logo

মারের বদলে মার (২)

  • November 19th, 2022
Suman Nama

মারের বদলে মার (২)

সুমন চট্টোপাধ্যায়

বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, পিঁপড়ে অথবা কাঠবেড়ালি নাকি একদিন আগেই বুঝতে পারে ভূমিকম্প আসছে। মানুষ পারেনা। বাংলার রাজনীতির ময়দানে পিঁপড়ে অথবা কাঠবেড়ালিদের অকস্মাৎ স্পর্ধিত গতিবিধিতে কি কোনও আসন্ন রাজনৈতিক ভূমিকম্পের ইঙ্গিত আছে?

তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একটি এলোমেলো, দিশাহীন, ছন্নছাড়া দল সিপিএমের মতো একটি ‘লেভিয়াথানকে’ বাংলায় কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেবে, ২০০৬ সালেও কেউ তা ভাবতে পারেননি। সে বছরই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ভোটে জিতে বাংলার স্বপ্নের সওদাগর হয়ে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার ঠিক পাঁচ বছর পরে ভুজের মতো বাংলায় যে ভূমিকম্প হয়েছিল সেই তাজা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। তবে মহা-প্রলয় যে একটা আসতে চলেছে ২০০৯ সাল থেকেই একটু একটু করে তা বোঝা যাচ্ছিল। ২০১১-র ভূমিকম্পের ব্যাপকতা অবশ্য কেউ আগাম আন্দাজ করতে পারেননি।

আপাতদৃষ্টিতে চর্মচক্ষে সহসা তেমন বড় অঘটন ঘটার সিঁদুরে মেঘটুকুও কিন্তু চোখে পড়ছেনা। যদিও একথা একই সঙ্গে স্বীকার্য প্রকৃতির অনেক প্রলয়ের মতো রাজনৈতিক প্রলয়ও হয় টর্নাডো নতুবা হড়পা বান হয়ে আচম্বিতে আছড়ে পড়তেই পারে, কালকে দেখা পাকাপোক্ত ইমারত আজই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে তাসের ঘরের মতো। কেননা মানুষের মন বড় বিষম আর জটিল বস্তু, আজ যার গালে চুম্বন এঁকে দেয় আগামীকালই তার মুখে থুতু ছেটাতে পারে। কী ঠিক কিনা?

পরিবর্তনের না হলেও বাতাসে কিন্তু কিঞ্চিৎ অন্য রকম গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে যা শাসকের পক্ষে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। ধীরে ধীরে শাসককে ঘিরে এমন একটি দুর্লঙ্ঘ চক্রব্যুহ তৈরি হচ্ছে যাকে ভেদ করে সসম্মানে বেরিয়ে আসাটা আদৌ সহজসাধ্য হবেনা। জয়ী কে হবে তা নিয়ে অযথা জল্পনায় না গিয়ে এটুকু অন্তত বলে দেওয়া যায় আগামী যুদ্ধ ও যুদ্ধক্ষেত্রগুলির চেহারা হবে অনেকটাই অপরিচিত, অপ্রত্যাশিত, শাসকের পক্ষে চরম উদ্বেগের। যুদ্ধক্ষেত্র আর ততটা মসৃন থাকবেনা, ইতি-উতি পাতা থাকবে লুকোনো মাইন। বলতে পারবনা কেন, বিপদ যখন আসে একা আসেনা, সঙ্গে আরও অনেক বিপদকে জুটিয়ে আনে আঘাতের পর আঘাত হানতে।

উদ্বেগের কারণগুলি হতে পারে এই রকম, যদিও গুরুত্বের বিচারে কোনটা আগে কোনটা পরে সেই হিসেবটা করছিনা। প্রথম বিপদ শাসকের কলুষিত ভাবমূর্তি যার কালো ছায়া গিয়ে পড়েছে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ওপরেও।রাজনীতিতে প্রবেশ করা ইস্তক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির অন্যতম পুঁজি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত সততা, সাদামাটা আটপৌরে জীবনযাপন, দুর্জয় সাহস, আর আপসহীন মনোভাব। বহিরঙ্গটা একই রকম থাকলেও ভিতরে ভিতরে তিনি অনেকটাই বদলে গিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতস্তরে দুর্নীতির অভিযোগ কখনও ওঠেনি, হয়ত উঠবেওনা, কিন্তু তাঁর নাকের ডগায় স্বজন-পরিচিতের বেপরোয়া অনাচার দেখেও তিনি গান্ধারি হয়ে থেকেছেন। যে নৈতিক জোরের ওপর একদা তাঁর রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত ছিল আজ তা অনেকটাই নড়বড়ে।

দ্বিতীয় বিপদ গ্রামে গ্রামে গরীবের হকের টাকায় তাঁর দলের ‘মাল কামানো ব্রিগেডের’ সিঁদ কাটা। একশ দিনের কাজের মজুরি থেকে এরা কাটমানি তোলে এমনকি শৌচালয় তৈরির সামান্য দশ হাজার টাকা অনুদান থেকেও টাকা কেটে নেয়। সব জেলায় ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত আর শহর নগরে পুরসভাগুলির প্রতিটি প্রোকষ্ঠ এখন দুর্নীতির দুর্গন্ধে ম’ ম’। লজ্জা নিবারণের মরীয়া চেষ্টায় সৌগত রায়কে মাঝেমাঝেই বলতে শোনা যায় তাঁর দলের পঁচানব্বই শতাংশ নেতা-কর্মীরাই নাকি সৎ। কর্মীদের কথা বলতে পারবনা, নেতাদের ক্ষেত্রে উল্টোটাই যে সত্যি, নিজের এলাকার ভোটারদের সঙ্গে একান্তে কথা বললেই সৌগতবাবু তা বিলক্ষণ বুঝতে পারবেন।

তৃতীয় বিপদ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সুপরিকল্পিত গতিবিধি। তাদের তদন্তের রেলগাড়ি কোন স্টেশনে এসে থামবে তার ইঙ্গিতগুলি প্রতিদিন একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া দু’রকমই হতে পারে। হয় দল একেবারে সুসংহত হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়তে পারে নতুবা ভেঙে পড়তে পারে চুরচুর হয়ে। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা কঠিন, জলের রঙ যে ক্রমশ ঘোলাটে হচ্ছে সেটা পরিষ্কার।

চতুর্থ বিপদ মৃত সিপিএমের হঠাৎ পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠার মরীয়া চেষ্টা যার পুরভাগে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত, যুক্তিবাদী, সাহসী তরুণ মুখ। হারানো সমর্থনের কতটুকু সিপিএম ফেরত পেতে পারে বা পাওয়া সম্ভব এই মুহূর্তে তার সঠিক সুলুক সন্ধান অসম্ভব। তবে সময়ের দাবি মেনে আলিমুদ্দিনের বর্ষীয়ান নেতারা যে নেতৃত্বের ব্যাটন নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছেন, বাংলার রাজনীতিতে তা নতুন মাত্রা যোগ করেছে অবশ্যই। এই জরুরি কাজটি শাসকদল এখনও পরিকল্পনা মাফিক করে উঠতে পারেনি, হরিনাম সংকীর্তনের বয়স হয়েছে যাঁদের তাঁরাও এখন ভোটে দলের টিকিট পান, ভবিষ্যতেও পাবেন। সত্য কথা বলতে কি এক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তৃণমূল দলে পাতে দেওয়ার মতো কোনও যুবনেতাই নেই। সেই অভিষেকের উত্থান ও বিকাশ হয়েছে দল ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায়, প্রশাসনিক ও দলীয় নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। ক্ষমতায় না থাকা দলের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তাঁর কতটা আছে তা এখনও অপরীক্ষিত।

শেষ বিপদ সংখ্যালঘু ভোট অটুট থাকবে কিনা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব হিসেব উল্টে দিয়ে পরপর তিনবার নবান্নে পৌঁছতে পারলেন তার প্রধান কারণ মুসলিমদের ঢালাও সমর্থন, যার সৌজন্যে ভোটের দাঁড়িপাল্লাটি তাঁর দিকেই হেলে থাকে বারেবারে। সিপিএমের পুনরাবির্ভাব, কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট সেই নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্ককে এলোমেলো করে দিতে পারে কী? আগামী ভোটযুদ্ধগুলিতে এই প্রশ্নটিই হতে পারে ফলাফলের নির্নায়ক। (শেষ)

3 comments

  1. সম্ভবত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি দ্বারা দুর্নীতির পর্দাফাঁস হয়ে শাসকদলের হেভিওয়েট নেতাদের জেলে যাওয়া, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি, বিচারপতিদের দ্বারা জনসমক্ষে আসা , এই সব কারণগুলিই বর্তমান শাসকদলকে কোনঠাসা করে দিয়েছে। ওদিকে ১০০ দিনের কাজ ইত্যাদিতেও ব্যাপক দুর্নীতির ফলে কেন্দ্র থেকে টাকা আটকে দেওয়া, স্ট্রং অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে পরিচিত নতুন স্থায়ী রাজ্যপাল নিয়োগ ইত্যাদিও শাসকদলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
    আর এইসব কারণেই বামদলের পালে হাওয়া লেগেছে বলা যায়। আনিস খানের রহস্যজনক মৃত্যুতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে , শাসক দলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে।
    সমস্ত দিক বিচার করলে , সত্যিই মনে হয় ঈশান কোনে কি মেঘ জমছে ?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *