logo

পবিত্র সঙ্গীত

  • August 13th, 2022
Suman Nama

পবিত্র সঙ্গীত

সুমন চট্টোপাধ্যায়

শৃঙ্খলার সঙ্গে আমার আড়ি জন্মানো ইস্তক। বেহদ্দ, বেয়াদপ, বাউন্ডুলে পুত্রকে বাবা জীবনে শৃঙ্খলার আবশ্যিকতা নিয়ে অজস্রবার উপদেশ দিয়েছেন। কা কস্য পরিবেদনা।

এখন বেকার জীবনে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে আমি না চাইতেই। পারতপক্ষে আমি ফ্ল্যাটের চৌকাঠ পেরোই না, কারও বাড়ি যাই না, কেউ সে ভাবে ডাকেও না, সিনেমা- টিনেমা দেখতে যাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই নেই। রোজ রাতে দু’মুঠো গলাধঃকরণ করার পরে আমি কিছুক্ষণ নেটফ্লিক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করি, এই যেমন গত কয়েক রাতে মেক্সিকোর বিশ্বখ্যাত ড্রাগ লর্ড এল চ্যাপোকে নিয়ে সিরিজটা দেখলাম। গুলিগোলার আওয়াজ আমার গিন্নির বিলকুল না পসন্দ, আমার অবস্থান একেবারে বিপ্রতীপে। চাইলেও বেশিক্ষণ চোখের পাতা খোলা রাখতে পারি না, ঘুমের ওষুধ নিঃশব্দে আমায় ঘুমের দেশে নিয়ে যায়।

ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমোনো পর্যন্ত আমার জীবন এখন রুটিনের নিগড়ে বাঁধা। নির্ধারিত সময়ে প্রাতঃরাশ করি, দুপুর এবং রাতের খাওয়াও তাই। তিনবেলা নিয়ম করে মুঠো মুঠো ওষুধ খাই। খাওয়ার বাইরে বাকি সময়টায় আমার নিত্যসঙ্গী দু’জন, বই আর গান। মেজাজ শরিফ থাকলে মাঝেমাঝে দু’চার কলম লিখি, নেহাতই অনিয়মিত। মনে স্ফূর্তি না থাকলে আমার কলম চলে না, আর এখন এই বস্তুটিরই বড় আকাল।

হাতের কাছে যা পেলাম সেটাই পড়ে ফেললাম, আমি তেমনটা করি না। বিপুলা এ পৃথিবীর সামান্য কয়েকটি বিষয়ে আমার গভীর কৌতুহল আছে, আমি সেই বইগুলোই পড়ি। অনেক বই বাড়িতেই আছে, না থাকলে ও দামে পোষালে ফ্লিপকার্ট-অ্যামাজন তো আছেই। যেমন এই মুহূর্তে আমি সোনিয়া ফেলেরিওর বই ‘দ্য গুড গার্লস, অ্যান অর্ডিনারি কিলিং’ পড়ছি। কোনও ভারতীয়ের লেখা এমন অনবদ্য বই আমি সম্প্রতি পড়িনি। বইয়ের প্রচ্ছদে নোবেল প্রাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য আছে- দ্য গুড গার্লস লেফট মি শ্যাটারড। যে পড়বে তারই হুবহু এক অনুভূতি হওয়ার কথা।

আমার অবশ্য বইটি পড়ার জন্য নয় এমনিতেই জীবনটা শ্যাটার্ড হয়ে গিয়েছে। একমাত্র মলম যা আমার ক্ষতে দারুণ কাজ করে সেটা রবিবাবুর গান। প্রতিদিন একটি ঘণ্টা আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবই শুনব। কাম হেইল অর সানশাইন। অনেকে যেমন পুজোর ঘরে ইষ্ট দেবতার সামনে নিবিষ্ট হয়ে প্রার্থনা করে, সে রকম। রবীন্দ্রনাথ আমার ‘অকূলের কুল, অগতির গতি, অনাথের নাথ, পতিতের পতি।’

এখন ইউটিউবের বিশ্ব, যা খুঁজবেন পেয়ে যাবেন এই বিশ্বকোষে। এর ফলে ভারী সুবিধে হয়েছে গান শোনার, বিশেষ করে নতুন নতুন শিল্পীর। এই নতুন শিল্পীদের খুঁজে বের করা আমার বেশ প্রিয় খেলা, তাদের গান শুনে কখনও মোহিত হই, কখনও আবার বেশ হতাশ। মোটের ওপর অনেকটা যেন আবিষ্কারের আনন্দ অনুভব করি, নিজের কাছে নিজে।

এ ভাবে খুঁজতে খুঁজতে কাল হঠাৎ পবিত্র সরকারকে আবিষ্কার করলাম। পবিত্রবাবু ভালো গান করেন হাওয়ায় ভাসা সে খবর আমার জানা ছিল, নবনীতা দেবসেনের বাড়ির আড্ডায় তিনি কোরাসে গলা মেলাচ্ছেন এই ছবিও দেখেছি। তাই বলে এতটা ভালো? তাও জনতার সারণিতে বারেবারে লাঞ্ছিত হওয়া অতি পরিচিত সব গান নয়, রাগ ভিত্তিক রীতিমতো কঠিন গান। ভরাট গলা, স্পষ্ট উচ্চারণ, বাণীর স্পষ্ট বোধ, প্রায় নিখুঁত সুর। গোটা দশেক গানের সমাহার বোধহয়, প্রতিটিতেই পবিত্রতার ছোঁয়া। এত ভালো লাগল প্রতিটি গান দু’বার করে শুনলাম।

অপেশাদার শিল্পীদের দিয়ে গানের রেকর্ড করানোর ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি এই বাংলা বাজারে একটি সংস্থাই করে থাকে। ভাবনা রেকর্ডস। সংস্থার কর্ণধার শুভবাবু রবীন্দ্রগানের নিখাদ প্রেমিক, কত যে রেকর্ড বের করেছেন কে জানে। দুঁদে আমলা দীপক রুদ্রর গানের রেকর্ডও করেছিল ভাবনা। এমন দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই আরও আছে। না থাকলে ভবিষ্যতে তৈরি হবে। আপনারও যদি সুরেলা গলা থাকে, থাকে রবীন্দ্রবোধ তাহলে আপনিও কড়া নাড়তে পারেন ভাবনা রেকর্ডসের দরজায়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *