক৷ ওই দশটি বছরের মধ্যে কতই না যুগান্তকারী কাণ্ডকারখানা আমরা একসঙ্গে চাক্ষুষ করেছিলাম বল তো? মাতামহের রেকর্ড ধূলিসাৎ করে দিয়ে রাজীব প্রধানমন্ত্রী হল আবার পাঁচ বছর পরে চলে যাওয়ার সময় কংগ্রেসকে এমন ভাবে শুইয়ে দিয়ে গেল যে দলটা আর তার পরে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেই পারল না৷ সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বর শেরওয়ানির পকেটে লুকিয়ে রেখে শুধু বফর্সকে ইস্যু করেই বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ক্ষমতা দখল করল, যাওয়ার আগে দেশজুড়ে লাগিয়ে দিয়ে গেল মণ্ডলের আগুন৷ জবাবে কমণ্ডল হাতে রথযাত্রা শুরু করলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়ে তার পরিসমাপ্তি হল বাবরি মসজিদ ধ্বংসলীলার মধ্যে দিয়ে৷ এল নরসিংহ রাজ, খতম হল লাইসেন্স-পার্মিট-কোটা রাজের৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হল গর্বাচেভের পেরেস্ত্রইকা-গ্লাসনস্ত, বার্লিনের প্রাচীর গেল গুঁড়িয়ে, বরবাদ হয়ে গেল সমাজবাদ৷ তোর মনে পড়ে গর্বাচভ বিরোধী অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার খবর যখন এল, আমরা দু’জনে দাঁড়িয়ে ছিলাম সিপিএম অফিসের বাইরের লনে। হরকিষেণ সিং সুরজিতের মুখটা কী রকম পানসে দেখাচ্ছিল বল তো? আর প্রকাশ কারাট তো কথাই বলল না, এমন দ্রুত পায়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল যে মনে হল বোধহয় তখনই বাথরুমে গিয়ে নিজেকে হাল্কা করতে হবে!

চাকরিতে আমি যেখানে ছিলাম, রইলাম সেখানেই। যদিও পরের পর অনেকগুলো প্রোমোশনও হয়েছিল৷ তুই চাকরি বদলালি বেশ কতকবার৷ পেট্রিয়ট ছেড়ে সানডে অবজার্ভারে গেলি, সানডে অবজার্ভার ছেড়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ায়, ফিরে এলি ফের সানডে অবজার্ভারে আবার চলে গেলি ইকনমিক টাইমসে৷ তার মানে দশ বছরে পাঁচটা চাকরি বদল৷ ইন্দিরা গান্ধী নিজের শাড়ি বদল করার মতো করে রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের বদল করতেন৷ তুই করতিস চাকরি৷

বিনোদ মেহতার পরে চন্দন’দা মানে চন্দন মিত্র নিয়েছিল সানডে অবজার্ভার সম্পাদনার দায়িত্ব৷ তুই ছিলি চিফ অব ব্যুরো৷ আমাদের কাগজ বের হত সপ্তাহে সাত দিন, তোদের মাত্র এক দিন৷ একবার ভেবে দ্যাখ দেখি, সে সময় অন্য কাগজে কাজ করেও গোপনে তোকে কত স্টোরি সরবরাহ করেছি? অনেক সময় তোদের প্রথম পৃষ্ঠার প্রায় সব ক’টি খবরই থাকত আমার দেওয়া৷ বিনিময়ে চা-সিগারেট আর মাঝে মধ্যে রাতের আড্ডায় দু’পাত্র পানীয় ছাড়া আর কিছুই তো খাওয়াসনি! আমিই বা বিনিময়ে কখনও কিছু ভুল করেও চেয়েছি কি? মামুর আদেশ, পালন তো করতেই হবে৷

আমি ছিলাম রিপোর্টার৷ তুই ছিলি সাংবাদিকতার নিজস্ব অভিধানে যাকে বলে ‘থটার’৷ একটা ভালো খবর পেলে আমার শরীরে রোমাঞ্চ হত, একটা এক্সক্লুসিভ বা স্কুপ জুটে গেলে তো সোনায় সোহাগা! তুই মামু, কোনও দিন তোকে খবরের সন্ধানে উডু উড়ু হতে দেখিনি৷ খবরের পিছনের খবরে তোর বরাবর উৎসাহ ছিল বেশি৷ আমরা ছিলাম ‘হোয়াট’-এর কারবারি৷ তুই ‘হাউ’-এর৷ কী হয়েছে সেটা জানার পরে কেন হয়েছে, কী ভাবে হয়েছে, কী তার ফলাফল হতে পারে তা নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামিয়ে, পাঁচ-সাতটা বিড়ি পুড়িয়ে তুই লিখতে বসতিস৷ পরের দিন কাগজে তোর লেখা কপিগুলো পড়ে বিশ্বাস কর মামু, আমার যে কী ঈর্ষা হতো! কেবলই মনে হতো, আমি কেন অরিন্দম সেনগুপ্তর মতো করে ভাবতে পারি না, বিশ্লেষণ করতে পারি না, গন্ধমাদন থেকে কেন এত সহজে বের করে আনতে পারি না বিশল্যকরণী?

যৌবনের গোড়ায় ক্ষণিকের খ্যাতির মোহে আমরা কে পড়িনি বল তো? বেশ বাই-লাইন বেরোবে, লোকে চিনবে, চিনে বাহবা দেবে, এটাকেই আমরা প্রাপ্তি হিসেবে দেখতাম৷ মামু, এখানেও তুই ছিলি ব্যতিক্রম৷ কাজের মাঠে স্ট্রাইকারের বদলে সুইপার ব্যাকের জায়গাটাই ছিল তোর পছন্দের৷ তুই সহকর্মীদের বল জোগাতিস, প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করতিস, তোর পিছনে গোলকিপার থাকত এক্কেবারে নিশ্চিন্ত৷ তোর ছিল মগজাস্ত্র, বরফের মতো ঠান্ডা মাথা, আর একটা মরমী মন৷ বিশ্বাস কর, এই পল্লবগ্রাহিতার চক্করে জীবনের পঁয়ত্রিশটি বসন্ত পার করে ফেললাম, তোর মতো একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক সম্পাদক আর দ্বিতীয়টি দেখিনি৷ যে পেশায় পারস্পরিক খামচা-খামচি আর সুযোগ পেলেই পিঠে ছুরি মারা দস্তুর সেখানে তুই এমন অজাতশত্রু হয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিলি কী করে বল তো? ব্যক্তিত্বের এই সম্মোহনী জাদুটা আমাকে একটু শিখিয়ে দিতে পারলি না?

বেশ কয়েক বছর আগে আমি ‘এই সময়’ সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েছিলাম প্রধানত তোরই সৌজন্যে৷ মাঝে কেটে গিয়েছে যোগাযোগহীন একটা দশক৷ দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের ডাইনিং রুমে ফের যখন দেখা হল তুই কিন্তু ‘মামু’ বলে ডাকতে ভুল করিসনি৷ কই আমারও তো একটিবারের জন্য মনে হয়নি এই অরিন্দম সেনগুপ্তকে আমি চিনি না? তিরিশ বছর আগে পেট্রিয়টের অখ্যাত রিপোর্টার হিসেবে যে ছেলেটিকে প্রথম চিনেছিলাম, টাইমস অব ইন্ডিয়ার কার্যনির্বাহী সম্পাদকের পদে বসেও তাকে তো একই রকম দেখেছি! মামু, শুনলে তুই হয়তো খিস্তি করতিস, কিন্তু সত্যি তো এটাই৷ পদ, প্রভাব, খ্যাতি, বিত্ত কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারেনি তোকে৷ জীবনের গূঢ় অর্থটা তুই বোধহয় আত্মস্থ করতে পেরেছিলিস আমাদের চেয়ে অনেক আগেই৷ ‘হেসে নাও দু’দিন বই তো নয়/ না জানি কখন সন্ধ্যা হয়৷’

ডেকে এনে এ ভাবে মাঝপথে আমাকে ফেলে রেখে কোনও কিছু না বলে তুই চলে গেলি? তাও আবার এত চকিতে? এই তো সেদিনই কলকাতায় সুমিতের স্মরণ-সভায় দেখা হল তোর সঙ্গে, হলের বাইরে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে সিগারেটও খেলাম৷ তুই-তো বলে গেলি, মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে জীবনটাকে উদ্‌যাপন করে যেতে৷ বলা সহজ মামু, পারা যায়?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন