logo

আমার জম্মোদিন

  • October 22nd, 2022
Suman Nama

আমার জম্মোদিন

সুমন চট্টোপাধ্যায়

প্রথমে গভীর অনুতাপ, ঠিক তার পরক্ষণেই অনির্বচনীয় আনন্দ। জম্মোদিন এলে এখন আমার এমন এক্কেবারে স্ববিরোধী অনুভূতি হয়। মাইরি বলছি, ঢপ নয়!

অনুতাপ হয় একথা ভেবে যে হঠাৎ অস্থির হৃদযন্ত্রটি স্তব্ধ হয়ে গেলে মনে মনে যা আহ্লাদ জমিয়ে রেখেছি তার সবটাইতো অপূর্ণ রয়ে যাবে। অনেক দিন ধরে ভাবছি একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখব, ভাবতে ভাবতে, ভাবা প্র্যাকটিশ করতে করতে এখনও পর্যন্ত একটি শব্দও লিখে উঠতে পারিনি। অথচ আমি লিখতে চাই-ই চাই। আরও কিছু প্রমাণ করা বাকি আছে, কিছু বকেয়া হিসেব মিলিয়ে দেওয়ার আছে, সর্বোপরি আমি যে ধরণের মর্মান্তিক, অবর্ণনীয়, অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়েছি, যেভাবে আমার গায়ে অযথা কলঙ্কের কালি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, আদালতের মধ্যে দিয়ে তার অসারতা প্রমাণের সময়টুকুও আমার হকের পাওনা। গুমঘর থেকে একবার বেরিয়ে এসেছি বলে আমাকে আবার সেখানে ফেরৎ যেতে হবেনা তার কোনও গ্যারান্টি নেই, একাধিক মিথ্যা মামলা ডেমোক্লিসের তলোয়ার হয়ে আমার মাথার ওপর ঝুলে আছে, কতদিন থাকবে নিশ্চিত নয়। এর মোকবিলা আমি নীরবে, নিরন্তর করে চলেছি, এসবের একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত সময়টুকুও আমার প্রাপ্য।কী ঠিক কিনা!

আবার পরক্ষণেই মনে হয়, নিকুচি করেছে অতৃপ্ত আত্মার সাধ-আহ্লাদের, শান্তি-পারাবারই আমার আশু গন্তব্য হওয়া উচিত।মৃত্যুর চেয়ে বড় ম্যাজিক-ডাস্টার জগতে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, হবেনা,হতে পারেনা। বাঁচা যাবে আর বারেবারে সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দিতে হবেনা, উকিলের বাড়ি দৌড়তে দৌড়তে চটির সোল খুলে যাবেনা, জলের মতো অর্থব্যয় করতে হবেনা, ধার-দেনার ধার ধারতে হবেনা, আদালতে হাজিরা দিতে হবেনা, আমার আত্মজ, যাঁরা আমার দুর্ভোগের সমান ভাগিদার, গভীর বেদনার মধ্যে দিয়ে হলেও তাদের জীবনে শান্তি আর স্বস্তি ফিরে আসবে। ঘরে-বাইরে আমার যে সামান্য দু-চারজন সাচ্চা শুভাকাঙ্খী এখনও অবশিষ্ট আছেন তাঁরাও তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন! মৃত্যু সাগরের সেই অনিবার্য মস্ত ঢেউ যা একটি বার আছড়ে পড়েই জীবনের বালুতটের সব আবর্জনা সাফ-সুতরো করে দিতে পারে এক লহমায়। সবশেষে আগুনের পরশমনির ছোঁয়ায় বাকি থাকবে কেবল নাভিকুন্ডের বিসর্জন।

বড় ভাল হোত, এই দু’টি বিকল্পের একটিকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ও ক্ষমতা যদি নিয়তি আমার হাতেই ছেড়ে দিত। আত্মহননের পথ আমার নয়, ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু প্রার্থনা করার উপযুক্ত জায়গাতেও আমি নেই। ফলে যেদিনটি যেমনভাবে আমার সামনে উপস্থিত হয়, আমি তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলাটা অভ্যেস করে ফেলেছি, প্রথম প্রথম দারুণ কষ্ট হত, হতাশ লাগত, অবসাদে পঙ্গু হয়ে যেত গোটা শরীর-মন, এখন আর হয়না। এজেন্সির সমন এখন আমার কাছে পরিচিতের বিয়ের নেমন্তন্নের মতো, তাদের অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা অলস অপেক্ষা মজ্জাগত, অবান্তর প্রশ্নের অনুত্তেজিত উত্তরও আমার আয়ত্ত্বাধীন। যা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে তা নিয়ে অযথা দুশ্তিন্তা না করার প্রাণপন চেষ্টাই এখন আমার অন্যতম সাধনা, যেটুকু আমার নিয়ন্ত্রণে, সর্বান্তকরণে তাতে মনোনিবেশ করতে চাওয়াটাই একমাত্র প্রশিক্ষণ। নিজের সঙ্গে নিজের এই কব্জির লড়াই চালাতে চালাতেই সূর্যাস্ত হয়, রাত্রি নেমে আসে গাঢ় নীল, ঘুমের বড়ির কল্যানে আমি বিছানার কোনে ঢলে পড়ি একেবারে অনায়াসে। তারপর আর একটা সূর্যোদয়, দিনগত পাপক্ষয়েস কখনও ঊনিশ কখনও বিশ!

পাঁচ বছর আগে আমার ষাটতম জন্মদিন বন্ধু-বান্ধব আর সহকর্মীদের উৎসাহে পালিত হয়েছিল বিশাল ধূমধাম করে, ঢাকুরিয়া লেক সংলগ্ন লেকক্লাবের সদ্য তৈরি হওয়া সুবিশাল ব্যাঙ্কোয়েট রুমে। গোটা আয়োজনের মধ্যমণি ও প্রধান মন্ত্রণাদাতা ছিল প্রীতিময় চক্রবর্তী, আমার আপনার চেয়েও আপনজন। এতদুপলক্ষে দে’জ পাবলিশিংয়ের অপু বড় যত্ন করে একটি বই প্রকাশ করেছিল, তাতে লেখকও ছিলেন ষাট জন। আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী শোভন তরফদার নিজেকে আড়ালে রেখে বইটি সম্পাদনা করেছিল।ওই সন্ধ্যায় চাঁদের হাট বসেছিল কলকাতার হুজ হু-দের, সুখাদ্য-সুপানীয়র ব্যবস্থা ছিল পর্যাপ্ত। আমার কোনও শুভাকাঙ্খী মুখ্যমন্ত্রী মহোদয়ার কানে বিষ ঢেলেছিলেন, কলকাতার এক পরিচিত অবাঙালি ব্যবসায়ী নাকি আমার জন্মদিনের পার্টি স্পন্সর করেছিলেন। বার্তাবাহকের মুখে এমন আজগুবি খবর শুনে তার উপস্থিতিতেই আমি সেই ব্যবসায়ীকে টেলিফোন করি, তিনি আকাশ থেকে পড়েন! আসলে মাল না তুলে যাঁরা বাড়ির টয়লেট পেপারটি পর্যন্ত কিনতে অভ্যস্ত নন , তাঁরা উপার্জিত অর্থের মর্মই বোঝেননা।

তারপরের পাঁচটি বছর আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক পর্ব, যে কাহিনী আমার ওই অভীষ্ট উপন্যাসের জন্য খাতা-বন্দী করে সযত্নে রেখে দিয়েছি। বীভিষিকাময় এই পর্বের ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব আমি এখনও করে উঠতে পারিনি। হারিয়েছি যা তার তুলনায় পেয়েছি অনেক কম, তবু যেটুকু পেয়েছি তার গুরুত্বও নেহাত ফেলনা নয়। মরার আগে নরক দর্শনের সৌভাগ্য কয়জনেরই বা হয়? কে প্রকৃত বন্ধু আর কে ছদ্মবেশি এই জরুরি শিক্ষাটাও ঈশ্বর আমাকে কানমলা দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছেন। জীবনে অনেক কিছু যা সমীপবর্তী হয়ে চাক্ষুষ করার সুযোগ আমার অন্যথায় কখনও হোতনা, এই সুযোগে সেটাও হয়ে গেল— তদন্তের স্বরূপ, গুমঘরে দিন যাপন, আমাদের বিচার ব্যবস্থা, কত রকমের কত অজানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় আরও কত কিছু!

সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করাটাই আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনের অন্যতম সাধনা। তাছাড়া শেষ বিচারে এও তো জীবনেরই ধন। আমি থাকলে ফেলা যাবেনা কিছুই।

আগামীকাল ২৩ অক্টোবর আমি হব তিন কুড়ি পাঁচ!

বাচ্চালোগ জোর সে হাততালি বাজাও!

8 comments

  1. আমার চমৎকার লাগল। আপনার এবং আমার পরিচিত “যারা মাল না তুলে বাড়ির টয়লেট পেপারটাও কেনে না”, তাদের, গা জ্বলবে- এতে আরও আনন্দ।

  2. হে “বার্থডে বয়”,❤❤❤❤❤
    শুভ জন্মদিন ( আগামী কাল ) 🌹💐🎂🍫🍭🍪🍬
    খুব ভালো থেকো শরীর, মনে।
    ভালো হো’ক জীবনে ।🥰❤🙏

  3. শুভ জন্মদিন। খুব ভাল লেখা।সুস্থ জীবন হোক।আরও লেখা ঝরুক

  4. বয়সে ছোট হয়েও জ্ঞানের কথা বলি!

    ওজন করে দেখতে পারো পাল্লা ভারী তোমার দিকে
    পারো যদি ভাগ করে নাও, দেখবে সবই যোগের দিকে
    যদি তুমি সাচ্চা থাকো, নিজের কাছে সত্যি বলে
    মানুষ তোমায় খুঁজে নেবে, বাসবে ভালো দুহাত তুলে।।

  5. স্যার অনেক অনেক ভালো থাকুন,শুভ জন্মদিন।

  6. লেখা টা পড়লাম।কি লিখব বুঝে পারছিনা।শুধু বলছি ভালো থাকুন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *