logo

আমি শাক্ত, মদ্যপায়ী শক্তির পদ্যের ভক্ত

  • November 26th, 2022
Arts and Literature

আমি শাক্ত, মদ্যপায়ী শক্তির পদ্যের ভক্ত

নীলার্ণব চক্রবর্তী

আমি ছোট থেকেই শাক্ত। শক্তিই আমার আরাধ্য। লেখালিখির ভোরবেলাতেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পাল্লায় আমি পড়ে গিয়েছিলাম। নাহ, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়-সৌভাগ্য হয়নি। তিনি মারা গিয়েছেন ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ, সে বছর আমি মাধ্যমিক দিই। নিউজ পেপারে খবরটা পড়ে দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল মনে আছে। তাঁর শেষ‌যাত্রায় ‌যাওয়া আমার পক্ষে সে বয়সে সম্ভব ছিল না। সেই কৈশোরে শক্তির কবিতা কীভাবে আমাকে উত্তমমধ্যম দিল, মনে আছে কিছুটা। আমার এক কাকা, দূরসম্পর্কের, থাকতেন লাগোয়া বাড়িতে, এখন প্রয়াত, তিনি ছিলেন কবিতাপ্রেমিক। হস্তমৈথুনের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতাও লিখতেন। একদিন তাঁর ঘরে গিয়েছি কী যেন প্রয়োজনে, দেখি বিছানায় পড়ে আছে— কক্সবাজারে সন্ধ্যা। তখন সন্ধ্যা নামছিল, দেখলাম লেখকের নাম, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তখন গোধূলি গগনে মেঘে তারাগুলি ঢাকা পড়ছিল কি না জানা নেই। আমি 'কক্সবাজারে সন্ধ্যা' খুলে বসলাম। চাকমার পাহাড়ি বস্তি, বুদ্ধমন্দিরের চূড়া ছুঁয়ে/ ডাকহরকরা চাঁদ মেঘের পল্লির ঘরে ঘরে/ শুভেচ্ছা জানাতে ‌যায়, কেঁদে ফেরে ঘণ্টার রোদন/ চারদিকে। বাঁশের ঘরে ফালা ফালা দোচোয়ানি চাঁদ—/ পূর্ণিমার বৌদ্ধ চাঁদ, চাকমার মুখশ্রীমাখা চাঁদ!…

লেখা পড়ে কিছুক্ষণ যে অবস্থা হল আমার, তাকে বুঝবম্ভুল দশা বলে। তখন একটি পত্রিকা বার করি আমরা। স্ফুলিঙ্গ তার নাম। দেওয়াল পত্রিকা, কিন্তু ছাপাও বেরয়, বছরে এক-দুবার। গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কবিতা নিই। অন্নদাশঙ্কর রায়, মহাশ্বেতা দেবীর মতো নামী লেখকদেরও ‌লেখা সেখানে ছেপে বেরিয়েছে বলে আমাদের কলার-তোলা। আমি সম্পাদক, তাই আমার তো দেমাকে মাটি পা পড়ে না। ক্লাস এইটে পড়লেও, মনে করতে শুরু করে দিয়েছিলাম, ‌সাহিত্য নিয়ে গ্রাম্ভারি কিছু বলার ‌যোগ্যতা আমার ভালিভাতি হয়েছে। শক্তি চট্টো-র কবিতা তার মূলের পরমাণু বোমা ফেলল। আমি বুঝলাম, কবিতা বুঝি না আমি। দোচোয়ানি চাঁদ… চাঁদমামার কী উলুথুলু ব্যাখ্যা রে বাবা। জন্মে শুনিনি, দোচোয়ানি মানেটাই বা কী, চাঁদ এমনও হয় নাকি! হরি হে মাধব, কক্সবাজারের সন্ধ্যায় চান করব না গা ধোব! 'কক্সবাজারে সন্ধ্যা' বইয়ের প্রথম কবিতার নামটা ওই 'কক্সবাজারে সন্ধ্যা'-ই। প্রথম স্ট্যানজাটা বললাম আগে, দ্বিতীয়টাতেও চমক রয়েছে। নতুন নির্মিত বাড়ি সমুদ্রের জলে ঝুঁকে আছে।/ প্রতিষ্ঠা বেষ্টিত ঝাউ, কাজুবাদামের গাছ, বালু/ গোটাদিন তেতেপুড়ে, শীতলে নিষ্ক্রান্ত হব বলে/ বাতাসের ভিক্ষাপ্রার্থী! জল সরে গেছে বহু দূর।/ নীলাভ মসলিন নিয়ে বহু দূর বঙ্গোপসাগর/ আজ, এই সন্ধ্যাবেলা…

প্রতিষ্ঠা বেষ্টিত ঝাউ, কী আশ্চ‌র্য ব্যাখ্যা, কী করে সম্ভব কে জানে। বুঝলাম আমার পুরনো সাহিত্য-বোধের অট্টালিকাটা গমগমিয়ে ভেঙে ‌যাচ্ছে। নতুন বোধের চারাগাছটার জন্ম হচ্ছে। আমি সে দিনই আমার লিঙ্গের কসম খেয়ে শাক্ত হয়ে গেলাম। মানে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ধর্মমত গ্রহণ করে নিলাম।

তারপর কেটে গেছে অনেক সময়। লেখালিখির জগতে শক্তি-মন্দিরের চাতাল বেড়েছে অনেক, অনেক…। তবে কবি, লেখক, মাতালের সমবিব্যাহারে সেখানে গুলজার আর নেই। শক্তি এখন গুরু, ভগবান। কে বড় কবি শক্তি না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তা নিয়েও তর্ক এখন অপসৃত। সুনীলের মন্দির আলাদা, শক্তির থেকে বেশ কিছুটা দূরে তার অবস্থান, মানতে কোনও দ্বিধা নেই মোটের উপর। এই ‌যখন অবস্থা, তখন ফের একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন এসে গেল। জন্মদিনে ওঁর জন্য সুরা-উৎপাদিত কালিতে একটি কচি বা নাতিদীর্ঘ কবিতা লেখাই ‌উচিত ছিল আমার। ভেবেও ছিলাম, কবির ধর্ম পালনই করব। সম্পাদক কিন্তু বললেন, গদ্য লিখতে হবে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় গদ্য লেখাকে জনমজুরি বলতেন, আরও অনেকেই বলেন, আমি বলছি না, তা হলে সম্পাদক ক্রোধের রোদে চিৎকার করতে পারেন। গদ্য উগরে দিতে দিতে আপাতত মনে পড়ছে এক শক্তিকথার সঙ্গে দেখা, গত বইমেলায়। তাঁর স্ত্রী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের আন্তরিক প‌র্যটনে নামে একটি বইয়ের মাধ্যমে। কিছু দিন ধরেই লোকমুখে বইটির গুণগান শুনছিলাম কেনা হয় না হয় না-- বইমেলায় হয়ে গেল। ১৫০ পাতার বই। বিবেকানন্দ-বেগে পড়ে ফেললাম। গ্রেট পোয়েট শক্তি-র মদ-লোভ বা মদ-মত্ততা নিয়ে কত লোক কথা বলেছেন। শক্তির লেখার চেয়েও লম্বা হয়ে গিয়েছে কখনও কখনও তার সুরাপ্রিয়তা। এ নিয়ে বারবার বিলাপ করেছেন মীনাক্ষীও। এক জায়গায় বলছেন, আনন্দবাজারে শুধুই সাংবাদিকের চাকরি শক্তির অপছন্দের হোক কি ওর একক না দায়িত্ব পেয়ে কাজ করার অসন্তোষই হোক, শক্তি বারবার মদ্যপান করে অফিসের কাজ এবং শান্তি বিঘ্নিত করত বলে শুনেছি, তার জের বাড়িতেও টেনে আনা শুরু হল। অসহ্য হলে মামাবাড়ি বা ছোটমাসির বাড়ি চলে যেতাম। সন্তোষদা (সন্তোষকুমার ঘোষ) এই সময়ে মাঝে মধ্যে আমার অফিসে ফোন করে ওঁর পরিচয় দিয়ে নীচে দাঁড়াতে বলতেন, গাড়িতে আমাকে তুলে নিতেন, দেখতাম শক্তি বসে আছে। আমাদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় রেস্তোরাঁয় অথবা ওঁর পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে যেতেন। আমাকে বলতেন আমি কেন ওঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি? আমি জানতে চাইতাম দুর্ব্যবহার কাকে বলে? উনি বলতেন, এই যে তুমি ওকে একা ফেলে চলে ‌যাও— এটাই সবচেয়ে বড় দুর্ব্যবহার। কবিদের মনে কত অশান্তি থাকে বুঝতে চেষ্টা করো। আমি বলতাম, যে কবি তার প্রথম দ্বিতীয় কোনও বই ছাপতে বাড়ি থেকে পয়সা খরচ করেনি, চতুর্থ বই থেকে প্রচুর নাম‌যশ পেয়েছে, কলকাতার প্রথম শ্রেণির দৈনিকে প্রায় বিনা আয়াসে চাকরি পেয়েছে, তার কী এমন মনোকষ্ট থাকতে পারে যে দিনের পর দিন রাত্রে-দিনে এভাবে ফেরে? এবং বাচ্চাদের কষ্ট দেয়? আমার কথা বলতে চাই না।…

শক্তির সঙ্গে আমার খানিক জন্মস্থান-‌যোগও রয়েছে। শেষে সেই কথা একটু বলে নেওয়ার লোভ জাগল। আন্তরিক প‌র্যটনে মীনাক্ষী লিখেছেন,… শক্তি এবং তার ভাই ভক্তির জন্ম ওই বহড়ু গ্রামেই। বহড়ু, জয়নগর, মজিলপুর দক্ষিণের এই গ্রাম শহরগুলির মাহাত্ম্য বহু বছরের বেশি পুরনো। উনিশ শতকের প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা সোমপ্রকাশ হরিনাভি চাংড়িপোতা থেকে বার করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ১৮৫৮ সালে।… বহড়ু স্কুল আমাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতেও বছর দশেকের বড়। এই পরিবেশেই শক্তির জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৭ নভেম্বর ১০ অঘ্রান।…

আমার জন্ম চাংড়িপোতায়, এখন ‌যার নাম সুভাষগ্রাম। বহড়ু থেকে কতই বা দূর! অতএব শক্তি আমার প্রতিবেশী। এবং এই হৃদয়পুরে ওঁর প্রতি ভক্তি বৃদ্ধির একটা কারণ এটাও হতে পারে নাকি। তা ছাড়া… শোনো শোনো শক্তির কত কাছাকাছি আমার জন্ম, শোনো, শোনো… এই সু‌যোগে এভাবে নিজের ঢাক নিজে পেটানোও গেল।

2 comments

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *