logo

আই টু অ্যাম ফ্রান্স

  • December 14th, 2022
Suman Nama

আই টু অ্যাম ফ্রান্স

সুমন চট্টোপাধ্যায়

একটি ফরাসি খেলার দৈনিক প্রথম পাতায় শিরোনামে লিখল, ‘ এবার থুরামকে প্রেসিডেন্ট করা হোক’। কেউ কেউ বলল, প্রেসিডেন্ট না হয় পরে হবেন, আগে তো থুরামের একটা পূর্ণাবয়ব মূর্তি তৈরি হোক। সঁ জে লিজের রাতজাগা সমুদ্র-সমান জনতার মুখে ঘনঘন উচ্চারিত হচ্ছে একই সঙ্গে দু’টি নাম। থুরাম, থুরাম, থুরাম। জিদান, জিদান, জিদান।

সে রাতে জনতার ভিড়ে হতবাক হয়ে আমিও দাঁড়িয়েছিলাম। তার কিছুক্ষণ আগেই প্যারিসের স্তাদ দঁ ফ্রান্স স্টেডিয়ামে রোনাল্ডো-রিভাল্ডো-রবার্তো কার্লসদের ব্রাজিলকে দু’গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে ফ্রান্স। এ তো কেবল আত্মহারা উন্মাদনা নয়, ঠিক যেন শঁ পা-র বোতল থেকে উপচে পড়া ফেনা। কী সুন্দরী যে দেখাচ্ছিল সে রাতের পারীকে, কলকাতার পরেই আমার প্রিয়তম শহর। বিশ্বকাপ ফাইনালের পরে বিজয়ী দলের সমর্থকদের উন্মত্ত উল্লাস তো বার কয়েক হলেও দেখেছি, বিশেষ করে ব্রাজিলিয়ানদের। সৌন্দর্যে, সৌকর্যে, আভিজাত্যে, সঁ জে লিজের সেই রাতের উৎসবকে আমি এগিয়ে রাখব বাকি সব অভিজ্ঞতার কয়েক যোজন আগে।

ফ্রান্সের থিম সং ছিল ‘ ম্যাজিক ইন দ্য এয়ার’! গোটাটাই মনে হচ্ছিল ইউটোপিয়া, একটি সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ দেশে এও কি সত্যিই সম্ভব? ফ্রান্সের হয়ে ফুটবলের সেরা সম্মানটি কেড়ে এনেছিল যারা তাদের বেশির ভাগই নানা কারণে স্বদেশ-ত্যাগী ইমিগ্রান্ট সন্তান- ক্যারিবিয়ান, ওয়েস্ট আফ্রিকান, আলজেরিয়ান, আর্মেনিয়ন..। অথচ নাগিরক পরিচয়ে সবাই ফরাসি। এমন রামধনু রঙা বহুজাতিক মহামিলন তো সবার আগে ফরাসি দেশেই সম্ভব কেননা এই দেশটাই তো বাকি দুনিয়াকে দীক্ষিত করেছিল, “লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্র্যাটার্নিটির’ মন্ত্রে। বাস্তিল দুর্গের পতন, তার সাক্ষীও তো এই মহামানবের শহর।

লিলিয়ান থুরামের জন্ম গুয়াদালুপে, আলজেরিয়া ছেড়ে আসা বাপ-মায়ের সঙ্গে জিদানের বড় হয়ে ওঠা মার্সেই শহরের গরীব মহল্লায়। বিশ্বকাপের ফাইনালের পরে এরা দু’জনেই রাতারাতি হয়ে গেল ফ্রান্সের জাতীয় আইকন। এখন যেমন তরুন তুর্কি এমবাপে, যার আদি বসত ক্যামেরুনে। ১৯৯৮ থেকে ২০২২, গাত্র-বর্ণের বিবিধতার ঐতিহ্যটা প্রায় একই আছে। উবে গিয়েছে ওই ইউটোপিয়া। কেননা সেদিন মরুদ্যান ভেবেছিলাম যাকে আজ বুঝি আসলে সেটা মরীচিকা। ওপরটা ছলছল, চিমটি কাটলেই বাস্তবটা বে-আব্রু।

ক্লিন্ট স্মিথ নামের এক ফুটবল ঐতিহাসিক প্রকৃত সত্যটি উদ্ঘাটন করেছেন এই ভাষায়।’ International football invites us to imagine countries not so much as they are but as they might be.’ চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসলে আমরা নিয়ম করে এই ভুলটাই করি। যা হতে পারত সেটাকে ধরে নিই যা হচ্ছে বলে। ভুলে যাই একটি নাগরিকত্বের সরকারি শিলমোহর লাগানো কাগজ কখনও ভিনদেশিকে তার আশ্রয়স্থলে সমানাধিকার দিলেও সমান মর্যাদা দিতে পারেনা। দত্তক নেওয়া সন্তান, তা সে যত প্রতিভাধরই হোক, এক দেহে বিলীন হতে পারেনা কিছুতেই। উদাহরণ এই ফরাসি ফুটবল দল এবং তাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের অন্দরের তীব্র মতানৈক্য।

মাত্র বছর দুয়েক আগেই ফ্রান্সের জনপ্রিয় অতি-দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের বর্ণবিদ্বেষী নেত্রী জঁ মেরি লি পেন প্রকাশ্যে বলেছিলেন তাদের ফুটবল দল আসলে‘ বিদেশি আর নকল ফরাসিদের’ খিচুড়ি। লিলিয়ান থুরাম তাঁর নিজস্ব মঞ্চ থেকে এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তবু অসাম্যের বিরুদ্ধে থুরামের লড়াইটাও কি সম্পূর্ণ অসম নয়? ফরাসি সমাজের বর্ণ-কাঠামোয় কি চোখে পড়ার মতো কোনও রদবদল এসেছে? সাম্য অথবা ভ্রাতৃত্বের সুললিত লব্জের পিছনটা কি নিকষ কালো অন্ধকারই রয়ে যায়নি? আশ্রিত ফ্রান্সে প্রকৃত নাগরিকের মর্যাদা পাবে একমাত্র সাংস্কৃতিক সাযুজ্য থাকলে তবেই। ব্যক্তি পরিচয়ের মধ্যে কোনও হাইফেন ঢুকে পড়ুক ফরাসিরাও তা চায়না। এটাই হকিকত।

বহু বর্ণে রঞ্জিত একটি ফুটবল দলের হাতে বিশ্বজয়ের ট্রফি ওঠার গুরত্ব যে নেহাতই প্রতীকী, তাকে কেন্দ্র করে জনতার উচ্ছাসও যে মদ্যপানের নেশার মতো সাময়িক, ফ্রান্সের আর এক দিকপাল ফুটবলার করিম বেনজামা তা চমৎকার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একটি মন্তব্য করেই। ‘ আমি যখন গোল করি তখন আমি ফরাসি, না করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে আমি আরব।’ বছর বারো আগে ফ্রান্সের ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে গোপন বৈঠক করে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন দেশের ইয়ুথ লিগগুলিতে আফ্রিকান খেলোয়াড়দের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করার জন্য কোটা সিস্টেম চালু করা হবে। করা যায়নি কারণ খবরটি মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, শোরগোল পড়ে গিয়েছিল ফুটবল বিশ্বজুড়ে। ফ্রান্সের তৎকালীন জাতীয় দলের ম্যানেজারও সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। খবর ফাঁস হওয়ার পরে তার চাকরিটা চলে যায়।

সেই বর্ণবিদ্বেষী ম্যানেজারের শূন্যস্থান পূরণ করেন দে শঁ, ২০১২ সালে। ১৯৯৮ সালের বিশ্বজয়ী ফরাসি ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি, আপাদমস্তক পেশাদার, জীবনে কখনও সাদা-কালোর তফাত করেননি। ২০১৮-র বিশ্বকাপের আগে তিনি সম্ভাব্য দলের যে প্রাথমিক তালিকা তৈরি করলেন তাতে দেখা গেল কৃষ্ণাঙ্গরাই দলে ভারী। গিনিয়া থেকে আসা পল প্রোগবার পাশে সেই তালিকায় দেখা গেল আরও দুটি নতুন মুখ- কিলিয়ান এমবাপে আর এনগোলো কান্তে।বিশ বছর পরে সেই দল নিয়ে মস্কোয় দে শঁ ফের বিশ্বকাপ জিতলেন, এবার কাতারেও অবলীলায় সেই দল পৌঁছে গিয়েছে সেমিফাইনালে। রোনাল্ডো-মেসির যুগাবসানের সন্ধিক্ষণে দে শঁর কল্যানে ফুটবল বিশ্ব ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে উদীয়মান সুপারস্টারকে। এমবাপে।

লি পেন কিংবা তাঁর দল আর মুখ খোলার সাহস পায়নি। বরং দেখে শুনে মনে হচ্ছে তাদের থোঁতা মুখ এখন ভোঁতা। চার বছর আগে টেলিভিশনে দেখা সেই দৃশ্যটি আমি এখনও ভুলতে পারিনি। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে বিশ্বজয়ী দলের সম্বর্ধনার আয়োজন হয়েছে, একে একে প্লেয়াররা এসে বসছেন। কান্তে সঙ্গে নিয়ে এলেন তাঁর জন্মদাত্রীকে। আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা। পোগবাকে দেখেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’সালাম আলেইকুম’। এক অঙ্গে তিনটি পরিচয়- ফরাসি, আফ্রিকান ও মুসলিম।

দৃশ্যটি দেখে আমার মনে হল সবাই যেন পরস্পরকে বলছে, ‘ আই টু অ্যাম ফ্রান্স।’

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *