logo

আমিও একদা পুতিনের সমর্থক ছিলাম…(৪)

  • August 16th, 2022
News

আমিও একদা পুতিনের সমর্থক ছিলাম…(৪)

আনাশতেশিয়া কেরিয়ার

অনুবাদ- সুমন চট্টোপাধ্যায়

এই যে আমার রাজনৈতিক অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন, সেটা মেনে নেওয়া আমার বাবা-মায়ের কাছে আদৌ সহজ ব্যাপার ছিল না। সন্তান গৃহছাড়া হয়ে বহু দূরের বিদেশে আছে সেটা মেনে নেওয়া এক কথা কিন্তু বিদেশে থাকার ফলে সে নিজেই বদলে যাচ্ছে বা এতদিন যাবৎ যা ছিল সাধারণজ্ঞান তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চালানোটাই কষ্টকর হয়ে উঠছে, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রশ্ন। রাজনীতির প্রসঙ্গে এলে আমরা আর নিজেদের মনের কথাটা বিনিময় করতাম না। বেশিরভাগ সময়ই প্রোপাগান্ডা প্রসূত মতানৈক্য এড়াতে আমরা সন্তর্পণে বিষয়টিই এড়িয়ে যেতাম।

তারপর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করল, এক লহমায় বদলে গেল সব কিছু। হঠাৎ করেই আমাদের মতবিরোধের ফল হয়ে দাঁড়াল মারাত্মক। রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র্রের অপপ্রচার ভিন্ন মাত্রা পেল, নাৎসি বলে দেগে দেওয়া শুরু হলো ইউক্রেনিয়ানদের। এ কথা মাথায় রেখে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন উদ্বেগ আর আতঙ্ক মানুষের মন থেকে একেবারে মুছে যায়নি।

ঠিক তার পরের দিনই বাবার ফোন এল, বুঝলাম তিনি মনের মতো একজন সমর্থককে খুঁজছেন। আমি তাঁকে কেবল এটুকুই বলতে পারলাম যে আমার মনের হাল তাঁর মতোই বিধ্বস্ত। কথাচ্ছলে বাবা যখন বলে ফেললেন, আমরা এটা করছি ইউক্রেন নাৎসিমুক্ত করতে, আরও পরিষ্কার হয়ে গেল আমার গলায় তিনি একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে চাইছেন। তখনই আমার বাবাকে থামিয়ে দেওয়া উচিত ছিল- পরে তিনি আমায় বলেছিলেন গোড়ার দিকে তাঁর মনেও যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু পরে তিনি গবেষণা করে বুঝতে পেরেছেন রাশিয়া যা করছে সেটাই সঠিক। তার কিছুদিন পরে মায়ের একটা মেসেজ এল আমাকে সাবধান করে দিতে, খবরদার রাশিয়া বিরোধী কোনও কিছু আবার ‘লাইক’ করে বোসো না। তার অর্থ হবে যুদ্ধ নিয়ে তথ্যের লড়াইয়ে সক্রিয় ভাবে সামিল হওয়া। তারপর তিনি একের পর এক অডিও ক্লিপ পাঠাতে থাকলেন এই অনুরোধের সঙ্গে যে আমি যেন আমার মতো করে এগুলি ছড়িয়ে দিই যাতে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দুনিয়া জুড়ে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার দূরত্ব এক ঝটকায় অনেকখানি বেড়ে গেল। তাঁদের দেশপ্রেম তখন একেবারে উথলে উঠেছে। কেন না রাশিয়া নাকি যুদ্ধ করছে নাৎসিদের উৎখাত করে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে। তাঁরা এ কথাও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, রাশিয়ান ফৌজের বাড়াবাড়ি নিয়ে যে খবর আসছে, আসলে তা ইউক্রেনিয়ানরাই করছে অথবা বুজরুকিকে সত্য বলে চালানো হচ্ছে।

আমি অবশ্য ততদিনে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়া তার নিকটতম প্রতিবেশীর কী মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে তা নিয়ে পুরোদস্তুর রিপোর্টিং শুরু করে দিয়েছি। একটি প্রতিবেদনের জন্য আমাকে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের সঙ্গে বিস্তারিতে আলাপ আলোচনা করতে হলো। তাঁদের মুখেই শুনলাম সত্য-কাহিনি- সাধারণ মানুষের বাসস্থানের ওপর নির্বিচারে বোমা পড়ছে, কোনও প্ররোচনা ছাড়াই সাধারণ নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। খবরের সংস্থাগুলি থেকে জানা গেল, যুদ্ধাপরাধের আরও ভূরি ভূরি তথ্য, নারী ও শিশুদের ওপর বলাৎকার, বুচার রাস্তায় সার দিয়ে শুয়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশের ছবি, সোজা কথায় ঠিক তাদের নির্বিচার গণহত্যা রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র যাদের এখনও ভাই-ভগিনী বলে সম্বোধন করে থাকে।

যুদ্ধ সংক্রান্ত আমার লেখা নিয়ে বাবার সঙ্গে একবারই কথা হয়েছিল। তিনি আমার লেখা পড়েননি, আমার মতামতেও তাঁর বিন্দুমাত্র সায় নেই। তবে আমি যাকে সত‍্য ও সঠিক বলে মনে করি তার পক্ষে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস দেখানোর জন্য মেয়েকে নিয়ে বাবা গর্বিত। আমাকে আমেরিকায় পাঠানোর জন্য বাবা-মাকে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। যদিও মার্কিন সরকারের তাঁরা কট্টর সমালোচক ছিলেন। প্রতিটি পদে তাঁরা আমাকে সাহায্য করেছেন। সম্প্রতি বাবা-মার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে একদিন আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বললাম, সে আমার পরিবারকে চেনে। শুনে সে তো স্তম্ভিত, ‘ইওর পেরেন্টস, রিয়েলি!’ আমি জানি আমার বাবা- মায়ের ক্রেমলিনের সুরে কথা বলার কোনও প্রয়োজনই নেই। তাঁরা যথেষ্ট স্মার্ট, শিক্ষিত, কৌতূহলী, দয়ালু। ক্রেমলিনের অপপ্রচারের শিকার আরও অসংখ্য মানুষের তুলনায় তাঁদের সুযোগ সুবিধে অনেক বেশি। তবু ভবী যে কিছুতেই ভুলবার নয়।

পুতিনের ইউক্রেন অভিযান কিন্তু রাশিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন সমীক্ষার ফল বলছে ৫০ শতাংশের বেশি লোক এই যুদ্ধকে সমর্থন করে। যদিও মানুষের মনের কথাটা কী, সেটা অস্বচ্ছ। এমন হতে পারে যা বলা উচিত বলে মনে করেছে সেটাই বলেছে। এমনকী বহির্জগতের খবরাখবর যাঁরা নিয়মিত পেয়ে থাকেন, তাঁরাও মনে করেন আগ্রাসনের তত্ত্ব পুরো বাকোয়াশ। তাদের কথা হলো, সবাই মিথ্যে কথা বলে। ব্যাস, এটা একবার বিশ্বাস করে ফেললে চিন্তাকে প্রসারিত করার আর কোনও প্রয়োজন থাকে না। কাজ করতে গিয়ে পদে পদে আমি এমন মনোভাবের সম্মুখীন হয়েছি যেটা আমার মতে ক্রেমলিনের অক্লান্ত অপপ্রচারের অনিবার্য ফল। কোনও কোনও মানুষের মনে অবশ্যই প্রশ্ন আছে, তাঁরাও কিন্তু রুশি ফৌজ এমন বীভৎস কাজ করতে পারে বলে বিশ্বাসই করে না। তাদের কাছে এটা অকল্পনীয়।

আমি এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে পৌঁছতে চাই। এই রক্তপাত দেখে আমার শিক্ষা হয়েছে, এই অনৈতিক যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কাবু করা দরকার প্রোপাগান্ডার দানবটাকে। আবার একথাও ঠিক, একমাত্র অপপ্রচার দিয়ে এমন সর্বগ্রাসী বিশ্বাসের ব্যাখ্যা করা যায় না। পশ্চিমের দেশগুলিতে থাকা এমন অনেক রাশিয়ানকে আমি চিনি, যাঁরা রোজ মিডিয়ায় রুশি ফৌজের তাণ্ডবের ছবি দেখছেন, কাগজে পড়ছেন তবু এই যুদ্ধকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। কিন্তু সত্যটা নিয়ে এদের কাছেও বারবার যাওয়াটা খুব প্রয়োজন। কেন না এর সঙ্গে নৈতিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে। আমরা যাঁরা রুশি নাগরিক, তাদের প্রধান কর্তব্য হলো, এই সব ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আর মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করা মানুষদের সঙ্গে ক্রমাগত আলাপ চালিয়ে যাওয়া। জানি, কাজটা খুবই কঠিন কিন্তু বিকল্পই বা কী আছে?

একেবারে ব্যক্তিগত স্তরে আমি নিজের প্রচেষ্টা জারি রেখেছি, বাবা-মায়ের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে আমার নিয়মিত আলোচনা হয়। আমি অত্যাচারের বিশ্বাসযোগ্য খবর তাঁদের শোনাই, পরিচিত লোকেদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা বলি। তাঁদের বিরক্তি ও ক্রোধ তুঙ্গ মুহূর্তে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমি বকবক করে যেতেই থাকি। এই চেষ্টা আমি চালিয়েই যাব। হয়তো একদিন তাঁরাও নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করবেন, তাঁদের মনেও সন্দেহ উঁকি দিতে থাকবে। সে দিন সত্যিই এলে আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়াব, তাঁদের সাহায্য করব সত্য সন্ধানে। (শেষ)

(লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘পলিটিকো’ পত্রিকায়, ১৫ জুলাই) 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *