- August 17th, 2022
সামনে বুদ্ধদেব (পর্ব-২)
সুমন- এ বার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার মন্ত্রিসভার দু’জন মন্ত্রীর কথা। তাঁদের এক জনের কাজ ছিল, এই সব ব্যাপারে আপনার বিরোধিতা করা, তিনি কমল গুহ । আরএক জন, শৈলেন সরকার। আমি জানি না তিনি মন্ত্রী হবেন কি না। তিনি যে আছেন, সেটাই কোনও দিন টের পাইনি।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- (মৃদু হাসি) এ তো নির্মম সমালোচনা করছেন। দেখুন সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হয়। প্রত্যেকেরই কিছু গুণ থাকে, কিছু অসুবিধে থাকে। চেষ্টা করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এক সুরে কাজ করতে পারি, একই গতিতে কাজ করতে পারি।
সুমন- আপনি ক্ষমতায় আসার পরে বেশ কয়েকবার আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখেছি, আপনি যখনই কথা বলেন future tense এ কথা বলেন, অর্থাৎ করতে হবে, দেখতে হবে, বুঝতে হবে। এমন কোনও বিষয় আছে কি যেটা আপনি করে ফেলেছেন এবং যা নিয়ে আপনি পাস্ট টেনসে কথা বলতে পারেন?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- না, বিষয়টাকে এ ভাবে দেখা উচিত নয়। আপনি যদি বলেন আমি পরিতৃপ্ত কি না, খুশি কি না, আমি সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলতে পারব না। এটুকু বলতে পারব ধরুন কৃষির গতিটাকে রাখা গিয়েছে, শিল্পায়নের গতিটা বেড়েছে, বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু শিল্পে যা করার ছিল তা আমি করে ফেলেছি এ কথা বলতে পারব না। কেন না এখনও অনেক ইনভেস্টরের কাছে আমরা পৌঁছতেই পারিনি, তাদের মধ্যে কয়েকটি খুব বড় শিল্পগোষ্ঠী আছে।
সুমন- রাহুল বাজাজ ছাড়া আর কে?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- রাহুল বাজাজ ছাড়া রিলায়েন্সকে আমরা বেশি করে চাইছি।
সুমন- কোন রিলায়েন্স? এখন তো দুটো রিলায়েন্স আছে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- দু’জনকেই। ছোটজন তো সই করে গিয়েছেন।
সুমন- আপনি কি ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ বলে পণ করেছেন?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- বাণিজ্য করতে গেলে সবাইকেই মেলাতে হবে।
সুমন- মুকেশ এবং অনিল, আপনার দু’জনের সঙ্গেই একই রকম সম্পর্ক?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- হ্যাঁ।
সুমন- আপনার কার প্রতি দুর্বলতা বেশি?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- দু’জনকেই আমি চাই।
সুমন- কিন্তু কল্যাণীতে আপনি ওঁদের যে জমি দিয়েছেন তাতে ওঁরা ভয়ানক অসন্তুষ্ট।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- কেন?
সুমন- কথাটা ওঁরা প্রকাশ্যে বলছেন না, তবে ওঁদের সুস্পষ্ট মতামত হল ইন্সটিটিউট অফ এক্সেলেন্স তৈরি করার এটা কোনও জায়গাই নয়।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- কী বলছেন? ওখানে ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স, যেটার জন্য প্রাইম মিনিস্টার আসলেন, ফিরে গেলেন সেই রাত্রিতে, সেটা তো কল্যাণীতেই হচ্ছে। কল্যাণীতে একটা মেডিক্যাল কলেজ হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি আছে, এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি আছে। কল্যাণীটা প্রকৃতপক্ষে দাঁড়াবে একটা এডুকেশন্যাল হাব হিসেবে। আর সেখানে আরএকটা সুবিধে হচ্ছে হাইওয়ে কানেক্টিভিটি আছে এবং জায়গাটা আমার হাতে আছে। ডিপার্টমেন্টের বিশাল জমি। আর ওখানে ক্যাম্পাস লাইফ চাই। আইটি নিয়ে যাঁরা পড়বেন, খুব অ্যাডভান্স ট্রেনিং হবে, ক্যাম্পাস লাইফ না থাকলে…
সুমন- রিলায়েন্স আর বাজাজ ছাড়া আর কে?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- রিলায়েন্সকে আরও বেশি চাই, আমরা রতন টাটার কাছ থেকেও আরও বেশি আশা করছি।
সুমন- কী আশা করছেন?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- সেটা এখন বলতে পারব না।
সুমন- শুনতে পাচ্ছি কারখানা, গাড়ি তৈরির কারখানা।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- মুখ বন্ধ, এখন মুখ বন্ধ, নির্বাচন বলে। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান কোম্পানিজ আরও বেশি চাই। অটোমোবাইলসটা এখন আমাদের দুর্বলতা। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এখন টেক্সটাইলস। টেক্সটাইলস আর অটোমোবাইলস এ দুটো ব্রেক-থ্রু করতে না পারলে – আর যেটা বলছিলাম, ইন্ডাস্ট্রিওয়াইজ যদি বলেন টেক্সটাইলস আর অটোমোবাইলস। অটোমোবাইলসে একটু পথ খুলেছে রাশিয়ানরা আসার পরে। আর একটা ট্র্যাক্টর, আর মোটর সাইকেল। টেক্সটাইলসটায় তো আমরা একেবারে খারাপ অবস্থায়।
সুমন - What about employment? বুদ্ধবাবু আমি সত্যি কথা বলছি। আমরা একটা সার্ভে করেছিলাম। নানা সেক্টরাল সার্ভে অফ ইওর পারফর্মেন্স। সেই সার্ভেতে যেখানে আপনার গভর্নমেন্ট খুব কম নম্বর পাচ্ছে সেটা হল এমপ্লয়েমেন্ট, লোকে বলছে গর্জন যতটা হয়েছে বর্ষণ ততটা নয়, অন্তত চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে। এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট হয়নি।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- প্রয়োজনের তুলনায় হয়নি, কিন্তু গত এক বছরে যদি বলেন আসতে আরম্ভ করেছে। আমি দু-চারটে উদাহরণ দিচ্ছি। একটা হচ্ছে প্লাস্টিক্স। প্লাস্টিক্স-এ direct এবং indirect employment ভালো হয়েছে। তারপর লেদারে। বানতলা employment দারুণ বাড়িয়েছে।
সুমন- এখনও তো বানতলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- না সেটা ঠিক নয়। ট্যানিংয়ে প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে। হ্যাঁ আপনি বলতে পারেন ম্যানুফ্যাকচারিং সে ভাবে শুরু হয়নি। তবে হবে। আমরা বড় শিল্প চাইছি ঠিক কথা। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকেও আমরা দারুণ গুরুত্ব দিচ্ছি, কেন না সেখানেই কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তারপরে ধরুন আইটি সেক্টর, সেখানে বিশ হাজার ছেলেমেয়ে চাকরি করছেন, ভবিষ্যতে আরও করবেন।
সুমন- আইটি-র কথায় পরে আসছি। ইদানীং দেখা যাচ্ছে যেখানে সেখানে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা গজিয়ে উঠছে। এর ফলে অর্থনীতির কতটা উপকার হচ্ছে বলতে পারব না তবে এই কারখানাগুলো পরিবেশকে এমন ভয়ঙ্কর ভাবে দূষিত করে যে মানুষের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বিশেষ করে দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলে।
এর সঙ্গে আরও একটা মস্ত বড় অন্যায় করা হচ্ছে। দৈনিক ৬০-৭০ টাকায় ব্লু কলার জব করাচ্ছে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য- দু’টো সমস্যা সম্পর্কেই আমরা ওয়াকিবহাল। মাইনে-পত্রর সমস্যা ট্রেড ইউনিয়ন দেখবে, যদিও আমরা জানি মালিকেরা খানিকটা ঠকাচ্ছে। সরকার হিসেবে আমাদের কর্তব্য হল পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা। প্রশ্ন হল, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হল কী করে। দেখুন এটা চিনারা করেছে, হইহই করে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা তৈরি করা যেখানে সেখানে। আমাদের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ একটি চমৎকার যন্ত্র তৈরি করেছে যেটি ব্যবহার করার জন্য আমরা সবাইকে বাধ্য করছি। এই যন্ত্রটি বসালে পরিবেশ দূষণের মাত্রা যদি বিপদ সীমার ওপরে উঠে যায়, কারখানা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া বড়জোরায় আমরা একটা বড় জমি চিহ্নিত করেছি যেখানে আশেপাশের সব ক’টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানাকে একত্রে নিয়ে চলে আসব। সেই ক্লাস্টারে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করার জন্য অনেক ব্যবস্থা থাকবে। (চলবে)