logo

ওলো সই,ওলো সই…..

  • September 17th, 2022
Arts and Literature

ওলো সই,ওলো সই…..

বাংলাস্ফিয়ার- বিভিন্ন ধরণের শিল্প দর্শন বা শ্রবণে ভিন্ন ভিন্ন অভিঘাত তৈরি হয় মানুষের মনে। কখনও সে মুগ্ধ, কখনও শিল্পের সামনে নতজানু, কখনও সক্রিয় হয়ে ওঠে তার সমালোচক সত্ত্বা, আবার কখনও, বিরল কিছু ক্ষেত্রে, বিহ্বল হয়ে পড়ে সে। শিল্পটির রহস্যময়তা, তার অন্তর্নিহিত অর্থ, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তাকে হতচকিত করে।প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত 'গ্যাব্রিয়েল দ্য এস্ত্রে এবং তার এক সহোদরা' শীর্ষক চিত্রটি ঠিক তেমনই এক শিল্পসৃষ্টি। আজ থেকে প্রায় ৪২৮ বছর আগে (১৫৯৪ সালে) ওক কাঠের ওপর তেলরঙে আঁকা এই ছবিটি। উইকিমিডিয়া কমন্স সূত্রে আমরা ছবিটি পেয়েছি।

ছবিটিতে বাথটবের ভেতর যে দুই নগ্নিকাকে দেখছেন, তাদের মধ্যে ডানদিকের ললনাই হলেন গ্যাব্রিয়েল দ্য এস্ত্রে। বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর ডগায় তাঁর স্তনবৃন্তটি ধরে আছেন আরেক নারী, সম্ভবত তিনি গ্যাব্রিয়েলের বোন। তাঁদের কেশসজ্জা ও মুক্তোখচিত কর্ণাভরণ তাঁদের আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে। আর তাই, তাঁদের নগ্নতা ও ভঙ্গিমা তীব্রতর বিস্ময় জাগায় দর্শকের মনে।

এমন অদ্ভুত সুন্দর একটি সৃষ্টি,যা ফরাসী অঙ্কনশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির অন্যতম, অথচ এই ছবিটি সম্পর্কে প্রায় কিছুই নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। শিল্পী অজ্ঞাতনামা, যদিও আঁকার ধরণ এবং খুঁটিনাটির প্রতি যত্ন দেখে কেউ কেউ মনে করেন ফরাসী নবজাগরণের চিত্রকর ও মিনিয়েচার শিল্পী ফ্রাসোঁয়া ক্লুয়ে এই অপূর্ব ছবিটির স্রষ্টা। এই আন্দাজের খেলায় না যেতে চাইলে অন্তত এটুকু নিশ্চয়তার সঙ্গে বলাই যায় যে ছবিটি ফ্রান্সের ফন্ত্যেনব্লো ঘরানার চিত্রশৈলীতে আঁকা। প্যারিসের অনতিদূরে ফন্ত্যেনব্লো রাজপ্রাসাদের সামনে একত্রিত হতেন প্রতিভাবান চিত্রকররা।১৫২৮ সাল নাগাদ, রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের রাজত্বকালে একটা ঘরানায় পরিণত হয় তাঁদের আঁকার ধরণটি। এই ছবিটি যখন চিত্রিত হয়, তখন রাজা চতুর্থ হেনরির আমল, একের পর এক ধর্মযুদ্ধে বিধ্বস্ত ও পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদটি পুণর্নির্মানের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

শিল্পীর নাম খানিক আন্দাজ করা গেলেও কার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এই ছবিটি আঁকেন তা কোনওভাবেই জানা যায় না।

নারীযুগলের বিচিত্র ভঙ্গিমাটি সম্পর্কেও কৌতুহলের সীমা নেই ইতিহাসবিদদের মধ্যে। একজন কেন ছুঁয়ে আছেন অন্যজনের স্তনবৃন্ত, কী তার দ্যোতনা, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কোনও কোনও মত চমকে দেবার মত।

চিত্রিত দুই নারীরই ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত।বসে আছেন যে স্নানের টবে তা রেশম বা কাপড়ে মোড়া। সে সময়ে ধাতু বা কাঠ দিয়ে তৈরী করা হত বাথটবগুলো, তারপর ধাতুর উত্তাপ বা কাঠ থেকে বেরিয়ে থাকা ধারালো পেরেক থেকে রক্ষা পেতে সযত্নে মুড়ে দেওয়া হত কাপড়ে। গোটাটাই ছিল যাকে বলে 'আরাম কা মামলা'!

গ্যাব্রিয়েল দ্য এস্ত্রে ছিলেন ডাচেস, স্বভাবতই ফ্রান্সের অভিজাত মহলে তাঁর জানপহেচান ছিল। একাধারে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের নৃপতি পঞ্চম হেনরির রক্ষিতা, বয়স্যা এবং পরামর্শদাত্রী।

রাজা হেনরির সঙ্গে ডাচেসের ছিল গভীর প্রেমের সম্পর্ক। তাঁরা বিবাহ- বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন পরস্পরের সঙ্গে কিন্তু হেনরি ছিলেন বিবাহিত। স্ত্রী মার্গারিট দ্য ভ্যালয়ে বা রানী মার্গটের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ না হলে তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে কেমন করে! অতএব রাজামশাই পোপের কাছে দরবার করলেন। আর্জি, তাঁর বৈবাহিক সম্পর্কটি খারিজ করে অনুমতি দিতে হবে পুণর্বিবাহের।

ছবিতে গ্যাব্রিয়েলকে দেখা যাচ্ছে বাঁ হাতে একটি অঙ্গুরীয় ধরে থাকতে, বহু-আকাঙ্খিত মিলনের প্রত্যাশায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে রাজার সঙ্গে তাঁর প্রেমই এই ছবির উপজীব্য।সত্যি বলতে কী, এই চিত্রসৃষ্টির বছর পাঁচেক পর, ১৫৯৯-এর মার্চ মাসে হেনরি তাঁর অভিষেক- অঙ্গুরীয়টি উপহার দেন তাঁর প্রেয়সীকে।

তবু, মিলন বুঝি অদৃষ্টে লেখা ছিল না প্রেমিক-যুগলের। গ্যাব্রিয়েল আক্রান্ত হন সন্ন্যাসরোগে, তাঁর গর্ভে তখন ছিল তাঁদের চতুর্থ প্রেমজ সন্তানটি। একটি মৃত পুত্রের জন্ম দেন তিনি এবং তার ঠিক একদিন পর, ১৫৯৯ সালের ১০ এপ্রিল ইহলোক ত্যাগ করেন সদ্য প্রসূতি। তাঁর প্রেমাস্পদ তখন যাত্রা করেছেন প্যারিস অভিমুখে শেষবারের মত তাঁকে দেখতে।

আলোচ্য ছবিটির ব্যঞ্জনা, রহস্যময়তা বা আকর্ষণ সবটাই কেন্দ্রীভূত হয়েছেন ভঙ্গিমা বা শরীরী ভাষার মধ্যে। ডাচেসের পাশে অপর নগ্নিকাকে চিহ্নিত করা হয় গ্যাব্রিয়েলের বোন হিসেবে। জুলিয়েন হিপলাইট জোসেফিনও ছিলেন ভিলার্স প্রদেশের ডাচেস। সামনের দিকে খানিক ঝুঁকে তিনি খুঁটে চলেছেন পার্শ্ববর্তিনীর ডানদিকের স্তনবৃন্ত।দ্বিধাহীন, লজ্জাহীন। আসলে কী বলতে চাইছে এই ছবি?

খুব স্বাভাবিকভাবে ছবিটার মধ্যে যৌন-উদ্দীপনা দেখতে পান দর্শক, গন্ধ পান রগরগে সমকামের। স্নানঘরে টাঙানো গাঢ় গোলাপী পর্দাও যেন এক গোপন উত্তেজক অবৈধতার ব্যঞ্জনা এনে দেয়। সবকিছু মিলেমিশে চারদেয়ালের অন্তরালে, নিভৃতে অভিনীত দৃশ্য লুকিয়ে দেখার নিষিদ্ধ আনন্দ জাগে দর্শক হৃদয়ে।

কিন্তু না, প্রথম প্রতিক্রিয়াটি এ ক্ষেত্রে ভুল পথে চালিত করে দর্শককে। ১৫৯৪ সালে, গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগে, ছবিটা যখন আঁকা হচ্ছে, তিনি তখন পূর্ণগর্ভা। কিছুদিন পরেই ভূমিষ্ট হবে পঞ্চম হেনরির ঔরসজাত তাঁর প্রথম সন্তান, সিজার অফ বার্বন। এরপর আরো দুটি প্রেমজাত সন্তান হয় এই যুগলের। চতুর্থবার একটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে মারা যান গ্যাব্রিয়েল। তখন তিনি মাত্র তিরিশের দোরগোড়ায়।

আর এই বারবার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনাই এক অন্যতর আলো ফেলে আলোচ্য চিত্রটির ব্যাখ্যায়।উন্মুক্ত স্তনবৃন্ত ছুঁয়ে থাকা এখানে আসন্ন মাতৃত্বের প্রতীক, উর্বরতার সূচক, এ নারী অনতিবিলম্বে দুগ্ধবতী হয়ে উঠবেন সে বার্তাই ছড়িয়ে আছে এ ছবিতে। এবং, এই ভাষ্যটিকে আরো নিশ্চিত, আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে দৃশ্যটির পশ্চাদপটে এক তরুণীর উপস্থিতি।আমরা তাকে দেখি নিবিষ্ট হয়ে সেলাই-ফোঁড়াই করছেন, কল্পনা করি সেসব গ্যাব্রিয়েলের অনাগত সন্তানের জামা, প্যান্টুল, কাঁথাকানি।

কীভাবে একটি শিল্পসৃষ্টিকে বুঝতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে তা নিয়ে একটা গোটা বই লিখেছেন ক্রিস্টোফার পি. জোনস। 'হোয়াট গ্রেট আর্টওয়ার্কস সে'। মিডিয়াম ওয়েবজিনে 'গ্যাব্রিয়েল দ্য এস্ত্রে এবং তার এক সহোদরা' -কে নিয়ে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। ছবিটির মর্মার্থ কী তা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি, অনেক জল্পনা, অনেক কানাকানি যুগ যুগ ধরে। তবু বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই তার রহস্যময় ও চিত্তাকর্ষক চরিত্র নিয়ে। আর এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই এই শিল্পসৃষ্টির মধ্য দিয়ে। তা হল এই যে, প্রাথমিক ধারণা সবসময়ে সত্যি হয় না! যা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, তাকে অতিক্রম করতে পারলে নব নব ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে, বাঙ্ময় হয়ে ওঠে শিল্প। আর এইভাবেই যেকোনো শিল্পকে অনুভব করার, আত্মস্থ করার নতুন নতুন রাস্তা উন্মোচিত হয় সত্যিকারের রসগ্রাহীর সামনে

4 comments

  1. অপূর্ব, অপূর্ব। 🙏 আপনার লেখনী না পড়লে অ নে ক কিছু অজানা থেকে যেত। থ‍্যাঙ্কিউ স‍্যর।🙏

  2. শিল্প-বোদ্ধা নই। তাহলেও যতটুকু জানা — ক্লাসিক সাহিত্য, শিল্পের মূল বস্তু –‘ রস’। এই রস জিনিসটা রসিকের অপেক্ষা রাখে।
    সাধারণ মানুষের চোখে যা অশ্লীল বা আপত্তিজনক , আর্টের চোখে তা নাও হতে পারে। অর্থাৎ সেখানে –‘ moral policing’ নেই। যা আছে রসোপলব্ধির জন্য বোধ যা চর্চার মধ্য দিয়ে তৈরি করতে হয়। ( চোখ/ মন ) শেষ বিচারে মানুষকে যা আনন্দ দেয়। ‘দুই নগ্ন নারীর’ মধ্যে কোনও অশ্লীলতা নেই, চোখে-মুখে অদ্ভুত এক শান্ত ভাব। ভালো বই, ছবি, সিনেমা, নাটক ইত্যাদি মানুষকে ভাবতে/ চিনতে শেখায়। সেই পথটি প্রশস্ত করে দিচ্ছেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *