logo

হাফসোল-৮

  • August 16th, 2022
Man-Woman

হাফসোল-৮

হাফ_সোল- আমের বিনিময়ে

শিল্পী দত্ত

ক্ষণস্থায়ী বসন্ত ভেগে  যাবার পরেই একটা অসহ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় পশ্চিমবাংলায়। আমরা যারা নব্বইয়ের দশকের ফসল, তাদের গরমকাল পড়লেই একটা এক্সট্রা বেদনার স্মৃতি ভিড় করে আসে। সারাদিন গরম,  ঘামে জিভ বের করে কাজ করার পরে এসে একটু ফ্যানের নীচে জিরোবার তাল করছে হয়তো বড়রা, ওমনি দুম করে কারেন্ট চলে গেল। আমাদের তখন পোয়াবারো। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আবার খেলা শুরু। তখন ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে একটা কথা খুব বলত সবাই। বড়দের শুনে শুনে আমরাও সমস্বরে বলে উঠতাম-

‘জ্যোতিবাবু চলে গেলেন।’

কেউ ইলেক্ট্রিক অফিসে ফোন করত না বারবার এখনের মতো। সারাদিনে সাতবার কারেন্ট চলে গেলেও ইলেক্ট্রিক অফিসে গিয়ে ভাঙচুর করত না কেউ। কুঁজোর জল আর হাতপাখায় দিব্যি অ্যাডজাস্ট করে নিত। বিকেল হলে ঝড় আসতে পারে, এই আশায় আশায় দুপুর গড়িয়ে যেত কুশি আম কাসুন্দি মাখা চাটতে চাটতে। 

আমাদের পাড়ায় আমগাছ ছিল প্রচুর। ছেলেপিলেদের মরসুমি ফলের যোগাড় হয়ে যেত ভালো মতো। পুষ্টির যোগান দিতে আপেল কমলা নাসপাতি আসত কেবল জ্বরজারি হলে। যাদের আমাদের মতো অঢেল প্রকৃতির দান (নাকি পড়শির!) নেই তারা বিষটক আমের কুশিও অমৃতজ্ঞানে খাবে। মানুষ বাছাবাছি করে তখনই, যখন অপশন প্রচুর থাকে। আমাদের ছিল। জীবনের অন্য কোনও ক্ষেত্রে না থাকলেও আমের ছিল। সবার চেয়ে সেরা ছিল মুখার্জিদের বাগানের কাঁচামিঠে আম। আকাশে মেঘ ঘনালেই আমরা একে একে সেই আমগাছের গোড়ায় গিয়ে জড়ো হতাম হাতে থলে নিয়ে। 

তখন সবে আমার ক্লাস সিক্স। এই বয়সটা ছেলেমেয়ে মাত্রই খুব ঝামেলার। সমবয়সি মেয়েদের অনেকেরই এ সব দস্যিপনায় বাধা পড়েছে। তারা হয় উদাস চোখে বারান্দা থেকে আমাদের স্বাধীনতা দেখে অথবা তাচ্ছিল্য নিয়ে আমাদের ‘কবে তোরা বড় হবি’ মার্কা ডায়ালগ দেয়। নানান সামাজিক বাধাবিঘ্নের মধ্যেও কিন্তু কিছু জিনিস ভালো ছিল। আমাদের খেলায় কোনওদিন ছেলেদের খেলা মেয়েদের খেলার ভাগাভাগি হয়নি। যতই খারাপ খেলি, আমাদের ছেলেরা ক্রিকেট টিম থেকে বাদ দেয়নি। আমরাও বউবাসন্তির বউ সাজিয়ে ছেলেদের বসিয়ে দেবার সময় খ্যাকখ্যাক করে হাসিনি। 

এ রকমই একদিন বিকেলে অনেকক্ষণ আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ও ঝড় না আসায় হতাশ হয়ে আমরা একটু লুকোচুরি খেলে নেব ভেবেছিলাম। একটা খুব গোপন জায়গায় আমি আর একটি ছেলে লুকিয়েছি। ছেলেটি আমার সমবয়সি হলেও মাথায় খাটো। তখনের মূর্খ আমি ভেবেছিলাম যে স্পিডে আমি লম্বা হচ্ছি সুস্মিতা সেন না হয়ে যাই। আর ছেলেদের তো বাড়ার লক্ষণই নেই। পাড়াশুদ্ধ ছেলের কেউই কেন আমাদের মতো লম্বা হচ্ছে না, এই নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। প্রচ্ছন্ন গর্বও যে ছিল না, তা-ই বা বুকে হাত রেখে বলি কী করে! যাইহোক, ছেলেটি বড় ভালো। কেউ পাক না পাক আমাকে সে রোজ একটি করে কাঁচামিঠে আম এনে দেয়। সে দিনও দিয়েছে। আমি আদ্ধেক খেয়েও ফেলেছি। আম প্রায় শেষের পথে। এমন সময়ে সে আমায় অকালবৈশাখীর ঝঞ্ঝার মতো ‘আই লাভ ইউ’ বলে বসল। আমি হতভম্ব হয়ে না বলতেই সে আমায় কারণ জিজ্ঞাসা করল। আমার সাদা মনে কাদা নেই। আমি আত্ম উচ্চতার গরবে গরবিনী হয়ে তাকে বলে বসলাম, ‘না না তুই খুব নাটা, আর মনে হয় বাড়বি না।’ ব্যাস আর যায় কোথায়! সে ছোঁড়া রেগে আগুন হয়ে এক সপ্তাহ ধরে দেওয়া সমস্ত আম ফেরত চেয়ে বসল। কোথায় পাব আম! সে তো খেয়ে আমি হজম করে ফেলেছি।

সেই আমার শেষ। আর কোনওদিন কারও কাছে ফ্রি কিছু নেবার আগে পারলে কাগজে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস লিখিয়ে নিই। ফিরিতে কিছুই এই দুনিয়ায় মেলে না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *