logo

বরকত সাহেব ও একটি অবাঞ্ছিত বিতর্ক

  • August 13th, 2022
Reminiscence, Suman Nama

বরকত সাহেব ও একটি অবাঞ্ছিত বিতর্ক

বরকত সাহেব ও একটি অবাঞ্ছিত বিতর্ক

সুমন চট্টোপাধ্যায়

(ভোট চলছে বঙ্গে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁদের সরব উপস্থিতি ব্যতিরেকে বঙ্গে ভোট-রঙ্গের কথা ভাবাই যেত না। তাঁরা নেই, আবার আছেনও, আমার স্মৃতি ও সত্তায়। তেমনই কয়েকজন বঙ্গ-রাজনীতির মহারথীদের নিয়ে আমার এই সিরিজ। এ বার আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরী। প্রথম পর্ব)

যতদিন বেঁচে ছিলেন সিপিএম বারেবারে মরিয়া চেষ্টা করেছিল৷ তাঁকে হারাতে পারেনি৷ অনেক বছর হয়ে গেল তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন এবং কী আশ্চর্য, তাঁর নাম ভাঙিয়েই পরিবারের বিবিধ সদস্যেরা দিব্যি জিতে গিয়েছেন উপর্যুপরি নির্বাচনে৷ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ইতিহাসে তো বটেই, গোটা ভারতবর্ষে আর কোথাও কোনও নেতার ক্ষেত্রে এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না৷ গৌড়বঙ্গের মালদায় আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরী এমনই এক অত্যাশ্চর্য ‘মিথ’৷ তিনি নেই তবু ভীষণ ভাবেই বেঁচে রয়েছেন জেলার রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে৷

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি যেমন কংগ্রেসকে ছাড়তে পারেননি, তেমনি বরাবর সিপিএমকেই রাজ্য-রাজনীতিতে কংগ্রেসের পয়লা নম্বর দুশমন বলে মনে করে এসেছেন৷ জীবদ্দশায় যে সভাতে যেতেন সেখানেই তাঁর ভাষণে কতকটা অবধারিত ভাবে শোনা যেত একটাই বুলি – এ বার সময় এসেছে সিপিএম দলটাকে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার৷ সে কাজটা অবশ্যই তিনি পারেননি৷ কিন্তু নিজের খাসতালুকে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কমিউনিস্টদের তিনি সে ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতেই দেননি৷ গনি খান চৌধুরী আর মালদা ছিল আক্ষরিক অর্থেই সমার্থক৷

১৯৮৩-র ডিসেম্বরে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ আই সি সি-র অধিবেশনে আমি প্রথম চাক্ষুষ করি বরকত সাহেবকে৷ ইন্দিরা গান্ধী তো ছিলেনই৷ তবে সেই অধিবেশনের মূল আকর্ষণ ছিলেন রাজীব গান্ধী৷ মায়ের অনুরোধে প্রয়াত ভাইয়ের শূন্যস্থান পূরণ করতে তার অনতিকাল আগেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের ব্যবস্থাপনা পেশাদারি দক্ষতায় সামলেছেন এবং এআইসিসি-র নতুন সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়েছেন৷ অধিবেশনের শেষ দিনে আমার অগ্রজ নিখিল সরকার (শ্রীপান্থ নামেই যিনি বেশি পরিচিত) একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন রাজীব গান্ধীর, আমি তাঁকে সাহায্য করেছিলাম৷ রাজীব প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে অসংখ্য প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ঠান্ডা মাথায়, তাঁর দু’পাশে দু’টি চেয়ারে সারাক্ষণ বসেছিলেন তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের দুই প্রধান মুখ, প্রণব মুখোপাধ্যায় আর বরকত সাহেব৷ কাকতালীয় ভাবে পরের বছর ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার দিনেও মেদিনীপুরে প্রচাররত রাজীবের সঙ্গে ছিলেন এঁরা দু’জনেই৷ সেদিন দুপুরে বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে রাজীবের সহযাত্রীও ছিলেন এঁরাই৷ তখন অবশ্য বরকত সাহেব বা প্রণববাবু কেউই আন্দাজ করতে পারেননি ইন্দিরা গান্ধীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁদের জীবনেও নিয়ে আসবে অসীম দুর্দশা৷

ওই বিমানে দিল্লি যাওয়ার সময় প্রণব মুখোপাধ্যায় কি অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন? সে জন্যই কি ভোটের পরে রাজীব তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন? প্রণববাবু সত্যিই যদি এমন কথা না বলে থাকেন তাহলে তাঁর সম্পর্কে এমন একটি গুজব ছড়াল কে? গুজবের উৎস তাহলে কি ছিলেন বরকত সাহেবই? তারপরেও বহুদিন এই সব প্রশ্ন আন্দোলিত করেছিল দিল্লি-কলকাতার রাজনীতিকে, বেজায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল প্রণববাবুকেও৷

তাঁর স্মৃতিকথার যে দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিতে সে দিন দিল্লিগামী বিমানে এবং রাজধানীতে ঠিক কী কী হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি৷ এই বিশদ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় বিষয়টি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ বোঝা যায় মাঝখানের এতগুলি বছর তাঁর কেমন যন্ত্রণাবিদ্ধ অবস্থায় কেটেছে৷

১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর ওই বিশেষ বিমানে রাজীব, প্রণব, বরকত ছাড়াও সওয়ার হয়েছিলেন অনেকেই৷ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল উমাশঙ্কর দীক্ষিত, তাঁর পুত্রবধূ শীলা, লোকসভার অধ্যক্ষ বলরাম জাখর, রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান শ্যামলাল যাদব এবং সংসদে কর্মরত আরও বেশ কয়েকজন অফিসার৷ প্রথম সারির বাঁদিকের তিনটি আসনে পরপর বসেছিলেন রাজীব, উমাশঙ্কর ও প্রণব৷ ডানদিকে বলরাম জাখর, শ্যামলাল যাদব ও গনি খান চৌধুরী৷ বিমান ছাড়ে দুপুর একটা নাগাদ৷ তখনও পর্যন্ত বিমানযাত্রীদের কেউই নিশ্চিত নন ইন্দিরা গান্ধী জীবিত না মৃত৷ প্রণববাবু লিখেছেন, টেক-অফ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজীব আসন ছেড়ে উঠে চলে যান ককপিটে৷ কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে ঘোষণা করেন, ‘শি ইজ ডেড’৷ খবরটা শোনা মাত্রই তাঁর দু’চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করে, অচিরেই অঝোর অশ্রুধারা৷

কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে আসে সকলের, শুরু হয় এই অপ্রত্যাশিত সঙ্কটে আশু কর্তব্য কী কী তা নিয়ে আলোচনা৷ প্রণববাবু লিখছেন, “আলোচনায় যোগ দিয়ে আমি প্রথমে অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে ধরি, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নেহরু ও শাস্ত্রীর মৃত্যুর পরে কী হয়েছিল সে কথা৷ দু’বারই অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গুলজারিলাল নন্দ শপথ নিয়েছিলেন কেননা, তিনিই ছিলেন প্রবীণতম মন্ত্রী৷ অবশ্য এই প্রথা মানা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীদের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার পরে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে যা হয়েছে সেটা অভূতপূর্ব, ক্ষমতাসীন একজন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে৷ এর ফলে কেবল যে রাজনৈতিক শূন্যতাই শুধু তৈরি হয়েছে তা নয়, আরও নানা ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে৷ আলোচনার শেষে আমরা সর্বসম্মত ভাবে এই সিদ্ধান্তে আসি যে আমাদের আশু কর্তব্য হবে এই সঙ্কটকালে পুরোদস্তুর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য রাজীবকে অনুরোধ করা৷ সবাই মিলে ঠিক করেন আমিই এই প্রস্তাব তাঁকে দেব এবং যে ভাবে এ কাজ সম্পন্ন করতে হবে তার তদারকি করব৷ এরপরেই রাজীবকে ডেকে নিয়ে আমি বিমানের পিছনের দিকে চলে যাই এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করি৷ রাজীবের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘ডু ইউ থিঙ্ক আই ক্যান ম্যানেজ?’ আমি জবাবে বলি, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারবেন৷ আমরা সকলে আছি আপনাকে সমর্থন করার জন্য, সকলের সমর্থনই আপনি পাবেন৷’ তারপরেই আমি রাজীবকে অনুরোধ করি ককপিটে গিয়ে একটা জরুরি বার্তা দিল্লিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য৷ বার্তাটি হল, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীবের শপথ এবং ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক সরকারি ঘোষণা একই সঙ্গে করতে হবে৷ পরে আমি জানতে পেরেছিলাম উপ-রাষ্ট্রপতি বেঙ্কটরামনও আলাদা করে একই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।”

আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তিনি যে সত্যের অপলাপ করছেন না, ঠিক যা যা হয়েছিল সে কথাই বলছেন, তার সাক্ষী হিসেবে প্রণববাবু নির্ভর করেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সচিব পি সি আলেকজান্ডারের প্রকাশিত ভাষ্যের ওপর৷ আলেকজান্ডার লিখেছিলেন, ‘‘একদল লোক, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পরে এই গুজব রটিয়ে দিয়েছিল যে প্রণব মুখোপাধ্যায় নাকি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে চেয়েছিলেন এবং অনেক পীড়াপীড়ি করে তাঁকে নিরস্ত করা হয়েছে৷ এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল রাজীব আর প্রণবের মধ্যে সচেতন ভাবে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি করা৷ কিন্তু আমি এ কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই আমার প্রস্তাবে (অর্থাৎ সোজাসুজি রাজীবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ানো) প্রণব সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়েছিলেন।”

তাহলে এমন একটি আজগুবি গপ্পো বাজারে চাউর করে দিয়েছিল কে? তাঁর আত্মজীবনীতে প্রণববাবু কোনও ‘অপরাধী’-র নাম উল্লেখ করেননি৷ তবে সেদিনের ঘটে যাওয়া তথ্যগুলিকে এমন ভাবে পেশ করেছেন যা পড়লে একজন সম্পর্কেই সন্দেহ জাগে৷ তাঁর নাম অরুণ নেহরু, রাজীবের জমানার গোড়ার দিকে যিনি কংগ্রেস দলে ও সরকারে কার্যত দু’নম্বর ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন৷

সেদিন ঠিক কী করেছিলেন অরুণ নেহরু? প্রণববাবু লিখেছেন, অরুণ নেহরু চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং-এর প্রত্যাবর্তনের জন্য (তখন তিনি ওমান সফর করছিলেন, ইন্দিরার মৃত্যু-সংবাদ শুনে সেই সফর কাটছাঁট করে ফিরে আসেন) অপেক্ষা না করে উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কটরামনকে দিয়েই রাজীবের শপথানুষ্ঠানটি করানো হোক৷ অরুণের আশঙ্কা ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের কারণে জৈল সিং হয়তো রাজীবের পক্ষে রায় না দিয়ে প্রণববাবুকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন এবং সেটা হবে চরম অনভিপ্রেত৷ কিন্তু পি সি আলেকজান্ডার সেই প্রস্তাবে বাদ সাধেন৷ তিনিই রাজীবকে বোঝান, অরুণের প্রস্তাব কার্যকর করলেই বরং রাষ্ট্রপতি বিগড়ে যেতে পারেন এবং উপরাষ্ট্রপতির উদ্যোগে আয়োজিত শপথানুষ্ঠানটিকেই অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে চরম জটিলতার সৃষ্টি করতে পারেন৷ আলেকজান্ডারের আরও বক্তব্য ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের কারণে জৈল সিং এই সঙ্কটে তাঁর পুত্রের পাশে দাঁড়াবেন না অরুণের এই আশঙ্কাও সম্পূর্ণ অমূলক৷ শেষ পর্যন্ত রাজীব আলেকজান্ডারের প্রস্তাবটিই শিরোধার্য করেন এবং অরুণ নেহরুর আশঙ্কাকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিয়ে দিল্লিতে ফিরেই জৈল সিং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই জানিয়ে দেন, তিনি চান রাজীব গান্ধীই নতুন প্রধানমন্ত্রী হোন৷

এই কাহিনির বর্ণনা দিয়ে প্রণববাবু যে উপসংহারটি টেনেছেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ ‘ইট ইজ সারপ্রাইজিং দ্যাট এ সিভিল সার্ভেন্ট হু হ্যাড অ্যাসিউমড অথরিটি অন হিজ ওন অ্যান্ড এ পার্সন হু হ্যাড নো অফিশিয়াল পোজিশন ইন দ্য পার্টি এন্ডেড আপ প্লেয়িং এ মেজর রোল ইন ডিটারমিনিং দ্য কোর্স অব ইভেন্টস অন দ্যাট ট্র্যাজিক ডে৷ দিস ইজ নাও এ ম্যাটার ফর হিস্টোরিয়ানস অ্যান্ড স্কলারর্স টু ডিবেট৷’ ‘সিভিল সার্ভেন্ট মানে পি সি আলেকজান্ডার৷ কিন্তু দলে কোনও রকম দায়িত্বে না থাকা ব্যক্তিটি কে? অবশ্যই অরুণ নেহরু৷

তাহলে গুজবের স্রষ্টা হিসেবে তখন বরকত সাহেবের নামটি মুখে মুখে ফিরেছিল কেন? কেনই বা বরকত সাহেব তখন প্রকাশ্যে সেই অভিযোগ খণ্ডনও করেননি? ইন্দিরা গান্ধীর জমানার শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের এই হেভিওয়েট কংগ্রেস নেতা ছিলেন সঞ্জয় গান্ধীর অনুগামী শিবিরে৷ জরুরি অবস্থার মাঝপথে সঞ্জয় গান্ধী যখন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে সরানোর কথা বিবেচনা করছিলেন (সেই পরিকল্পনা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি) তখন বরকত সাহেবই ছিলেন তাঁর প্রথম পছন্দের৷ রাজীবের জমানার গোড়ার দিকে বরকত চলে যান অরুণ নেহরুর শিবিরে৷ অতএব অনেকেই তখন বিশ্বাস করেছিলেন হয়তো বরকত সাহেবকে দিয়েই বাজারে প্রণববাবুর বিরুদ্ধে এই গুজবটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অরুণ নেহরু৷ হাজার হোক, ৩১ অক্টোবর দুপুরে দিল্লিগামী ওই বিশেষ বিমানে অরুণ নিজে ছিলেন না, কিন্তু বরকত সাহেব ছিলেন৷ অতএব বরকত সাহেবের মুখ দিয়ে কথাটা বলালে গপ্পোটা যতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে, অন্য কেউ বললে তা হবে না৷ তবে এ কথা ঠিক, ওই বিমানে বাকি যাঁরা ছিলেন এবং আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা কেউই কখনও এই গুজবের সমর্থনে একটি কথাও বলেননি৷ এ বার প্রণববাবুর নিজের ভাষ্য প্রকাশ্যে আসার পরে বৃত্তটা বোধহয় সম্পূর্ণ হল৷

এ কথা অনস্বীকার্য, যে যাঁর নিজস্ব কারণে অরুণ নেহরু এবং বরকত সাহেব দু’জনেই চরম অপছন্দ করতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়কে৷ পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি রাজনীতিতে এঁরা দুজনে ছিলেন দুই বিরুদ্ধ শিবিরের গোষ্ঠীপতি, দলীয় রাজনীতিটাই তখন আবর্তিত হত এই দুই নেতাকে কেন্দ্র করে৷ জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়েও প্রণববাবু দীর্ঘদিন যে গুরুত্ব পেয়েছেন, বরকত সাহেবের মূল গোঁসা ছিল তা নিয়েই৷ সেই কারণে প্রকাশ্যেই তিনি অনেক সময় প্রণববাবুকে কটাক্ষ করতেন, তিনি যে গুজরাত থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুলতেন না৷ স্বভাব-সতর্ক প্রণববাবু অবশ্য প্রকাশ্যে তেমন একটা প্রত্যাঘাত করতেন না, বরকত সাহেবের শ্লেষ বা কটাক্ষ ঠান্ডা মাথাতেই হজম করে নিতেন৷ ইন্দিরার জমানা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য তাঁদের সম্পর্কে এই তিক্ততা আর অবশিষ্ট ছিল না, দু’জনেই তখন যে যাঁর মতো করে দুর্যোগের মোকাবিলা করতে ব্যস্ত ছিলেন৷

অরুণ নেহরুর প্রণব-বিদ্বেষের কারণটি ছিল ভিন্ন৷ রাজীবের জমানায় তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল যেন তেন প্রকারেণ দলে এবং সরকারে প্রধানমন্ত্রীর পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আসনটি দখলে রাখা, প্রণববাবুর ডানা ছাঁটতে না পারলে যেটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না৷ অরুণ বরাবরই রাজীবের ঘনিষ্ঠ বলয়ের অন্যতম মুখ ছিলেন, প্রণববাবু ছিলেন না৷ ফলে অনভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রীর কর্ণকুহরে প্রণববাবু সম্পর্কে ক্রমাগত বিষ ঢালতে তাঁর কোনও অসুবিধেই হয়নি৷ পরবর্তীকালে রাজীবের বিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সেই বিপদ অবশ্য প্রণববাবু নিজেই বাড়িয়ে তুলেছিলেন, আরও শক্ত হয়েছিল অরুণ নেহরুর হাত৷ আত্মজীবনীতে প্রণববাবু তাই অকপটে স্বীকার করেছেন, কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নিজের দল গড়াটা ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল৷

বরকত সাহেবের বিরোধিতা বা কটাক্ষকে কোনও দিন সে ভাবে গায়ে মাখেননি প্রণব মুখোপাধ্যায়৷ কিন্তু অরুণ নেহরুকে তিনি মন থেকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারেননি৷ অনেক পরে একবার অরুণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে মুখের ওপর সে কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন প্রণববাবু৷ বলেছিলেন, ‘কারও বিরোধিতাকে আমি মনে রাখিনি৷ কিন্তু তোমাকে আমি ভুলতে চেয়েও পারিনি৷ আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ক্ষতিটা করেছ তুমিই৷’

বরকত সাহেবের মতো অরুণ নেহরুও চলে গিয়েছেন, আজ অনেক দিন হল৷ কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি সেই সব দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মনে হয় প্রণববাবুর মতো দুরবস্থা না হলেও, বরকত সাহেবও কি ইন্দিরার মৃত্যুর পরে আর তাঁর প্রাপ্য পেয়েছেন?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *