logo

‘সাথে’ নয় ‘সঙ্গে’

  • August 13th, 2022
Arts and Literature

‘সাথে’ নয় ‘সঙ্গে’

সুমন চট্টোপাধ্যায়

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মুখে আমি কখনও ‘কবিতা’ শব্দটি শুনেছি বলে মনে পড়ে না। সর্বদা বলতেন ‘পদ্য’। এই দু’য়ের মধ্যে বৈরিতা বা আত্মীয়তা কোথায়, দয়া করে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, আমি লজ্জায় পড়ে যাব। বাউন্ডুলে, বোহেমিয়ান, বাজারে যাচ্ছি বলে এক পোশাকে ডালটনগঞ্জ চলে যাওয়া, এমন নানাবিধ মুখরোচক গপ্পো শক্তিদা সম্পর্কে আছে, আরও বহুদিন থাকবে। কিন্তু ‘পদ্য’ লেখার প্রশ্নে এমন একজন মানুষই কতটা বিশুদ্ধবাদী ছিলেন তা নিয়ে বিশেষ একটা আলোচনা হয় কি?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন ছন্দ সম্পর্কে আতস কাচের মতো স্বচ্ছ ধারণা আর ছন্দের ওপর দখল হল কবিতা লেখার প্রথম ও প্রধান পূর্ব শর্ত। মৃত্যুর আগে শক্তিদা যখন বিশ্বভারতীতে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়াচ্ছেন, পদ্যে ছন্দের গুরুত্বের প্রসঙ্গ উঠত বারেবারে। তাঁর আক্ষেপ ছিল, কবিতা যারা লেখে তাদের বেশিরভাগের ছন্দ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাটুকুও নেই। ফলে তাঁরা কবি নন, ‘কাঁচকলা’।
আর একটি বাংলা শব্দ শুনলেই শক্তিদা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন, তর্ক করলে ঠাস করে একটা চড়ও হয়তো বসিয়ে দিতে পারতেন। সেই নিষিদ্ধ শব্দটি হল ‘সাথে’। কিছুতেই বলা চলবে না, বলতে হবে ‘সঙ্গে’। মজ্জাগত অভ্যেস ‘সাথে’ বলার, একদিন শক্তিদার সামনে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম। কানে যেতেই পদ্যকার ফোঁস করে উঠলেন, ‘হ্যাঁ রে, তোরা বাঙাল নাকি রে!’ বাঙাল তো বটেই, কট্টর ফরিদপুরিয়া গর্বিত বাঙাল। তাই বলে কি এ নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তক্কো করা যায়? আমি কি পাগল না তেলুগু দেশম?

বন্ধু সুনীলের সঙ্গে শক্তির আরও একটি চোখে পড়ার মতো চারিত্রিক বৈপরীত্য ছিল। সুনীলদা বরাবর স্বভাবে নরম-সরম, পরনিন্দা-পরচর্চার ধার ধারেন না, চট করে কাউকে মুখের ওপর ‘না’ বলতেও পারেন না। শক্তিদা ঠিক উল্টো, ঠোঁটকাটা, রুক্ষ, কারও মন জুগিয়ে চলার বান্দা নন। চাইলে শক্তিদার ভক্ত হতে পারো, তার জন্য কবি হতে হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই, পানীয়ের টেবিলে সঙ্গী হতে পার, খরচাটা দিয়ে দিতে পারলে আরও ভালো, পদ্যকার বেহেড মাতাল হয়ে গেলে ট্যাক্সিতে তুলে তাঁর বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারো, কিন্তু তাঁকে কিছুতেই নিজের ভবিষ্যতের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ‘পদ্য’ অপছন্দ হলে তিনি মুখের ওপর যা তা বলে দিতে পারেন, কাগজটিকে কুচিমুচি করে ছুড়েও ফেলে দিতে পারেন। কোনও অনুজের কবিতার জন্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় উমেদারি করছেন এমন ঘটনা কখনও আমার কানে আসেনি, যদি করে থাকেন ধরে নিতে হবে সেই পদ্যকারের প্রতিভা সম্পর্কে তিনি নিঃসংশয়।
সুনীলদার ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। তিনি মজলিসি আড্ডাবাজ মানুষ, বাড়ি এবং অফিস দু’জায়গাতেই ভক্ত আর সুযোগসন্ধানীরা তাঁকে ঘিরে থাকে, কবি, আধা-কবি, অ-কবি সবাই। অনুরোধ ফেলতে পারেন না, একটানা ঘ্যানঘ্যান করে যেতে পারলে দু-একটি কবিতা দেশ পত্রিকায় ছাপিয়েও দেন। নিজের মতো আগাপাশতলা সংশোধন করে। এমনও হয়েছে, কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরে সেই বিশ্ব-কবি মনে করতেই পারেননি, এটা তাঁরই লেখা কিনা!

অযোগ্যের পৃষ্ঠপোষণা শক্তি চট্টোপাধ্যায় একেবারে মেনে নিতে পারতেন না। একবার স্থির হল, অফিসে টেবিলের দু’প্রান্তে বসে শক্তি-সুনীল পছন্দের বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবেন, পরে সেটিই দেশে প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হবে। যতদূর মনে পড়ে, আলোচনায় সূত্রধরের ভূমিকাটি সম্ভবত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পালন করেছিলেন।
কথায় কথায় কতকটা অনিবার্য ভাবেই উঠে এল দেশ পত্রিকায় ছাপা হওয়া কবিতার প্রসঙ্গ। হঠাৎ রেগে গিয়ে শক্তিদা বলে উঠলেন, ‘তুমি বটকৃষ্ণ দে-র কবিতা ছাপ কেন? সে আবার কবে থেকে কবি হল?’ কিছুটা আমতা আমতা করেই সুনীল’দা জবাব দিলেন, ‘কী করব বলো, অনেক দিন ধরে লিখছেন, কবিতা দিলে ফেলে দিতে পারি না।’
চাপান-উতোর শক্তি-সুনীলের, সাতে পাঁচে না থেকে মুর্গি হলাম আমি। কেন না, বটকৃষ্ণদাকে আমি খুব ভালো ভাবে চিনতাম, নিয়মিত আমাদের গল্পসল্প হত। দিল্লিতে টেলিকম বিভাগে খুব উঁচু পদে কাজ করতেন, সাহিত্য রসিক ছিলেন, সাহিত্যের বাজারে কে কোথায় কী লিখছে খবরাখবর রাখতেন আর অপরাধের মধ্যে অপরাধ বছরে নিজে চার-পাঁচটি কাব্য রচনা করতেন। কেবল দেশ পত্রিকায় নয়, অন্যত্রও তা ছাপা হত। দিনের কাজ শেষ হওয়ার পরে কখনও-সখনও তিনি দিল্লির আই এ এন এস বিল্ডিংয়ে আনন্দবাজারের অফিসে ঢুঁ মারতেন। সুন্দর সৌম্য চেহারা, ধবধবে গায়ের রং, কন্ঠস্বরটিও বেশ পুরুষালি। আমি বটকৃষ্ণ দে মশাইকে বেশ পছন্দই করতাম।
শক্তি-সুনীলের ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পরে বটকৃষ্ণকে দূর থেকে দেখতে পেলেই আমি গা ঢাকা দিতাম। দু-তিনবার এ রকম করার পরে একদিন আমি হঠাৎ দৈববশে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তিনি আমার হাতটা ধরে বারান্দার এক কোনায় নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আরে, তুমি আমাকে এ ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো কেন? আমার কবিতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য তো শক্তি চট্টোপাধ্যায় করেছেন, সুমন চট্টোপাধ্যায় তো করেনি।’

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *