logo

কবিতাতেই ক্ষতের মলম খুঁজে চলেন গাজার তরুণ কবির দল

  • August 16th, 2022
Arts and Literature

কবিতাতেই ক্ষতের মলম খুঁজে চলেন গাজার তরুণ কবির দল

নিজস্ব প্রতিবেদন: জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হাসতে দেখেছেন কখনও, কাউকে?
গাজার কবি-সম্প্রদায়ের দিকে চোখ রাখুন, দেখতে পাবেন। গাজা, ২০০৬ থেকে ইসলামিক সংগঠন হামাস-দ্বারা শাসিত, ভূমধ্যসাগরের পুব-উপকূলের বিতর্কিত ভূখণ্ড। যার উপর বোমা পড়ে যখন তখন। কবির কলম থেকে কবিতা নিঃসৃত হওয়ার মতো স্বতঃস্ফূর্ততায়। যে কোনও সময়ে শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। থেমে যাবে জীবন। এ কথা জেনেই কবিতা লিখে চলেন গাজার কবি। বারুদ আর প্রেম পাশাপাশি ঠাসা থাকে সে কবিতার অন্দরে।

২০১৮-র জুলাই মাসে গাজার প্রথম বাচিক-অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। গাজা ইয়ুথ স্পিকস। ২৫ জনেরও বেশি কবি ইংরেজি এবং আরবি ভাষায় স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। তাঁদেরই একজন মহম্মদ মুসা। গত ৮ জুন আল জাজিরা-এ একটি হৃদয়স্পর্শী প্রতিবেদনে লেখেন অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণের মুখে উৎসারিত তাঁদের প্রতিটি কবিতা-অক্ষরের কথা।

সামির মনসুর, গাজার সবচেয়ে বড় বইঘর-কাম-ক্যাফে। বই কেনা,বই নাড়াচাড়া করা, কফি খেতে খেতে নিরালায় বই পড়া, কিম্বা কাজ করা। সব চলে এখানে। বই, কফি, ধূপকাঠির পাঁচমিশেলি গন্ধ। স্তূপীকৃত বই আর সামির মনসুর-লেখা ওই হলদে ব্যানার গাজার সব বইপাগল পড়ুয়ার প্রিয় গন্তব্য। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র মহম্মদ মুসা বন্ধুদের কাছে খবর পেয়ে পৌঁছেছিলেন সেখানে। উপন্যাস, কবিতা, বিশ্বসাহিত্যের খোঁজে। প্রথমবার ঢুকে শ’য়ে শ’য়ে, হাজার হাজার বই দেখে এমন মাথা ঘুরে গেছিল তাঁর যে প্রয়াত প্যালিস্তিনীয় কবি মাহমুদ দারুইশ-এর কবিতা সংকলন আর আরবি অনুবাদে একটি রুশ উপন্যাস ছাড়া আর কিছু কিনে উঠতে পারেননি সে বার।

গাজার সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান ছিল সামির মনসুর। বড় নয় শুধু, কিংবদন্তি-স্বরূপ। আমাদের কলেজ স্ট্রিটের মতো। আজ সেখানে পড়ে আছে হাতে-গোনা ক’টা বই। তার মধ্যে অন্যতম ঘাসান কানাফানি-র লেখা ‘রিটার্নিং টু হাইফা’। ১৯৪৮-এ নাকবার সময়ে তাঁদের শিশুসন্তানকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হন এক প্যালিস্তিনীয় দম্পতি। ১৯৬৭-র যুদ্ধের পর তাঁরা হাইফা ফিরে যান সেই সন্তানকে খুঁজতে। যুদ্ধ আর সন্ত্রাসের সমস্ত আগুন, সমস্ত ধোঁয়া তুচ্ছ করে অদ্ভুত ভাবে রয়ে গিয়েছিল এই বইটা। হারিয়ে যাওয়া দেশ, হারিয়ে ফেলা হাইফাকে ফিরে পাওয়ার জন্য গাজার মানুষের তীব্র গনগনে আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবেই সম্ভবত!

গত ১৮ মে ভোরবেলা, ৬টাও বাজেনি তখনও। ইজরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হানায় মাটিতে মিশল সেই বইয়ের দোকান। ঘুম ভেঙে, এ খবর পেয়ে মহম্মদ মুসার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল কত দৃশ্য! কত বইয়ের প্রচ্ছদ। যে সব বন্ধুরা সেখানে সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মুখ। ছাই হচ্ছিল বই, পুড়ছিল মানুষের সম্মিলিত স্মৃতিও। এক লহমায় অতীত হয়ে গেল শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।

মহম্মদ মুসার মেদুর স্মৃতিচারণে তাঁর প্রথম কবিতা লেখার কথা এসেছে। ২০১৪ সাল, গাজার উপর প্রায় প্রতিদিন বোমাবর্ষণ করছে ইজরায়েল। দিনে যে তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ থাকত, তখন কাজ বলতে রেডিও শোনা। বাকি সময়ে জানলার ধারে বসে বোমা, ড্রোন আর অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজে শিউরে ওঠা। এমনই এক দিনে মুসা লেখেন তাঁর প্রথম কবিতার প্রথম পংক্তি। ‘গাজায় জন্ম হয়েছিল আমার।’ (I was born in Gaza)। ভয়, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা, শিকড়ের প্রতি টান সবকিছু গলগল করে বেরিয়ে এসেছিল সে কবিতায়। লেখা শেষ হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন কবিতাটি। লাইক, শেয়ারে ভেসে যায় মুসার কবিতা, কবিতার অন্তর্নিহিত বার্তা।

গাজায় বড় হয়ে ওঠা একটা অভিজ্ঞতা বটে! তার চেয়েও অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, গাজায় কবিতা লেখা। কবিতা এখানে যুদ্ধ-আক্রমণ-আগ্রাসনের চোখে চোখ রেখে বসে থাকে ক্ষেপণাস্ত্র আর আগুনের মুখোমুখি। কবিতা বসে থাকে প্রেম, শোক, বিরহ, বার্ধক্য, অশ্রু আর প্রকৃতির পাশেও। এখানে,গাজায়। যেমন দেশ প্রাপ্য আর যেমন দেশে পেয়েছি, তার বৈপরীত্যে কবিতা জন্ম নেয়। হৃদয়-নিংড়ানো যন্ত্রণা থেকে, হৃদয়েরই ওম মেখে জন্ম নেয় কবিতা।

২০১৮-এ মুসার উদ্যোগে গড়ে ওঠে গাজা পোয়েট্স সোসাইটি। সদ্য কবি হয়ে ওঠা এবং কবি হতে চাওয়া তরুণ-তরুণীদের সংগঠন। তাঁরা একসঙ্গে বসে ভাবের আদানপ্রদান করতেন। পরস্পরের লেখা শুনতেন, মতামত দিতেন, গান গাইতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কবিরা কী লিখছেন, তা নিয়ে আলোচনাও করতেন। যোগাযোগ গড়ে তুলতেন তাঁদের সঙ্গে। ইজরায়েলের দ্বারা সামির মনসুর ও অন্যান্য শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের আক্রান্ত হওয়া গভীর বেদনার মতো বেজেছিল এঁদের কাছে। এই বেদনা ফুটে উঠেছে তাঁদের সদ্য-রচিত কবিতায়।

মধ্য-গাজার বাসিন্দা ১৮ বছরের তরুণী নাদিন মূর্তাজার কাছে বেঁচে থাকাটাই একটা ম্যাজিকের মতো। বোমা-ধ্বংসস্তূপ -রক্তপাতের মরুভূমির মধ্যে কবিতা তাঁর কাছে ওয়েসিসের মতো, এ কথা বুঝে ফেলার পর থেকে কবিতাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রতিটি অশ্রুবিন্দু। প্রতিটি প্রতিবাদের আধার। যে ধস্ত বাস্তবের ভিতর তাঁর বসবাস, তাকে অগ্রাহ্য করে এক মায়াবাস্তব তিনি গড়ে তোলেন শব্দের মধ্য দিয়ে। নাদিন স্বভাবে গোপনচারী। না-বলতে পারা কথাদের তীব্র স্পন্দনে ধকধক করে তাঁর কবিতার শরীর। ‘আমরা হেঁটে যাই ভাঙা জানলার কাচের উপর দিয়ে, অজস্র পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে চলি আমরা, যে পাথরে তৈরি আমাদের বাড়িগুলো অক্ষত দাঁড়িয়ে ছিল, একটু আগেও…’ গাজায় সদ্য ঘটা ইজরায়েল-হানার পরে লেখা নাদিনের কবিতার দুটো লাইন।

প্যালেস্তিনিয় কবি মাহমুদ দারউইশ (১৯৪১-২০০৮) নাদিনের প্রিয়তম কবি। পাঠ্যবইয়ের পাতায় আর শরণার্থী শিবিরের দেওয়ালে লেখা তাঁর কবিতা পড়ে বড় হওয়া প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্যালিস্তিনিয়দের জাগ্রত বিবেক মাহমুদ দারউইশ। দারউইশের মতোই, বাস্তব পৃথিবীর রূঢ়তা নাদিনের কবিতা লেখাকেও থামাতে পারেনি। আবেগের মিশেলে সহনীয় করে তুলেছে সেই রূঢ়তাকে। বাইরের পৃথিবীর মানুষের কাছে নাদিনের আবেদন — প্যালেস্তাইন তোমাদের জাতীয় কিম্বা রাজনৈতিক সমস্যা নয় বটে, তবু এটুকু ভুলো না যে প্রথমত এবং শেষ পর্যন্ত, মানবিক সমস্যা এটা।

মধ্য গাজার দিয়ের-আল-বালাহতে অবস্থিত আল-নুসাইরাত শরণার্থী শিবির। ১৯৪৮ এ নাকবা-র সময়ে পালিয়ে আসা মানুষ ও তাঁদের বংশধরদের বাসস্থান। ৮০,০০০ শরণার্থীর বাস এই উপচে-পড়া শিবিরে। তাঁদের অন্যতম ২২ বছরের মাহা জারাবা, গাজা পোয়েটস সোসাইটির আর এক সদস্য। তাঁর কাছে এই দমবন্ধ-করা পরিবেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা, অন্ধকার জীবনে একফালি আলো আসার একমাত্র জানলা, কবিতা। কবিতার ডানা মেলে তিনি উড়ে বেড়ান ইচ্ছেমতো। সমস্ত রাগ আর অসহায়তাকে ভাসিয়ে দেন কবিতার সমুদ্দুরে। জারাবার বন্ধ জীবনে একমাত্র মুক্তির ঠিকানা কবিতা। গাজার মতো ঘন অন্ধকারময় অভিশপ্ত দেশে জন্ম বলেই কবিতা এসেছে জারাবার। তাঁর মতো আরো বহু ছেলেমেয়ের কলমে।

কবিতা মাহা-র প্রতিবাদেরও হাতিয়ার। যে বর্বরতা, হিংস্রতা, অবরোধ, গণহত্যাকে পাশ কাটিয়ে, সমস্ত রকম মানবাধিকার বর্জিত হয়ে বেঁচে থাকেন প্যালেস্তাইনের মানুষ, তার প্রতি সারা পৃথিবীর মানুষ অন্ধ-বধির হয়ে থাকুক। নিজের মতো করে প্রবাদ জানিয়ে যাবেন মাহা। কবিতাই হবে তাঁর অস্ত্র। ‘বোমা পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে আমি লিখি। আমি লিখি প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর কানে নিয়ে। আজ এখানে আছি, কাল হয়তো ওখানে। আজকের আমির সঙ্গে আগামীর আমিকে জুড়েছে হাড়হিম ভয়ের সেতু।’ বাইরের পৃথিবীর কাছে মাহা জারাবার বার্তা, ‘আমরাও স্বপ্ন দেখি, সুন্দর এক আগামীর স্বপ্ন। শুধু ভয়, অশান্তি আর দুর্দশা নয়, প্রাণভরে বাঁচার অধিকার আছে আমাদেরও।’

গাজার সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির জাবালিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা ২৩ বছর-বয়সি ওমর মুসা পেশায় সাংবাদিক। গাজা পোয়েট্স সোসাইটির সদস্য। দমবন্ধ করা এক সময়ে বেঁচে থাকা ওমরের কাছে কবিতা শ্বাসবায়ুর মতো। শীতল ধারাস্নানের মতো। মৃত্যু আর ধ্বংসের মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়ানো নাম-না-জানা বুনো ফুলের মতো। কঠিন বাস্তবকে এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া নয়, ক্ষণিকের ভুলে থাকা, নিজেকে নতুন করে চেনা, কবিতার হাত ধরে। মাহমুদ দারউইশ তো বটেই, তা ছাড়াও মুসার প্রিয় কবিরা হলেন চিলির কবি পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩), মিশরীয় কবি আমাল দানকাল (১৯৪০-১৯৮৩) এবং আহমেদ বাখিত। ‘কবিতা লেখাই আমার নিয়তি, সে কবিতা কখনও জীবনকে উদ্যাপন করে, কখনও মৃত্যুকে। আমি শুধু আগ্রাসনের হলাহল হৃদয়ে ধারণ করে বেঁচে থাকি এই মুহূর্তটুকু!’, বলেন ওমর মুসা।

এভাবেই লিখে চলেন, চলছেন গাজার তরুণ কবিরা। অত্যাচারের মুখে দাঁড়িয়ে, দেশ-কালের সীমা পার করে, এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, অন্য হাতে রণ-তূর্য নিয়ে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *