logo

সেই প্রথম, সেই তো শেষ

  • August 13th, 2022
Suman Nama

সেই প্রথম, সেই তো শেষ

সেই প্রথম, সেই তো শেষ

সুমন চট্টোপাধ্যায়

১৯৮৪ সালের গোড়ার দিকে আমি কলকাতায় আনন্দবাজারের রিপোর্টিং বিভাগে জায়গা পাই, তার আগে বেশ কয়েক মাস একটা প্রস্তাবিত অথচ প্রকাশিত না হওয়া কাগজে ভ্যারান্ডা ভাজার পরে।

দিন-কাল তখন অন্য রকম ছিল। সে সময় সদ্য হাতেখড়ি হওয়া রিপোর্টারদের ম্লেচ্ছ মনে করা হত, যে কাজ কেউ করবে না বা করতে চায় না, তাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত সেই সব আ্যাসাইনমেন্ট- কর্পোরেশনে গিয়ে একবার চর্কি কেটে এস, লেখার মতো কিছু পেলে এক প্যারাগ্রাফ লিখতে পার। অথবা লালবাজারে কলকাতা পুলিশের প্রাত্যহিক বৈকালিক ব্রিফিংটা শুনে এস, দুর্ঘটনা-টটনার খবর থাকলে দু’লাইন লিখে দিওখন! বৃথা পরিশ্রম, কেননা সবাই জানত সে সব খবরের চূড়ান্ত গন্তব্য হবে বার্তা সম্পাদকের টেবিলের তলায় রাখা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট! তবু যেতে হতই, বেড়ালের ভাগ্যে যদি ভুল করে কোনও ভাল খবরের শিকে ছেঁড়ে!

প্রথম দিনেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল কলকাতা কর্পোরেশনের বাৎসরিক বাজেট কভার করতে। কিছুই নয় নবাগতকে একটু বাঁশ দেওয়া আর কি, কলেজের প্রথম দিনে নতুন ছাত্রকে হেনস্থা করার মতো। আমি আনন্দবাজারের রিপোর্টিংয়ে জায়গা পাই, অনেক সহকর্মীই তা সানন্দে মেনে নিতে পারেনি, সম্ভবত তারাই চিফ রিপোর্টারকে একটু চুলকে দিয়েছিল আমাকে টাইট দেওয়ার জন্য। প্রথম বলেই মাথা লক্ষ্য করে আসা সেই বাউন্সার কী ভাবে বাপি বাড়ি যা করে দিয়েছিলাম, এর আগে অন্যত্র সে কথা লিখেছি, অযথা তার পুনরাবৃত্তি করছি না। আজ বরং আপনাদের প্রথমবার লালবাজারে খবর করতে যাওয়ার গপ্পো শোনাই।

লালবাজারের নাম শুনলে সেই অল্প বয়সে শরীরে বেশ এক ধরনের রোমাঞ্চ হত। প্রথম দিন বেশ উত্তেজিত হয়েই লালবাজারে গেলাম, হাজার হোক কলকাতা পুলিশের সদর কার্যালয়, ইংরেজদের হাতে যত্ন করে বানানো, লোকে বলে পুলিশি দক্ষতায় নাকি একেবারে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সমতুল্য। অফিসের কার্ড দেখিয়ে বীরদর্পে ঢুকলাম ঠিকই কিন্তু বড় লাল দালানটায় ঢোকার প্রবেশাধিকারই পেলাম না। প্রেস ব্রিফিং কভার করতে এসেছি শুনে গেটের রক্ষী আমাকে পিছনের দিকের বাড়ির একতলায় একটা ঘর দেখিয়ে দিল। ঠিক বিকেল চারটেয় ব্রিফিং করতে যিনি এলেন তার চেহারা দেখেই আমার মেজাজ চটকে ‘চ’। পরনে সিভিল ড্রেস, উচ্চতায় পাঁচ ফুট হবেন কি না সন্দেহ, শ্যামলা গায়ের রং, বিনয়ের অবতার হয়ে গলা নামিয়ে খুবই ভদ্রভাবে কথা বলেন। ছাতি-ওচানো পুলিশ বললে চোখের সামনে যে চেহারাটা ভেসে ওঠে তার সঙ্গে কোনও মিলই নেই ভদ্রলোকের। বরং প্রথম চোটে দেখলে মনে হতে পারে হয় কোনও প্রাইমারি ইস্কুলের শিক্ষক অথবা ফেয়ারলি প্লেসের শান্ত-শিষ্ট কেরানি। এমন একজন পান্তাভাতে ভদ্রলোক করবেন পুলিশের ব্রিফিং? সামনে দাঁড়িয়ে পাড়ার যে কোনও মাস্তান জোরে হাঁচি দিলেই তো ভদ্রলোকের কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যাবে, তাহলে? তাহলে আবার কি, তখন সেটাই ছিল রীতি।

চাকরি রক্ষা করতে গিয়েছি, গম্ভীর মুখে একেবারে সামনের সারিতে গিয়ে বসলাম ইস্কুলের ফার্স্ট বয় হয়ে। ততক্ষণে আরও ১০-১২জন রিপোর্টার সেই ঘরে যে যার জায়গায় বসে পড়েছে, তাদের একজনও আমার পরিচিত নয়। তাদের হাবভাবে স্পষ্ট তারা বিকেলের লালবাজারের নিয়মিত খরিদ্দার। ফলে একটু অস্বস্তি তো লাগছিল বটেই। নিজের চেয়ারে বসে ভদ্রলোক প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে একটা নস্যির ডিবে বের করলেন প্রথমেই। ডিবের চেহারা দেখেই বুঝলাম এন সি নস্য, আমার বাবাও নিতেন কি না ! দু’চিমটে দুটি নাসারন্ধ্রে ঢুকে পরার পরেই ভয় হল ভদ্রলোক এ বার নিশ্চয়ই মস্ত কয়েকখানা হাঁচি দেবেন, তার কয়েকটা ড্রপলেট ছিটকে এসে পড়তে পারে আমার চোখে-মুখেও। কিন্তু তেমন কিছুই হল না, বেশ বোঝা গেল নিতে নিতে নস্যির সঙ্গে ভদ্রলোকের নাসিকার বেশ প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া তখন করোনা-ত্রাসের দিন তো নয় যে মানুষ দেখলেই ভূত দেখার মতো তিন পা লাফিয়ে সরে যেতে হবে। হাঁচি-কাশির ছিটেফোঁটা গায়ে লাগলে লোকে বড়জোর কটমট করে একবার দেখে নিত, খুব বেশি হলে মোলায়েম করে চারটে নোংরা কথা শুনিয়ে দিত, তার বেশি কিছু নয়।

ভদ্রলোকের নস্যি নেওয়া শেষ হতে না হতেই ঘরে চা চলে এল। কাপের চেহারা দেখেই বুঝতে বাকি রইল না, রাস্তার উল্টোদিকের কোনও চায়ের দোকান থেকে তুলে আনা, সঙ্গে দু’টো করে নিমকি বিস্কুট। বোধহয় চা-ওয়ালার দৈনিক নজরানা লালবাজারের নাকের ডগায় দোকান করার দুঃসাহসের বিনিময়ে। চা কেন, কোনও পানীয়তেই তখন আমার কোনও অরুচি জন্মায়নি, অতএব পুলিশের দান হাসি-মুখেই গ্রহন করলাম। কেবল বার কয়েক চুমুক দেওয়ার পরে মনে হল ওই তরলটি যা খুশি হতে পারে, মায় গরম চিরতার জলও। অমন তিতকূটে চা খাওয়ার সৌভাগ্য আমার আর বিশেষ একটা হয়নি।

প্রথমে নস্যি তারপরে চা পর্ব মেটার পরে শুরু হল ব্রিফিং পর্ব। ভদ্রলোক জামার বুক-পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে চোখে চশমা লাগিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকলেন।“ ভাল করে শুনে নিন আজ কী কী জানানোর আছে। দয়া করে একটু মন দিয়ে শুনবেন, বারেবারে রিপিট করা যাবে না। ইতিহাস অনার্স ক্লাসে ঝড়ের বেগে নোট নেওয়ার অভ্যাস ছিল আমার, লালবাজারের পাঁচুর কথায় ঘাবড়ে যাব কেন!

ভদ্রলোক তারপরে খুবই গম্ভীর গলায় পরপর চারটি খবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন, ভাবখানা এমন যেন প্রতিটি খবরই প্রথম পাতায় হেডলাইন হওয়ার মতো। এক) মেটিয়াবুরুজে গতকাল রাতে দু’দল স্থানীয় দুষ্কৃতীর মধ্যে ব্যাপক বোমাবাজি হয়েছে, তিনজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, একজনও এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি। দুই) তালতলা অঞ্চলে একটি বাড়িতে একজন বৃদ্ধার মরদেহ পাওয়া গিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে অনুমান মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক। তিন) পাইকপাড়া অঞ্চলে গতকাল অনেক রাতে একটা ম্যাটাডর ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাথে উঠে পড়ে, চাপা পড়ে একজন ঘুমন্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। পুলিশ ভ্যানটিকে আটক করলেও মৃতের পরিচয় এখনও জানা যায়নি, ড্রাইভারও পলাতক। চার) ঢাকুরিয়ায় এক বস্তি থেকে গতকাল রাতে প্রচুর চোলাই মদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত চারজনকে পুলিশ খুবই তৎপরতার সঙ্গে গ্রেপ্তার করেছে।

আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। ভদ্রলোক নোটবই বন্ধ করে পকেটে ঢোকানোর আগেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘‘সবচেয়ে বড় খবরটাই তো আপনি বললেন না।“ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে তিনি চোখ কুঁচকে জানতে চাইলেন, “কোন খবরটা বলুন তো?” ঘর-ভর্তি লালবাজারি রিপোর্টারদের সক্কলের কৌতুহলী নজর তখন আমার দিকে।

অফিস থেকে হেঁটে লালবাজারে আসার পথে দেখলাম ট্রাম লাইনের গা ঘেঁষে ডজন খানেক সদ্যোজাত কুকুর ছানা শুয়ে আছে। পুলিশ তাদের উদ্ধার করবে না?

অট্টহাসির মধ্যে রাগে গজরাতে গজরাতে সেই যে লালবাজার থেকে বের হলাম আর ও-মুখো হইনি কোনও দিন। অফিসে ফিরে হাত জোড় করে চিফ রিপোর্টারকে বললাম, আমি তো আপনার কোনও ক্ষতি করিনি, করতে চাইও না। আপনি চাইলে ইস্তফা দিয়ে দেব কিন্তু মরে গেলেও লালবাজারের ব্রিফিংয়ে যাব না।”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *