logo

একদা আমিও পুতিনের সমর্থক ছিলাম… (৩)

  • August 16th, 2022
News

একদা আমিও পুতিনের সমর্থক ছিলাম… (৩)

আনাশতেশিয়া কেরিয়ার

অনুবাদ: সুমন চট্টোপাধ্যায়

তারপর সব কিছু বদলে গেল ২০১৬ সালে আমি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় আসার পরে। আমি সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করতাম না কিন্তু যখন যেখানে সুযোগ পেতাম, মার্কিন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পুতিন ও রাশিয়ার পক্ষে কথা বলতাম। একবার আমরা বন্ধুরা বসে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অভিযান সংক্রান্ত একটি মার্কিন ডকুমেন্টরি ছবি দেখছিলাম, এক সময় চিৎকার করে আমি বলে উঠি, সব ঝুট হ্যায়, হয় মিথ্যা নয় ‘চেরি পিকিং।’ ক্রিমিয়ায় কোনও রাশিয়ান ট্যাঙ্ক প্রবেশই করেনি, সেখানে একজন মানুষেরও মৃত্যু হয়নি। কথায় কথায় আমি সেই ছবিটি বের করে দেখাতাম যেখানে সার সার অ্যাপার্টমেন্টের জানলা থেকে পতপত করে রুশি পতাকা উড়ছে ক্রিমিয়ায়। আমার বিশ্বাস ছিল তথ্য প্রমাণ হিসেবে এটাই তো যথেষ্ট। আমার সঙ্গে বন্ধুরা কেউ তক্কো করত না, হয় তারা আমার বক্তব্যকে গুরুত্বই দিত না নয় সৌজন্যের খাতিরে চুপ করে থাকত।

ধীরে ধীরে আমার মনেও সন্দেহ বাসা বাঁধতে শুরু করল, ক্রেমলিনের ভাষ্য বোধহয় সত্য নয়। আমেরিকায় চলে আসার ফলে রাশিয়ার নিত্য নতুন প্রোপাগান্ডার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, কেবল বাবা-মায়ের সঙ্গে গপ্পো করার সময় দু’চারটে পুতিনপন্থী মন্তব্য শুনতে পেতাম। তারপর পড়ে গেলাম সাংবাদিকতার প্রেমে, খবর কী করে সংগ্রহ করতে হয় এবং সত্যাসত্য যাচাই করা হয় তা শিখে গেলাম কলেজের কাগজে কাজ করতে করতে। 

২০১৬-র মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার প্রভাবের কথা প্রথম যখন কানে এল, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। যে শুনতে রাজি হতো তাকেই বোঝানোর চেষ্টা করতাম এটা পরিকল্পিত মিথ্যাচার। রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র কী ‘তথ্য’ প্রচার করছে তা আমার নাগালে ছিল না, আমি প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি কাগজগুলি পড়তে শুরু করলাম, তাতে আমার বিভ্রান্তি বেড়ে গেল, দেখলাম জগৎটাকে ওরা সাদা-কালোর বাইনারির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, মাটির বাস্তবতার সঙ্গে যা সম্পূর্ণ সম্পর্ক-রহিত।

আমার বিভ্রান্তির কথা আমি বাবার সঙ্গে আলোচনা করতাম। এখানে সাংবাদিকতার ক্লাসে কী শেখানো হয় আমি তা জানি। একটা নিবন্ধ কী ভাবে তথ্যের সমাহারে একত্রিত করা হয়, সাংবাদিকেরা সত্যকে কতটা গুরুত্ব দেয়, আমি সে কথাও বুঝি। কিন্তু একটি মিডিয়া সংস্থার ঠিক কোন স্তরে রাশিয়া সংক্রান্ত মিথ্যাগুলি প্রকাশযোগ্য স্টোরিতে রূপান্তরিত হয়, আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না।

২০১৭ সালের গ্রীষ্মের শেষ দিকে আমার বেশ কয়েকজন সিরিয়াস রিপোর্টারের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হলো। প্রায় তৎক্ষণাৎ আমার চোখের ঠুলি খসে পড়তে শুরু করল। যে সব তত্ত্বে আমি এ যাবৎ বিশ্বাস করেছি - যেমন রাশিয়া আসলে ক্রিমিয়াকে বাঁচিয়েছে বা পুতিন কখনও অন্য কোনও দেশের ক্ষতি করতে পারেন না- এঁরা সেগুলি নস্যাৎ করে দিলেন। আরিজোনায় সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত এক সম্মেলনে যোগ দিতে গেলাম, সেখানে দু-একজন প্রতিষ্ঠিত রিপোর্টারকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম রাশিয়া সম্পর্কে মার্কিন মিডিয়ার মূল্যায়ন একেবারেই ভ্রান্ত। শুনে তাঁরা এমন আমোদ পেলেন, আমার গা-পিত্তি জ্বলতে শুরু করল। একজন রিপোর্টার যাঁর কাজকে আমি খুবই সম্মান করি, তিনি আমার কথা শুনে সৌজন্যের হাসি হাসলেন এবং এমন ভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন বিস্তর মজা পেয়েছেন। আর একজন আমার কথা শুনে কেবল একটি শব্দে জবাব দিলেন। ইন্টারেস্টিং। তারপরেই তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি যে সব কথা বলছি তার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই, আমি বিভ্রান্ত, আমার বক্তব্যের বিনোদনমূল্য ছাড়া আর কিছুই নেই।

নিজের সম্পর্কে, আমার মাতৃভূমির সম্পর্কে, গোটা দুনিয়া সম্পর্কে আমার যা ধ্যান-ধারণা ছিল সবকিছুই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে শুরু করল যেন। আমার মাথা পাক খেতে শুরু করল, মনে হলো ক্রমশ আমি যেন খুব একা হয়ে পড়ছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনা করব সে উপায় নেই, তাঁরা তখনও কট্টর পুতিনপন্থী। রুশি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনার রাস্তাও বন্ধ। হয় তারা রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে নতুবা আত্মরক্ষার্থে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দেয় যেন সে যা বলছে একমাত্র সেটাই সঠিক। ব্যক্তিগতস্তরে আমার ক্ষতটি কতটা মারাত্মক আমেরিকান বন্ধুরা তা বুঝতে পারত না। আমার মনে হলো আমি যেন নিজেকেই চিনতে পারছি না বা আমার নিজস্ব মতামতটাই বা কী?

পরের সেমেস্টারে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্লাসে আমি একজন ‘ভালো মানুষ’কে খুঁজে পেলাম, সেই মুহূর্তে আমার যাকে বিশেষ প্রয়োজন ছিল, যিনি বোঝাতে পারবেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির রহস্য, এই সত্যটা যে চোখের সামনে যা দেখা যায়, দুনিয়াটা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। আমি স্যালিকে পেলাম রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে যিনি সত্যিই আন্তরিক, তিনি আমাকে অনেক বই পড়তে দিলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সঙ্গে কথা বললেন যাতে আমি রাশিয়ার ইতিহাস ও রাজনীতির টুকরোগুলো এক জায়গায় করে সত্যের কাছকাছি পৌঁছতে পারি। প্রায় রোজ কলেজের শেষে আমি স্যালির ঘরে ঢুঁ মারতে শুরু করলাম। তিনি যে সব বই আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন, তা থেকে আমি কী জেনেছি তা নিয়ে আলোচনা করতে- স্তালিনের জমানায় নিপীড়নের বলিদের গণ-কবর, আলেকজান্দার লিটভিনেঙ্কোকে বিষ খাইয়ে মারা, পুতিনের দুর্নীতি ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি। আমার বাবা-মাকে নিয়েও কথা হতো, যাঁদের বিশ্বাস অনেকটা ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের মতো, যার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটিই বিষয়- রাশিয়ার মহত্বকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল স্ববিরোধিতায় ভরা, কখনও তাঁরা বলতেন, 'পুতিনের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত আর কেউ হয় না’। আবার কখনও, ‘পুতিন ইজ দ্য বেস্ট থিং টু হ্যাভ হ্যাপেনড ইন রাশিয়া’। দুই মন্তব্য একই আলোচনায়।

এ কথা বুঝতে পেরে নিজেই বিস্মিত হতাম, যে সব জিনিসকে এতদিন আমরা সাধারণ জ্ঞান বলে জেনে এসেছি, তাদের উৎসে আছে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আর অপপ্রচার। না, ইউক্রেন অনেক দিন যাবৎ রাশিয়ার তেল চুরি করে আসছে এই অভিযোগ ডাহা মিথ্যে কথা। না, ২০১১-য় রাশিয়ার রাস্তায় বিক্ষোভের পিছনে হিলারি ক্লিন্টনের হাত ছিল না। না, বারাক ওবামা মুসলিম নন (ভাবতে লজ্জা লাগে এই সত্যটি মাত্র বছর দু’য়েক আগে জানতে পেরেছি)। আমি নিজের দোষ সংশোধনের জন্য মরণপণ চেষ্টা চালিয়েছি, তবু এখনও মাঝেমাঝেই আমার পদস্খলন হয়, এখনও সেই সব উদ্ভট বিশ্বাসগুলো বুদ্বুদের মতো মাথায় ভাসতে থাকে। যার উৎসে ইতিহাস অথবা বিজ্ঞান হয়তো আছে, কিন্তু ফের আমায় আমার মতামতগুলির পূনর্মূল্যায়ন করতে বসতে হয়। আমার স্বামী যিনি ক্যাথলিক হিসেবে বড় হয়েছেন, হাইস্কুলে পড়ার সময় তাঁরও ধর্মের সঙ্গে যুঝতে একই অসুবিধে হয়েছিল। QAnon নিয়ে অনুসন্ধান করার সময় আমার সঙ্গে এমন কয়েকজনের পরিচয় হয় যাঁরা ঠিক আমার মতো অসত্য আর ষড়যন্ত্রের ককটেল খেতে খেতে বড় হয়েছেন এবং একবার চেতনা হওয়ার পরে নিজেদের বিশ্বাসগুলিকে বদলে ফেলেছেন। যাঁরা QAnon ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরাও আমাকে অনেকটা একই কথা বলেছেন, চিন্তা গুলিয়ে যাওয়া অথবা রাজনৈতিক বিশ্বাসে ভিটেছাড়া।

স্যালি আর আমি এখনও আলোচনা করি বই নিয়ে, রাশিয়া নিয়ে। এই সেদিন সে বলেছে, আমার মতামত পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় তার যে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সেটা সে বুঝতেই পারেনি। অথচ আমি তো জানি স্যালি না থাকলে আমি এখনও প্রোপাগান্ডার ভুলভুলাইয়ায় ঘুরপাক খেতাম নতুবা হয়তো পাগলই হয়ে যেতাম। (আগামী কাল শেষ)।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *