logo

কোভিড যাঁকে ভয় পায়

  • August 13th, 2022
Suman Nama, Troubledtimes

কোভিড যাঁকে ভয় পায়

নিরানন্দর জার্নাল (১৫)

কোভিড যাঁকে ভয় পায়

সুমন চট্টোপাধ্যায়

মা-মেয়ের কথোপকথন ছেঁড়া ছেঁড়া শুনতে পাচ্ছিলাম। কন্যার একটি কথায় আমার কান-দুটো সটান খাড়া হয়ে উঠল। খবরের কারবারিদের যেমনটি হয় আর কি!

‘জানো তো মা, মেঘনার দাদু আজ ভোরে বাড়ির কেউ ওঠার আগেই রান্নাঘরে গিয়ে সব বাসন ধুয়ে মেজে রেখে দিয়েছেন।’

মেঘনা আমার কন্যার আশৈশব সখী। ক্লাস টু থেকে ওদের হরিহর-আত্মা বন্ধুত্ব। নিউ ইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করে। লকডাউন, অতিমারীর কারণে আমার মেয়ের মতোই গত কয়েক মাস যাবৎ কলকাতায় আছে। মানে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।

এ পর্যন্ত কাহিনিতে কোনও চমক নেই। গোলগোল, সাদামাঠা। চমকে উঠলাম, দাদুর বয়স শুনে। নি-রা-ন-ব্ব-ই। এক্কেবারে আনন্দবাজার পত্রিকার সমবয়সী। ১৯২২-এর দোল পূর্ণিমার দিনে আনন্দবাজার প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এঁর জন্ম এপ্রিলে।

ভদ্রলোকের নাম জগদীশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, নিবাস বেহালা, মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে থাকেন।

জগদীশবাবু হঠাৎ বাসন-মাজার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন কেন? কারণ মেঘনার মা আর ওদের বাড়ির দুই পরিচারিকার কোভিড টেস্ট পজিটিভ এসেছিল। মেয়ে দরজায় খিল তুলে নিভৃতবাসে শয্যাশায়ী। বাড়িতে কাজের লোকও অনুপস্থিত। সব কাজের বোঝা গিয়ে পড়েছে আদরের নাতনির উপর। জগদীশবাবু এটা মেনে নিতে পারেননি। কর্তব্যবোধ তাড়িত হয়ে কাক-ভোরে উঠে তিনি নাতনির কাজ হালকা করে দিয়েছিলেন।

এ বার আসবে কাহিনির ক্লাইম্যাক্স। মেঘনার মা সেরে ওঠার পরে কোভিডে আক্রান্ত হলেন জগদীশবাবু স্বয়ং আর তাঁর জামাই। দু’টো টিকা নেওয়া সত্ত্বেও। ল্যাবরেটারি থেকে যেদিন কোভিডের রিপোর্ট এল শতাব্দীর অপেক্ষায় দিনগোনা এই আশ্চর্য মানুষটি নাতনিকে বলেছিলেন, ‘এ সব দেখিয়ে আমাকে ভয় পাওয়ানো যাবে না। আজ পজিটিভ হয়েছে, কাল আবার নেগেটিভ হয়ে যাবে।’

শুনে আমার হাত দু’টো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কপালে উঠে গেল। দূর থেকে প্রণাম জানালাম এই অসম-সাহসী প্রবীণ মানুষটিকে। অতিমারী শুরু হওয়া ইস্তক আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে স্বজন-বিয়োগ ব্যথায়, হাহাকার, উৎকন্ঠা আর আর্তনাদে। চতুর্দিকে শুধু নেগেটিভিটি, স্নায়ুর উপর অমানুষিক চাপ, মানসিক ভারসাম্য খোয়ানোর উপক্রম। এমন থরহরিকম্পিত বঙ্গজীবনে এই প্রথম একজন মানুষের কথা জানলাম, জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য বানিয়ে যিনি ভাবনাহীন, ভাবলেশহীন চিত্তে পরমানন্দে দিন যাপন করছেন আর ভাইরাসকে বলছেন ‘তফাৎ যাও তফাৎ যাও।’ বুঝে উঠতে পারছি না, ঠিক কী অভিধা প্রাপ্য এই মানুষটির। ’কোভিডের যম’ বললে কেমন হয়?’ মানে কোভিডও যাকে স্পর্শ করতে ভয় পায় আর কি!


সশরীরে বেহালায় গিয়ে জগদীশবাবুর পা ছুঁয়ে আসব, এখন সেই উপায় নেই। মেয়ের মাধ্যমে মেঘনাকে অনুরোধ করি দাদু সম্পর্কে ও যেন আমাকে বিস্তারিত তথ্য পাঠায়। মেঘনা সেই অনুরোধ রক্ষা করেছে দাদুর সঙ্গে ওর আধ ঘন্টার আলাপচারিতার অডিও ক্লিপ পাঠিয়ে দিয়ে। আমি বেশ কয়েকবার সেটি শুনেছি, কণ্ঠস্বরে ছিটেফোঁটা জড়তা নেই, স্মৃতিশক্তি এতটুকুও টাল খায়নি, সব কয়টি ইন্দ্রিয় সমান সজাগ।


জগদীশচন্দ্রের জন্ম সিলেটে, ১৯২২ সালের ৪ঠা এপ্রিল। তখন তাঁর বাবা শিলংয়ে কর্তব্যরত, ফলে সেখানেই কাটে জগদীশচন্দ্রের স্কুল-জীবন। পরে কলেজে পড়তে তিনি ফের সিলেটেই ফিরে আসেন। ১৯৪৪-এর শেষ দিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় চাকরিতে ঢোকেন। সারাটা কর্মজীবন সেখানেই কাটিয়ে তিনি ১৯৮০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। শেষ দশ বছর তাঁর পোস্টিং ছিল কলকাতায়।

জগদীশচন্দ্র বলছেন, চাকরিটা পেতে তাঁকে সিলেট থেকে দিল্লি যেতে হয়েছিল। প্রথমে লিখিত পরীক্ষা তারপরে ইন্টারভিউ। তাঁর কথায়, ‘সবটাই তখন ইংরেজদের হাতে, লালমুখো গোরা সাহেব। আমি ইংরেজি বলায় ততটা স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। ভেবেছিলাম, আমার এই চাকরিটা হবে না। ফল বেরোনোর পরে দেখি যারা চোস্ত ইংরেজি বলতে পারে তাদের একজনেরও চাকরি হয়নি, আমারটা হয়ে গিয়েছে। কী করে হলো, সেটা একটা বড় বিস্ময়।’

প্রথম পোস্টিং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ার সংলগ্ন একটি অখ্যাত জায়গায়। দিল্লি থেকে তক্ষশিলা ট্রেনে, সেখান থেকে বাসে আরও দু’ আড়াই ঘন্টা। দিল্লি স্টেশনে এসে জগদীশচন্দ্র দেখেন গোটা ট্রেন ফৌজের দখলে, সিভিলিয়ান একজনও নেই। বাকিটা শুনুন তাঁরই জবানীতে।

‘আমি লক্ষ্য করলাম, কাতারে কাতারে মানুষ ভিতরে জায়গা পাচ্ছে না বলে ট্রেনের ছাদে ঝপাঝপ উঠে পড়ছে। আমিও উঠে পড়লাম। সে সময় প্রতিটি কামরার ঠিক মাঝখানে ছাদের ওপর একটা মস্ত বড় গোলাকৃতি ভেন্টিলেটর থাকত। তার মধ্যে পুঁটুলিটা ফেলে আমি টানটান করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতের ট্রেন, শরীরটাও ক্লান্ত, ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুম চলে আসবেই। অনেক পরে মনে হলো কে যেন লাঠি দিয়ে আমার বুকে খোঁচা দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখি, ভোরের আলো ফুটব ফুটব করছে, সামনে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘদেহী পাঠান। সে আমার মঙ্গলের জন্যই ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে, কেননা একটু পরেই আসবে ওভারহেড টানেল। তখন ট্রেনের ছাদে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। ট্রেনের ভিতরটা ততক্ষণে অনেক ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, ছাদ থেকে নেমে কামরায় ঢুকে বসার জায়গা পেতে কোনও অসুবিধা হল না তক্ষশিলায় পৌঁছলাম সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ।’

(চলবে, আগামীকাল সমাপ্য)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *