logo

কবি হর কিসম কা

  • August 13th, 2022
Arts and Literature

কবি হর কিসম কা

সুমন চট্টোপাধ্যায়

সরকার বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে কবিদের অনেককেই আমার খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ইস্কুলে পড়ার সময়ে আমার এক মামাতো দাদা ধর্মতলার ম্যাগনোলিয়া রেস্তোঁরায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কবি তুষার রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। তখন কবি ফি-সকালে সেখানে আড্ডা মারতেন। চেলা-চামুন্ডাদের কাছে তুষার রায় তখন বেশ একটা কাল্ট ফিগার, ‘পুলিশ, কবিকে দেখলে তুই টুপিটা খুলিস’ তাঁর কবিতার এই একটি লাইন তখন কাব্য-রসিকদের মুখে মুখে ফেরে। ওই সাত সকালেই গঞ্জিকা সেবনে ব্যস্ত কবি সেদিন আমাকে পাত্তাই দেননি। নিকটাত্মীয় কবি বলতে আমরা একজনকেই বুঝতাম। কবিরুল ইসলাম। সিউড়িতে থাকতেন। যে কলেজে পড়েছেন, সেখানেই অধ্যাপনা করতেন। কলকাতায় এলে আমাদের বাড়ি তাঁর অবশ্য গন্তব্যের তালিকায় থাকত। যখন মর্জি চলে আসতেন, যতক্ষণ খুশি থাকতেন, তারপর এক সময়ে তস্করের মতো নিঃশব্দে কাউকে কিছু না বলে চলে যেতেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিরুলদার কবিতা প্রকাশিত হলে আমাদের বড্ড আনন্দ হত। মনে হত, বাড়ির একজনের নামই দেখছি ছাপার অক্ষরে। কবিরুলদা পারতপক্ষে দীর্ঘ কবিতা লিখতেন না। বড় জোর তিন-চারটি স্তবক। কী আশ্চর্য সেই কবিতা আমার মতো নিরেট মুখ্যুও বুঝতে পারত। বহুযুগ আগে পড়া তাঁর একটি কবিতার শিরোনাম আমার এখনও মনে আছে- ‘নীলিমাদির গান শুনে।’ 

আমার দেখা সবচেয়ে রঙিন, সবচেয়ে বর্ণময়, সম্ভবত সবচেয়ে প্রতিভাধর কবি অবশ্যই শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ছিল তাঁর কবিতার ঠিক বিপরীত। কাব্যে তিনি সুশৃঙ্খল, ছন্দবদ্ধ। ব্যক্তি-জীবনে স্বভাব স্বেচ্ছাচারী। জীবদ্দশাতেই ঋত্বিক ঘটকের মতো শক্তিও একজন ‘মিথ’ হয়ে উঠেছিলেন। নানা জনে নানা গল্প শোনান তাঁর বোহেমিয়ান জীবনচর্চা নিয়ে। যার কিছুটা সত্য, কিছুটা অর্ধসত্য, বেশিরভাগটাই অসত্য। আমার ঝুলিতেও এমন আঁখো দেখা কিসসা কিছু আছে। কিন্তু সে সবের অবতারণা এখানে নয়।

আমার দেখা সবচেয়ে রঙিন, সবচেয়ে বর্ণময়, সম্ভবত সবচেয়ে প্রতিভাধর কবি অবশ্যই শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ছিল তাঁর কবিতার ঠিক বিপরীত। কাব্যে তিনি সুশৃঙ্খল, ছন্দবদ্ধ। ব্যক্তি-জীবনে স্বভাব স্বেচ্ছাচারী। জীবদ্দশাতেই ঋত্বিক ঘটকের মতো শক্তিও একজন ‘মিথ’ হয়ে উঠেছিলেন। নানা জনে নানা গল্প শোনান তাঁর বোহেমিয়ান জীবনচর্চা নিয়ে। যার কিছুটা সত্য, কিছুটা অর্ধসত্য, বেশিরভাগটাই অসত্য। আমার ঝুলিতেও এমন আঁখো দেখা কিসসা কিছু আছে। কিন্তু সে সবের অবতারণা এখানে নয়।

তাঁর সম্পর্কে শক্তিদা এতটা বিদ্বিষ্ট কেন, আমি নীরেনবাবুকে এক-আধবার জিজ্ঞেসও করেছি। উনি কোনও উত্তর দেননি, মুচকি হসে প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছেন। সচরাচর কবির চরিত্র-লক্ষণ বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, কলকাতার যীশুর নির্মাতার মধ্যে তার একটিও ছিল না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন সাবধানী, সতর্ক, হিসেবি এবং পুরোদস্তুর কনফরমিস্ট। সুনীলদা আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মাঝেমাঝেই প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিতেন, একবার তো ‘ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি সরকারবাবুদের এমন তুলোধনা করেছিলেন যে সুনীল-পত্নী স্বামীকে আদেশ দিয়েছিলেন চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য। আর শক্তিদা? তাঁর চলন-বলন, কথায়-বার্তায় মনে হত নিজেকে ছাড়া আর কাউকে তিনি মালিক বলেই মনে করতেন না। সেখানে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আনুগত্য বা বশ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। এত প্রতিভাধর কবি তবু শেষ বিচারে ছা-পোষা গেরস্ত! নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন সহজিয়া কবি, তাঁর কবিতা শুধু সুবোধ্য নয় মনের আরামও বটে।

আমাদের প্রজন্মের সেরা কবি জয় গোস্বামীকেও দেখেছি, চিনেছি, খুব কাছ থেকে। এমনিতে তালপাতার সেপাই, ফুঁ দিলে মূর্ছা যাওয়ার সম্ভাবনা। তবু মৌচাকের মৌমাছিদের মতো মেয়েরা ভন ভন করে, এমনই আকর্ষণী ম্যাজিক তাঁর কবিতার। নারী-সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন অকুণ্ঠ, অকুতোভয়।স্বভাব ভীরু ও লাজুক জয় একেবারেই তা ছিলেননা। তাঁর সবটাই নিচুলয়ে, পারলে লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ আড়ালে। বরাবর পেট-রোগা, অতি-পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, গলা ভাত আর ডালের মন্ড ছিল ওর দুপুরের খাবার।

এই পলকা শরীরের অজুহাত দিয়েই জয় একবার একটি লোভনীয় অ্যাসাইনমেন্ট থেকে কেটে পড়তে চেয়েছিলেন। যবনের হাতে পড়েছিলেন বলে সফল হননি। তার আগে আনন্দবাজারের হয়ে দু’বার পূর্ণ-কুম্ভ কভার করেছিলেন সমরেশ বসু। এলাহাবাদের কুম্ভের কভারেজ ছিল সুপার হিট, হরিদ্বারেরটা ততটা নয়। আমি তখন আনন্দবাজারের বার্তা বিভাগের দায়িত্বে, হঠাৎ মাথায় এল জয় গোস্বামীকে এবার কুম্ভ কভার করতে পাঠালে কেমন হয়! জয় কাজ করতেন তিন তলায়, দেশ পত্রিকার দফতরে। আমরা ছিলাম চারতলায়, এক সহকর্মীকে ডেকে বললাম নীচ থেকে যে করে হোক জয়কে তুলে নিয়ে আয়। প্রয়োজন হলে দু’চারটে ঢপ দে, বল বিষয়টি এতই জরুরি যে এক্ষুনি ওপরে না গেলে চলবে না। 

জয় এলেন, তাঁকে দেখে আমার নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হল। উদভ্রান্ত, চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে আতঙ্কগ্রস্তও। পুলিশি কায়দায় এমনভাবে তাঁকে তুলে আনার মাথামুন্ডু কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও বেশ কয়েক মিনিট সময় লাগল। এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেয়ে, চেয়ারে বসে জয় ধাতস্থ হলেন। তারপর কবিবরের সঙ্গে এই নাছোড় অর্বাচীনের সংলাপটি হল এই রকম।
•    জয়, আপনাকে আনন্দবাজারের হয়ে একটা জরুরি কাজ করতে হবে। আপনি কিছুতেই ’না’ বলতে পারবেননা।
•    কী কাজ, কোনও লেখা-টেখা? কী বিষয়ে?
•    লেখা তো বটেই তবে ঘরে বসে লেখা নয়। মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়িয়ে লেখা।
•    তার মানে?
•    মানে আপনাকে এবার হরিদ্বারের কুম্ভ মেলা কভার করতে হবে আনন্দবাজারের জন্য। এটাই আমাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
জয়কে দেখে মনে হল, ও এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে। কোনও জবাব না দিয়ে কেবল ঝোলা দাড়িতে হাত বোলাতে লাগল, জোরে জোরে। নিষ্প্রভ, নির্বাক, প্রায় যেন ভূতগ্রস্ত। অবস্থা সামাল দিতে যতটা সম্ভব মোলায়েম সুরে বললাম, দেখুন আমরা তো মিলিটারি নই যে আদেশ এলে তা তামিল করতেই হবে। আপনার যদি অসুবিধে থাকে, খোলাখুলি বলুন না কেন।
বুঝলাম জয়ের ধড়ে প্রাণ ফিরে এসেছে। আনন্দবাজারের হয়ে কুম্ভমেলা কভার করতে পারাটা যে খুব সম্মানের কাজ, এইটুকু স্বীকার করেই জয় চলে এলেন তাঁর পরিচিত অস্ত্র প্রয়োগে।
•    আসলে কি জানেন, এই শরীরে এত ধকল আমার সইবে না।
•    কেন সইবে না? বরং বাইরে বের হলে দেখবেন মনটা ফুরফুরে লাগছে, শরীরটাও আর বেচাল লাগছে না।
•    আপনার কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়, তবু যদি আমাকে মার্জনা করেন ভাল হয়। সত্যি বলছি আমার শরীরটা খুবই কমজোরি।
•    দেখুন এত টাকা পয়সা খরচ করে কোম্পানি যখন আপনাকে পাঠাচ্ছে তখন আপনার সব দিকটাই খেয়াল রাখা হবে। ভালো হোটেলে থাকবেন, পছন্দসই খাবার খাবেন, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সঙ্গে গাড়ি থাকবে, দিল্লি থেকে আমাদের যে রিপোর্টার যাবে তাকেও বলা থাকবে সর্বক্ষণ আপনার দেখভাল করার জন্য। আর কী চাই।
•    সমস্যাটা খবার নিয়ে।
•    কী সমস্যা?
•    অনেক সমস্যা। গলা ভাতের সঙ্গে ডাল আর একটু সবজি মাখিয়ে কাবেরী খাবারটা তৈরি করে। বাড়িতে ছাড়া সেটা কী করে সম্ভব বলুন।
আমি বুঝতে পারছি, তেকাঠির ভিতর বল পাঠানো আর কঠিন কাজ হবে না। এ বার এমন চাল দেব কবি-বরের কিস্তিমাত হয়ে যাবে।
•    আচ্ছা আপনার কি মনে হয় চাল, ডাল, তরি তরকারি হরিদ্বারে পাওয়া যায় না?
•    তা নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু কাবেরীকে পাব কোথায়?
•    আপনার পাশে। যান সস্ত্রীক হরিদ্বারে গিয়ে পুণ্য অর্জন করে আসুন। কেবল হর কি পৌরীতে স্নান করতে নামবেন না। দারুণ স্রোত। কোনও ভাবে হাতের শেকল আলগা হয়ে গেলে বিপদ হতে পারে।
বেদনাক্লিষ্ট কবির মুখের উপর হঠাৎ যেন হাজার ওয়াটের আলো ফেলল কেউ। এই প্রথম এক গাল হাসি দেখলাম কবির। বিষণ্ণ-মধুর সেই হাসি কোনও দিন ভোলার নয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *