logo

এ কী স্বপ্ন! এ কী মায়া!

  • December 2nd, 2022
Suman Nama

এ কী স্বপ্ন! এ কী মায়া!

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আমার বয়সে আসল শয্যা-সঙ্গিনী হোল ঘুমের ওষুধ। ঘুম বিনে গতি নেই, ওষুধ বিনে ঘুম নেই। পরশু রাতে আর্জেন্তিনা-পোলান্ডের ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে আমি ওই ওষুধের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছিলাম, জান যায়, পর ম্যাচ ছুট নেহি যায়! আর-পার কী লড়াই, কাতারের স্টেডিয়ামে, কলকাতায় আমার স্নায়ুর সঙ্গে মনের।

সকালে দু’চোখ মেলা ইস্তক ধন্ধ শুরু হয়েছে আমি কি সত্যিই জেগেছিলাম নাকি স্বপ্নে খেলাটা দেখলাম? এমন খেলা তো সচরাচর সবুজ গালিচায় দেখতে পাওয়া যায়না, কেবল সুখ-স্বপ্নেই এমন রমণীয়, অবিশ্বাস্য অথচ অভীষ্ট অঘটন ঘটা সম্ভব।তাছাডা বেশ কিছুদিন হোল আমি ভ্রান্তিবিলাসের মধ্যে দিন-যাপন করছি, সকালের কথা সন্ধ্যায় ভুলে যাই, রাতে কোন ও টি টি প্ল্যাটফর্মে কোন ছবিটা দেখতে দেখতে ঘুমে ঢলে পড়েছি, পরের দিন সকালে কিছুতেই আর মনে করতে পারিনা। একেই কি ডিমেনশিয়া বলে? যা খুশি বলুক, আমার ক্ষত-বিক্ষত জীবনের বেশিরভাগ স্মৃতি অবলুপ্ত হলেও কিছু যায় আসেনা, হলে বরং ভালোই হয়, হৃদয় ভারমুক্ত হয় একই সঙ্গে। সামান্য যে কয়টি স্মৃতি কেওড়াতলা যাওয়ার পূর্ব-মহূর্ত পর্যন্ত মস্তিষ্কের কোষে যে কোনও মূল্যে ধরে রাখতে চাই, পরশুর আর্জেন্তিনা-পোলান্ড ম্যাচকে রাখব তাদের প্রথম সারিতে।

দেখলেন আমি আবার মস্ত ভুল করে বসলাম! কাল লিওনেল মেসির দল কি পোলান্ডের সঙ্গে খেলেছে নাকি প্রতিপক্ষ ছিল ভ্রাতৃসঙ্ঘ ! আসলে ঘোরের মধ্যে একটি স্বপ্নের ম্যাচ দেখলামতো, তাই সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বকাপের সৌজন্যে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কী একটা নতুন চ্যানেল দেখতে বাধ্য হচ্ছি। তাতে পালা করে দু’জন অ্যাঙ্কর বসেন, একজন ভারতীয় পুরুষ দ্বিতীয় জন শ্বেতেঙ্গিনী, যিনি আবার কাতারের মতো হিজাবে ঢাকা কালো পরিবেশের মধ্যে নিজের বিদ্রোহ ব্যক্ত করেন বক্ষ- বিভাজিকা অনাবৃত রেখে। তাঁদের অতিথি হয়ে যে তিন-চারজন প্রাক্তন বিশ্বকাপার খেলা-বিশ্লেষণ করেন, তাও বেশ মনোগ্রাহী, যদিও এঁরা কেউই বিশ্ব-কাপানো তারকা নন, (ফিগো বোধহয় একমাত্র ব্যতিক্রম) বেশ কয়েকজনের মাতৃভাষাও ইংরেজি নয়। হোঁচট খেতে খেতে তাঁরা ইংরেজিতে যে সব মন্তব্য করেন, আমার কানে বেশ শ্রুতিমধুর ঠেকে। আর্জেন্তিনা-পোলান্ড ম্যাচটা তাঁদেরও বেহদ্দ-বোকা বানিয়ে দিল।

ম্যাচের প্রিভিউ করতে গিয়ে অতিথিরা বলছিলেন, পোলান্ড যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিপক্ষ, তাদের খেলায় দৃপ্ত ছন্দ আর কৌশলের সৌকর্য দুটোই আছে সম পরিমানে, ফলে ম্যাচের ফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বানী করাটা ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে। স্পষ্টতই তাঁদের মূল্যায়নের পিছনে ছিল সৌদি-আর্জেন্তিনার ম্যাচের ভয়াবহ স্মৃতি, যে দল প্রথমার্ধে এক গোলে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয়ার্ধে সৌদি নাদানদের কাছে দু’গোল হজম করে তাদের ওপর ভরসা রাখা যায় নাকি? হাজার হোক কাগজে কলমে, পারফরম্যান্সের রেকর্ডে পোলান্ড তো সবজে সৌদিদের চেয়ে অযুতগুণ শক্তিশালী দল।

একই আশঙ্কা আমারও ছিল বলেইতো ঘুমকে প্রতিহত করে দুরু দুরু বুকে আমিও জেগে বসেছিলাম। আট বছর আগে ব্রাজিলের মাঠে জার্মানির কাছে হেরে যাওয়ার পরে লিওনেল মেসির চোখে টপটপ করে জল ঝরছে এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্য আমি চোখের সামনে দেখেছি। আমি নিজে সেই ছোট্টবেলা থেকে ব্রাজিলের সমর্থক, চোখের সামনে ব্রাজিলকে জার্মানির কাছে সাত গোল খেতে দেখার পরে ২০১৪-র বিশ্বকাপ আমার কাছে নীরস অর্থহীন হয়ে পড়েছিল, নেহাত ফাইনালের দামী টিকিট নষ্ট করা যায়না বলে আমি মাঠে গিয়েছিলাম। সে যাত্রায় আমার সঙ্গী ছিল বড় আদরের পিসতুতো ভাই সব্যসাচী যে আবার কিনা আই এস ও সার্টিফায়েড আর্জেন্তিনা সমর্থক। ফাইনালে মাঠে ঢোকার আগে সে আবার একগাদা ডলার খরচ করে আর্জেন্তিনা দলের নীল-সাদা ডুরে কাটা একটি বিশেষ জার্সি কিনল। দশ নম্বর। তার ফুটবল দেবতার জার্সি নম্বর। লিওনেল মেসি। ম্যাচের শেষে উন্মত্ত জার্মানরা যখন স্টেডিয়ামে ভিকট্রি-ল্যাপ দিচ্ছে আমাদের স্ট্যান্ডের ঠিক সামনের গোলের একটা পোস্ট ধরে তাতে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মেসি।তার চোখের জল টপটপ করে পড়ে মিশে যাচ্ছে শরীরের ঘামে।

ব্রাজিলের সমর্থক বলে মেসি ভক্ত হবনা, এতটা আহাম্মক আমি নই। আমার সেই ভক্তিগাথা আপনাদের শোনাব অচিরেই। তার আগে ফিরে চলুন রিও দি জেনেইরো থেকে দোহায়।জীবনের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে এসে গ্রুপ স্টেজে বিদায় নিয়ে মেসি বাড়ি ফিরে যাক, আরও কয়েক কোটি মানুষের সঙ্গে আমিও তা চাইনি, চাইনি ফের তার চোখের জল দেখতে।কোনও ম্যাচের আগে একজন খেলোয়াড়ের জন্য আমার প্রাণ কখনও এমন ব্যাকুল হয়ে হু হু করে কাঁদেনি।

তারপর যা হল সেই ম্যাজিকের সঠিক চিত্রায়ন আমার সাধ্যাতীত। দেশের পরিচিত নীল সাদা জার্সিটা লকার রুমে ছেড়ে ফেলে নীল রঙা জার্সি চাপানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘মন্ত্রগুপ্তি’ গল্পের ঈশ্বর পাটনির মতো রূপান্তর হয়ে গেল গোটা দলের, কোনও এক বেণীমাধব চ্যাটুজ্জে এসে ছড়ি বুলিয়ে একটা ঝিমিয়ে পড়া দলের মধ্যে নতুন প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। জার্মান বিমানবাহিনীর ব্লিৎসকির্গ হয়ে সেই প্রাণ আছড়ে পড়ল মাঠে, খেলা নয় একজোট হয়ে তারা ভেল্কি দেখাল, চোখে সর্ষে ফুল দেখল পোলান্ড। ফেনিল দুগ্ধপাত্রে এক ফোঁটা গো-চোনা হয়ে থেকে গেল লিওনেল মেসির পেনাল্টি মিস। হোক, পৃথিবীর মহোত্তম শিল্পীর সৃষ্টিতেও তো ছিটেফোঁটা খুঁত থাকবেই !

2 comments

  1. দুঃখের বিষয় হল, ঐ এক বুড়ো ঘোড়াকে ধরে বাকি দশজন চলছে। তবে মেসি মাঠ কাঁপাচ্ছে, এটা স্বাভাবিক এবং অনস্বীকার্য।

  2. সুললিত গদ্য + ব্যক্তিগত পরিস্থিতি + খেলার বর্তমান অতীতের ভাষ্য — এই তিনে মিলে হয়ে গেছে দারুণ স্বাদু –‘ ককটেল’ , যা এক নিঃশ্বাসে নিঃশেষিত করা ছাড়া উপায় থাকে না !

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *