- August 12th, 2022
একে একে নিবিছে দেউটি
নিরানন্দর জার্নাল (৭)
একে একে নিবিছে দেউটি
সুমন চট্টোপাধ্যায়
এই ছবিটি গত ২৪ এপ্রিল ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। তারপর সবে পক্ষকাল কেটেছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর পেলাম শৌনকও ছবি হয়ে গিয়েছে।
আমার এই ছবিটি শৌনকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন সুব্রতা ঘোষ রায়। পরে মেসেজ করে তিনিই জানিয়েছিলেন শৌনকের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, ডায়ালিসিস চলছে, তবে ছবিটি পেয়ে সে খুবই উল্লসিত। সুব্রতা আমাকে শৌনকের ফোন নম্বরটিও পাঠিয়েছিলেন। ওর অসুস্থতার কথা ভেবে আমি আর ফোন করিনি, কিছু সময় যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। আজ সকাল থেকে সেই কারণে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে, শৌনকের ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরের পরিচিত উচ্ছ্বাস শোনা হল না বলে, আমার নিজেরই ভুলে। আমরা যে এখন ‘আজ আছি কাল নেই’-এর ঘোর তমসাচ্ছন্ন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, বোধ করি সেটা আমার স্মরণে রাখা উচিত ছিল।
শৌনক দিয়েই আজ যদি পরিচিতের মৃত্যুর কোটা সম্পূর্ণ হত! হল না। ফেসবুক খুলে নিউজফিডে দেখি আর এক অগ্রজের চলে যাওয়ার মর্মান্তিক সংবাদ। কমল ভট্টাচার্য। শৌনক আমার প্রথম যৌবনের বন্ধু, সহকর্মী, কর্মজীবনের শুরুর দু’বছর আজকালে আমরা দামাল হাতির মতো বিচরণ করেছি। কমল’দার সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে কখনও কাজ করিনি যদিও একই জায়গায় করেছি। দিল্লিতে। আমি আনন্দবাজারে, কমলদা যুগান্তরে। মিতবাক, ষোলো আনা ভদ্রলোক, শেষ নিঃশ্বাসটি পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সাংবাদিকতা করে গিয়েছেন, বয়স অথবা শরীরের বাধা মানেননি। শৌনকের গোটা কর্মজীবনটাই কেটেছে ডেস্কে, প্রথমে বার্তা বিভাগে তারপর অন্যান্য শাখায়। কমলদা ছিলেন ধুরন্ধর রিপোর্টার, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, খবর যেখানে কমল ভট্টাচার্য সেখানে থাকবেনই।
আমরা সবাই মানুষ কিন্তু সব মানুষই ‘চরিত্র’ নয়। চরিত্র আবার কেউ ইচ্ছে করলে হতে পারে না, বিষয়টা অনুশীলনের নয়, জন্মগত আর স্বভাবজাত। ১৯৮১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, সরস্বতী পুজোর দিনে আমরা যে একদল অল্প-বয়সী ছেলেমেয়ে আজকালে যোগ দিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে চরিত্র ছিল কয়েক জন, শৌনককে রাখব সেই তালিকার প্রথম সারিতেই।
লম্বা দোহারা চেহারা, ধবধবে ফর্সা গায়ের রং, বাজের মতো গমগম করে গলার আওয়াজ। ওর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরের ডেসিবেল লেভেলটাই আমাদের চিৎকারের সমান। অফিসে এসে ডেস্কে চাঁদ-বদনটি দেখিয়েই শৌনক অদৃশ্য হয়ে যেত, এ-ঘর, সে-ঘর ঘুরে ঘুরে আড্ডা দিয়ে বেড়াত। কাজে ফাঁকি দিলেও শৌনকের ওপর রাগ করার উপায় থাকত না, জড়িয়ে ধরে আদর করে ও প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করত। শৌনকের বাবা অভিনেতা ছিলেন, আমি আজকালে থাকালীন এক মর্মান্তিক পথ-দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। শৌনকেরও শিল্পী মহলে অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল, নিয়মিত আনাগোনা ছিল সাহিত্যের গলি-ঘুঁজিতেও। আমি অবশ্য বিশেষ ভক্ত ছিলাম শৌনকের গানের। কাগজ ছাপাখানায় চলে যাওয়ার পরে অনেক রাতে নাইট ডিউটি করা আমরা ক’জনা আজকালের প্রশস্ত চাতালে, খোলা আকাশের নীচে, শ্বেতপাথরের সিঁড়ির ওপর বসে গুলতানি করতাম। শৌনক থাকলে রাত কাবার হয়ে যেত ওর গান শুনেই। তখন মনে হত বসে আছি বুঝি গানের ঝরনাতলায়।
তখন হীরক রাজার দেশের গানগুলি লোকের মুখে মুখে ফিরছে, ছবিটাও রিলিজ হয়েছে আমরা ঢোকার কয়েক দিন আগেই। তখন গুপী গায়েন, অর্থাৎ তপেন চট্টোপাধ্যায়ও আজকালে কাজ করছেন, বিজ্ঞাপন দপ্তরে। মজার মানুষ, সর্বদা হাসিখুশি, ইয়ার্কি-ফাজলামিতে ফার্স্ট ক্লাস। আমাদের রাতের জলসায় শৌনক একের পর এক হীরক রাজার দেশের গান গেয়ে যেত বিশুদ্ধ সুরে, উদাত্ত গলায়। আমার তো মনে হত ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’ শৌনক গাইত অনুপ ঘোষালের সমান দক্ষতায়।
আজ সবটাই স্মৃতি, যতটা সুখের ততটাই বেদনা-বিধূর। এক এক করে বন্ধুরা চলে যাবে, আমি তাদের স্মৃতি রোমন্থন করব, আপাতত এটাই কি আমার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল নাকি? ওপার পানে কেঁদে চাওয়াই কি তাহলে দাঁড়াল আমার সারাদিনের কাজ? স্বজন হারানোর শোক আর কত সহ্য করব আমি? ভূষণ্ডির কাক হয়ে বেঁচে থাকবই বা কেন? এখনও অক্সিজেন নিতে পারছি বলেই নিজেকে কেমন যেন অপরাধী লাগছে।
হা ঈশ্বর!