logo

নবনীতার ভালোবাসা

  • January 1st, 2021
Reminiscence, Suman Nama

নবনীতার ভালোবাসা

নবনীতার ভালোবাসা

সুমন চট্টোপাধ্যায়

‘ভালোবাসা’-য় আমি কখনও পা রাখিনি,যদিও ওদিক পানে গেলে কখনও-সখনও তাঁকে ভালোবাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। আর ফি-রবিবার সকালে উঠেই সব কিছু ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি সর্বাগ্রে তাঁর সাপ্তাহিক কলামটি পড়ার জন্য, যার শিরোণাম ছিল ওই ‘ভালোবাসার বারান্দা’-ই। নবনীতা দেব সেনের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে ভালোবাসতে আমি দ্বিতীয় আর কাউকে দেখিনি; মানুষ তো বটেই ফুল, ফল, পাখি, পাহাড়, ঝর্ণা, কুকুর, বেড়াল, কাঠবেড়ালি, চরাচরে যা কিছু সুন্দর তাদের সক্কলকে। ভালোবাসার ঝর্ণাতলায় দাঁড়িয়ে আমিও ভিজেছি, আনখশির। আমার কাছে এইটুকুই অনেক পাওয়া।

তবে সে অনেককাল পরের কথা। আমার সাংবাদিক জীবনের সূচনা আজকালে, যেটা ছিল নবনীতাদির মামাদের কোম্পানি। কিন্তু ভাগ্নীকে কোনও দিন মামাবাড়ির ত্রিসীমানায় দেখিনি, কাগজে এসে কর্তৃত্ব ফলানো তো দূরস্থান।অবশ্য আমি নিজেও বেশিদিন আজকালে থাকিনি, সাকুল্যে গোড়ার দিকে সোয়া দু’বছর।

নবনীতাদিকে আমি প্রথম ভালো ভাবে চিনতে পারি অন্যের চোখ দিয়ে, আনন্দবাজারে আসার পর। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার অগ্রজ দীপংকর চক্রবর্তীর সূত্রে। দীপুদাও তখন সাদাবাড়ির দাপুটে কলমচি, আদ্যোপান্ত বোহেমিয়ান, ঘোর পানাসক্ত, বেপরোয়া, বেহিসেবি, অসাধারণ লেখার হাত এবং বগলে সর্বদা আঁতলামির বই। এই ভবঘুরে পাগল-প্রেমিক চরিত্রটির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা কলেজ থেকেই, রতনে রতন চিনে নেওয়ার মতো আর কী! একই ছাদের তলায়, একই মালিকের অধীনে, একই কাগজে দাসত্বের যুগলবন্দি করার সময় আমাদের সম্পর্ক প্রায় আত্মীয়তার পর্যায়ে চলে যায়। আনন্দবাজারের বার্তা বিভাগে দীপুদা ছিল মূর্তিমান পাগলা ঘোড়া, আমার মতো করে কেউ তাকে বশে আনতে পারত না। দীপুদা দাবি করত, আমাকে নেওয়ার আগে অভীকবাবু নাকি ওর কাছে আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিলেন এবং ও প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিল। এটুকু বলেই ওর দাবি ছিল, ওর সুপারিশেই সরকার বাড়িতে যেহেতু আমার চাকরি হয়েছে অতএব ওকে নজরানা দিতে হবে পানশালায় নিয়ে গিয়ে। যখন পকেট গড়ের মাঠ থাকত দীপুদা তখনই এই প্রসঙ্গটা অনিবার্য ভাবে টেনে আনত। আমার বেতনও ছিল সামান্য, একদিন রাগ করে বলেছিলাম, চাকরি পেয়েছি একবার, তোমাকে মাল তো খাইয়েছি অজস্রবার। আগে যদি জানতাম এখানে এলে এমন শাস্তি ভোগ করতে হবে তাহলে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের ছায়াও মাড়াতাম না!

সেই দীপুদা ছিল ‘দিদি’ বলতে অজ্ঞান অনেকটা পাক্কা তৃণমূলিদের মতো। উঠতে দিদি, বসতে দিদি, খেতে দিদি, শুতে দিদি, দিদি দিদি শুনে শুনে আমার কান একেবারে ঝালাপালা। দিদির কথা বলা মানে দীপুদার আবেগে দিশেহারা হয়ে পড়া। একেবারে গোড়ার দিকে ভাবতাম দীপুদা বোধহয় নিজের দিদির কথাই বলে। ভুল ভাঙল এক নিশুতি রাতে।

‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল’ আমরা দু’জনে পানশালা থেকে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরছি, দীপুদা আবদার করল তাকে আগে নামিয়ে দিতে হবে। হিন্দুস্থান রোডে ঢুকে কোণের একটা তিনতলা বাড়ির সামনে ট্যাক্সি দাঁড়াতেই, আমার নেশা ছুটে গেল!

“আরে এ তো দেখছি নবনীতা দেব সেনের বাড়ি, এখন এত রাতে এমন বেহেড অবস্থায় তুমি এ বাড়িতে ঢুকবে কোন সাহসে?”

“সুমন ইউ আর অ্যান ইনকরিজিবল ইডিয়ট। আরে নবনীতা দেব সেনই তো আমার দিদি।

শুনে আমার পিলে চমকে গেল। ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বললাম শীগগির গাড়ি ঘোরাও। পিছনে এক ঝলক তাকিয়ে দেখি, স্ট্যাচু অব লিবার্টির ঢঙে একটা হাত কানের পাশ দিয়ে তুলে রেখে দীপুদা আমায় বিদায় জানাচ্ছে। সে রাতে তার কত পরে ভালোবাসার দরজা খুলেছিল বলতে পারব না। বাড়ি ফেরার পথে কেবলই ভাবছিলাম. দীপুদাকে আশ্রয় দেওয়ার মানে তো দাঁড়ায় ক্ষুদিত পাষাণের মেহের আলিকে সাধ করে ডেকে আনা। এত সহ্যশক্তি আছে নবনীতা দেব সেনের? সত্যিই তিনি এতটা মহিয়সী? ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই কপালে আমার হাত-জোড়া উঠে গেল! মনে হল সত্যিই লাইফ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। কলকাতায় বেহালার কাছে দীপুদাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল। সেটা ছেড়ে তিনি আস্তানা গেড়েছিলেন ভালোবাসায়, এক-আধটা দিন নয়, মাসের পর মাস! ভালোবাসার ডুব-সাগরের সন্ধান সে পেয়েছিল ওই বাড়িতেই। দিদির আশ্রয়ে আর প্রশ্রয়ে।

একটু টোকা মারলেই দীপুদা গদগদ হয়ে ভালোবাসা বাড়ির অন্দর মহলের নানা কাহিনি শোনাত—দিদি, অমর্ত্যদা তাঁদের দুই কন্যা পিকো আর টুম্পার কথা। এত বছর পরে সেই সব কাহিনীর কিছু মনে আছে, বাকিটা ভুলে গিয়েছি।তবে সে সব গপ্পের মধ্যে কতটা দুধ আর কতটা জল আমি তা মাপার কখনও চেষ্টা করিনি! তাছাড়া সেইসব কাহিনি এতটাই ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক যে জনতার দরবারে তা নিয়ে আমি মুখ খুলবনা। দীপুদা পদ্ম পাতায় জলের মতো বাঁচতে বাঁচতে একদিন টুক করে চলে গেল, তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। নবনীতাদি গেলেন এই সেদিন।এঁরা দু’জনেই আমার একান্ত আপনজন, তাঁদের স্মৃতির প্রতি আমি বেইমানি করি কেমন করে?

নবনীতাদির জীবন ছিল ‘ কান্না-হাসির দোল দোলান”, এই পৌষের শীত তো ওই ফাগুনের উতল হাওয়া। তিনি একবার কোনও একটি লেখায় লিখেছিলেন, ”আমি এক চোখ দিয়ে হাসি আর অন্যটি দিয়ে কাঁদি।লাইনটি পড়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিলাম বেশ কিছুক্ষণ, হৃদয়ের কোন উৎসস্থল থেকে এমন একটি মরমী লাইন বেরিয়ে আসতে পারে, ভাবতে ভাবতে। অনেক পরে, তাঁর বইপত্র পড়ে, তাঁকে চিনে আমার মনে হয়েছে, নবনীতাদির দু’চোখের হাসি-কান্না বোধহয় একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে, কান্নাটা ছিল বলেই তিনি অমন অনাবিল, পাথর গলিয়ে দেওয়া হাসি হাসতে পারতেন বাকি সকলকে হাসাতে পারতেন, লঘুপক্ষের ওপর অনায়াসে দাঁড় করিয়ে দিতে পারতেন গুরুগম্ভীর বিষয়কেও, তাঁর স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ গদ্যের জাদু দিয়ে। নবনীতাদির স্বাতন্ত্র ছিল, তাঁর শিক্ষা, প্রজ্ঞা,আকাশের মতো উদার মন, অতলান্ত অভিজ্ঞতা আর পরিশীলিত সূক্ষ্ম রসবোধ। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই রেনেসাঁ নারী, তাঁর প্রজন্মের আরও কয়েকজন দিকপালের মতোই। তিনি ছিলেন রামধনুর মতো বহু রঙের ছটায় সমুজ্জ্বল।

আমার মনে হয় নবনীতা দেব থেকে দেব-সেন হয়েই তাঁর মুশকিল হয়েছিল,চাপা পড়ে গিয়েছিল তাঁর স্বকীয়তা! পতির পুণ্যে সতীর পুণ্যলাভের জন্য তাঁর জন্ম হয়নি, ব্যক্তিগত বিচ্ছেদ বৃহত্তর পরিসর সৃষ্টি করে দিয়েছে, যেখানে তিনি খোলা আকাশের তলায়, ডালপালা মেলা মহীরুহের মতো নিজেকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। লেখক নবনীতা শুধুই নবনীতা দেব! সামাজিক নবনীতা, নবনীতা দেব সেন!

মেয়েদের দুর্দশা, সামাজিক দুরবস্থা তাঁকে পীড়িত করত নানা ভাবে। তাই জীবনের শেষ বেশ কয়েকটি বছর ধরে তিনি একটি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন প্রাণপনে। বেছে নিয়েছিলেন আদুরে অথচ গভীর অর্থবহ একটি নাম—সই। সই মানে সখী, সই মানে স্বাক্ষর, সই মানে আবার সহ্য করাও। আমার স্ত্রী কস্তুরী সইদের দলে এক সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আর আমার কাজ ছিল, সই আয়োজিত বাৎসরিক বিতর্কসভায় প্রত্যেকবার গিয়ে তক্ক করা। কতবার বলেছি, ”নবনীতাদি এ বার আমাকে ছাড়ান দিন, লোকে ভাববেটা কী?” দূরভাষে ফ্যাশফ্যেশে হাঁফানি ধরা গলায় আদেশ শুনেছি, ‘আমি বলছি তাই তুমি আসবে। ব্যস।’

যতদূর জানি আমার আকস্মিক, অবিশ্বাস্য গ্রেপ্তা নবনীতাদিকে বিশেষ পীড়া দিয়েছিল। ফেসবুকে আমার একটা লেখার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন। একমাত্র তিনিই। বাংলার কবি-লেখক-শিল্পী-কলাকুশলীদের মধ্যে আর একজনও নন। লাল-সবুজ-গেরুয়া, কেউ নয়। কী করে ভুলব আমি সে কথা?

শুনতে পাচ্ছি নবনীতাদি চলে যাওয়ার পরে তাঁকে নিয়ে বাঙালির সুপ্তি কেটেছে, ঘটা করে নানা জায়গায় আয়োজিত হচ্ছে তাঁর স্মরণ সভা। অথচ নির্মম সত্যটি হল স্বজাতি তাঁর জীবদ্দশায় সেভাবে তাঁকে স্বীকৃতিই দেয়নি! তিনি আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন অথচ, আনন্দ, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দের নামধারী কোনও পুরস্কারই নয়! এ কথা ভাবলে নবনীতাদির সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। সৎ, বিবেকবোধসম্পন্ন লেখক ছিলেন বলেই তিনি রাজানুগ্রহ পাননি। তিনি শুক্লা পুর্নিমার চাঁদ হয়ে আকাশকে আলোয় ভরিয়ে তুলেছেন একার মুরোদে! জীবনে তাঁকে অবহেলা করার পরে মরণে রজনীগন্ধার মালা দিয়ে তাঁর ছবি যাঁরা সাজাচ্ছেন তাঁদের শুধু এইটুকু স্মরণে রাখতে অনুরোধ জানাই।

দেখা হবে দিদি। হয়ত অচিরেই!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *