- November 18th, 2022
মার হলে পাল্টা মার (১)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
নবান্ন এখনও দূর অস্ত, সি পি এম নেতাদের গলায় তবু পুরোনো জঙ্গি মেজাজটা ফিরে আসতে শুরু করেছে। দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল মার দিতে এলে পাল্টা মার হবে। দলের সাম্প্রতিক পোস্টার-গার্ল মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় তো সরাসরি অঙ্গচ্ছেদের হুমকি দিয়ে বসে আছেন। তাঁর গর্জন, হকের প্রাপ্য থেকে কোনও গরীব মানুষের নাম কাটা পড়লে যে হাত সে কাজ করবে সেটি তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। দিন গেলে আরও কত এমন ‘সু-বচন’ শুনতে হবে কে জানে!
এ রাজ্যে যাঁদের বয়স পঁচিশের নীচে, এগারো বছর ধরে গর্তে ঢুকে থাকা ইঁদুরকুলের মুখে হঠাৎ এমন ব্যাঘ্র-গর্জন শুনে তাঁরা বিস্মিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মতো ভুশুন্ডির কাকের কাছে এমনতরো লড়কে লেঙ্গে জঙ্গিপনায় কোনও অভিনবত্ব নেই, এমনতরো সংলাপ শুনতে শুনতেই আমাদের কর্মজীবনের তিন-চতুর্থাংশ কেটে গিয়েছে, চুলে পাক ধরেছে, তারপর একদিন ঝরে পড়েছে বসন্তের শুকনো শালপাতার মতো।সেলিম সাহেব অথবা মীনাক্ষীদেবীর প্রবচন শুনে আমার অন্তত বিস্তর আমোদ হচ্ছে, স্মৃতির সরণি বেয়ে পথ চলতে পারছি, বুড়ো হাড়গুলো বেশ চনমনে হয়ে উঠছে। এই না হলে আগুনখোর কমরেড!
অজ্ঞাতবাসে অর্জুনের বৃহন্নলা সেজে থাকার মতো বাংলা বাজারের কমরেডরাও একটি দশক ছদ্মবেশ ধারণ করে ছিলেন গাত্র-চর্ম রক্ষা করতে। বেশ করেছেন, আপনি বাঁচলে তবেতো মহামতি স্তালিনের নাম! আমাদের বিভ্রম হচ্ছিল, এত বড় একটি সংগঠিত দল, কিলো কিলো কমরেড নিয়ে হঠাৎ এক ঝটকায় কপ্পুরের মতো উবে গেল কী করে? কোন জাদুকরের চোখ ধাঁধানো খেলায়? উবে গিয়ে পড়লটাই বা কোথায়? তাহলে কি সত্যিই সিপিএমের এপিটাফ লেখার সময় চলে এল?
ধীরে ধীরে রহস্যের কিনারা হলো কিছুটা। রাজ্যের সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল বিজেপি হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছে হারিয়ে যাওয়া অজস্র কমরেডের সৌজন্যে, তাঁরাই লালের বদলে গেরুয়া ঝান্ডার তলায় আশ্রয় নিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো, স্রেফ আত্মরক্ষার্থে। কমরেডদের আদর্শগত স্খলন নিয়ে কয়েকপ্রস্থ অবান্তর বিতর্ক হোল, এমন ভাব দেখানো হোল যেন বিপ্লবের মহান আদর্শের জন্য আত্মবলি দিতেই লাখ লাখ মানুষ হয় সিপিএমে নাম লিখিয়েছিলেন নতুবা দলটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অথচ সত্যটা হোল আদর্শ এক অলীক বুজরুগি, আসল চুম্বকটি হোল ক্ষমতা, তার সৌজন্যে কলাটা-মুলোটা পাওয়া, গোদা বাংলায় আখের গোছানো।যে ক্ষমতায় সেই আসল সিকন্দর আর সিকন্দরের পল্টনের সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশি। আমার তো মাঝেমাঝেই মনে হয় তসলিমা নাসরিনের মতো ‘আদর্শ’ শব্দটিকেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত, স্বার্থ-সর্বস্ব রাজনীতিতে এ এক বিভ্রান্তিকর ছলনা মাত্র!
বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে এই সেদিন তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসা সরকার হঠাৎ কেমন যেন ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে, স্থিতাবস্থাটিও হঠাৎ নড়বড়ে। দুর্নীতির চেহারাটা যেন হাইড্রা-হেডেড মনস্টার, যেদিকে চোখ ঘোরাবেন কিসসা কেবল চুরি-জোচ্চুরির। তৃণমূলের সবাই চোর বলাটা অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক, উস্কানিমূলক, অযথা অতিশয়োক্তি দোষে দুষ্ট। একই সঙ্গে এটাও অমোঘ সত্য রাজনীতির কদর্য লড়াইয়ে কোনও পক্ষেই যুধিষ্ঠিরের সন্তান-সন্ততিরা থাকেনা। সিপিএম স্রেফ রিগিং করে জেতে, একদা এই প্রচারে যতটা সারবত্তা ছিল এখন তৃণমূলের সবাই চোর তত্ত্বেও সত্য ততটুকুই। এই বিতর্কটি তাই অবান্তর, তর্কাতীত সত্যটি হোল এমন মহামারির মতো চুরি, ডাকাতি,তোলাবাজি, হফতা-রাজ স্বাধীনতার পরে বঙ্গভূমে কেউ কখনও দেখেনি। এখন শুধু ‘মাল দো, কাম লো!
শাসককে এর জন্য কতটা রাজনৈতিক মাসুল গুণতে হবে তা নিয়ে আমার ঘোর সংশয় আছে। নেতা চোর হলে হোক, আমার কাজটা করে দিলেই আমি সন্তুষ্ট, গড়পড়তা ভোটারের মনোভাব এটাই। বরং নেতার যদি অনর্জিত বৈভব না থাকে, তিনি যদি প্রাসাদ বানাতে না পারেন, না পারেন লম্বা লম্বা গাড়ি চড়ে গাঁয়ের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলতে, আম-ভোটারের কাছে তাঁর নম্বর নির্ঘাৎ কমে যাবে। বড়লোকি এখন নেতার রাজনৈতিক সম্পদ, ত্যাগ-তিতিক্ষা-সততা সব ডিমনিটাইজেশনের নোটের মতো বাতিল। মানদন্ডের জায়গায় সততার পরিবর্তে বসেছে সাফল্য, যেন কেন প্রকারেণ।
শাসকের মূল বিপদটি আসবে অর্থনৈতিক দিক থেকে। কেননা দান-খয়রাতির উপর্যুপরি বেপরোয়া সিদ্ধান্তগুলি আর খুব বেশিদিন কার্যকর করা যাবে বলে মনে হয়না। বাড়িতে বাড়িতে মদের দোকান খোলার অনুমতি ব্যতিরেকে রাজস্ব বৃদ্ধির অন্য কোনও চেষ্টা করবনা, অথচ চড়া সুদে কেবল লাখ লাখ কোটি টাকা দেনা নিয়ে হরির লুটের বাতাসার মতো ভোট কিনতে তা বিলি করে যাব এটা শুধু ‘ব্যাড ইকনমিক্স’ নয়, শেষ বিচারে আত্মঘাতী রাজনীতি, যার অশুভ, অস্বস্তিকর লক্ষণগুলি কার্বাঙ্কলের মুখের মতো একটি একটি করে খুলছে। গ্রামে একশ দিনের কাজ বন্ধ, সড়ক নির্মান ঢিমে-তেতালা, কেউ সময়মতো সরকারের ঘর থেকে ন্যায্য টাকা পায়না, স্বাস্থ্যসাথীর কার্যকারিতা নিম্নমুখী, সামনে রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের বর্ধিত হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার অশনি সঙ্কেত।পায়ের তলায় আগ্নেয়গিরির জন্ম দিয়ে নবান্নর চোদ্দ তলায় বসে মুখ্যমন্ত্রী আর নিরোর মতো বেহালা বাজিয়ে যেতে পারবেন কতদিন? (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How


অতুলনীয়, অনবদ্য, দূর্ধর্ষ 👌👌👌👌👌👌
এমন নিরপেক্ষ তীক্ষ্ণ বিশ্লেষনই হারিয়ে গেছে বাংলা মিডিয়ায় আজকাল । তাইতো আপনার অভাব বোধ হচ্ছিল। এজন্যই এখন আপনার কোন লেখা, কোন ভিডিও ই মিস্ করিনা।
দারুন বিশ্লেষণ।
আদর্শফাদর্শ বিসর্জন দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে — দূর সব __লা চোর ,আর চোরের মায়ের বড় গলা।
কিন্তু সব ন্যায়নীতি বিসর্জন দিলে, তার সঙ্গে ভেসে যায় সুবুদ্ধি , যা সুশাসনের জন্য জরুরি। আর তারই জেরে ‘ ব্যাড ইকনমিক্স’, আত্মঘাতী রাজনীতি ইত্যাদির সূচনা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী আগ্নেয়গিরির ওপর বসে পিকনিক/ বেহালা বাজাবেন কিনা তা সময়ই বলবে।
খুব সুন্দর, সাবলীল, বিশ্লেষনাত্মক ভাবে সমস্যাগুলোর পোস্টমর্টেম করা হয়েছে।
সুমন চট্টোপাধ্যায়কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।🙏