- August 12th, 2022
এ আমার এ তোমার পাপ
এ আমার এ তোমার পাপ
সুমন চট্টোপাধ্যায়
আজ সকাল থেকে বেশ মিঠে হাওয়া বইছে, গতকাল রাতের এক প্রস্থ ঝড়-ঝঞ্ঝার জেরেই হয়তো। মনটা এমনই বিবশ, অবসাদগ্রস্ত হয়ে আছে যে হাওয়া গায়ে লেগেও লাগছেনা। নবারুণদা ঠিকই লিখেছিলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।’ নাকি উল্টোটা?
সীতারাম ইয়েচুরির তরতাজা ছেলেটাকে কোভিড নিয়ে গেল। অন্য সবার মতো আমারও মন খারাপ, আমার মেয়ের মন খারাপ আরও বেশি। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে ছেলেটি আমার মেয়ের এক বছর জুনিয়ার ছিল। মেয়েই জানাল, ওর আর এক কলেজ সহপাঠিনীরও অকাল মৃত্যু হয়েছে। তার বাবা ভিআইপি নয় বলে এই মৃত্যুটি খবর হয়নি।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এই রকম কত মানুষকে গ্রাস করল, কারও কাছে তার সঠিক হিসেব নেই। সরকারি পরিসংখ্যানে যে সত্য প্রতিফলিত হয় না সবাই তা জানে, কেউ তা বিশ্বাস করে না। সবটা মিলিয়ে গোটা চিত্রটাই ভয়ঙ্কর রকম অবিশ্বাস্য ঠেকছে, শহরের পর শহরের হাসপাতালে অক্সিজেন আকাল, গণ-দাহ চলছে অনেক জায়গায়, চকিতে হাহাকার আর অজানা আতঙ্কের কালো ছায়া নেমে এসেছে গোটা দেশটার ওপর। আমরা মন্বন্তর দেখিনি, মারি নিয়ে ঘর করাটা কতটা সর্বনেশে ৬৩ বছরের জীবনে এই প্রথম তা টের পাচ্ছি, বাইরের মিঠে হাওয়ার বদলে মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে চলেছে হিমেল স্রোত, কত মায়ের কোল যে খালি হবে, সামান্য একটু অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করবে আরও কত লক্ষ মানুষ, আর্তনাদ আর হাহাকারে কতটা বিদীর্ণ হবে আকাশ-বাতাস, কেউ কী তার সঠিক আভাস দিতে পারবে?
আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে মেসেজ করেছে, ‘আর নিতে পারছি না, একটার পর একটা দুঃসংবাদ মনের ওপর দারুণ চাপ সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে হয়তো আমিই এ বার পাগল হয়ে যাব।’ আর এক পরিচিতজন কাঁদো-কাঁদো গলায় টেলিফোন করে জানতে চাইল লখনৌতে আমি কোনও কেষ্টবিষ্টুকে চিনি কি না। সেখানে তার নিজের দাদার কোভিড হয়েছে, বাড়িতেই আছে, কিন্তু যে কোনও সময় অক্সিজেনের প্রয়োজন হতে পারে। কোনও হাসপাতালে বেড নেই, সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করা মানে অপেক্ষারত অবস্থায় মৃত্যু হওয়া। বিকল্প হিসেবে তাই তারা অক্সিজেন সিলিন্ডার খুঁজছে, গোটা শহরে কোনও ওষুধের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। চাকরিতে থাকলে হয়তো তাকে আমি সাহায্য করার চেষ্টা করতাম, এখন আমার কথা কেই বা শুনবে?
আমি যেখানে থাকি তার সন্নিকটেই বাঙুর হাসপাতাল, কোভিডের চিকিৎসায় বিত্তহীনের ভরসাস্থল। নিজের বিছানায় বসে অহর্নিশি আমি কেবল অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের আওয়াজ শুনতে পাই, যতবার শুনি বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। বছর খানেকও হয়নি, এই রকম একটা অ্যাম্বুল্যান্সে করেই আমার গিন্নি ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে গিয়েছিল কোভিডের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে। সে জিতে ফিরেছিল। কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সব্বাই যেন এ ভাবেই ঘরে ফেরে। প্রার্থনা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে আমার?
হঠাৎ করে দৈব অভিশাপে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, ডাক্তারবাবুরা সমস্বরে বলছেন, এ আমার এ তোমার পাপ, প্রথম ঢেউ পাড়ে এসে ভাঙার পরে আমাদের কুছ পরোয়া নেই মনোভাবই খাল কেটে কুমীর ডেকে এনেছে। জীবন আবার স্বাভাবিক হয়েছে ধরে নিয়ে আমরা আত্মরক্ষার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম, মাস্ক পরিনি, ভিড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, যা কিছু পরিহার করা উচিত ছিল বেশি বেশি করে সেই সব কাজই করেছি। মাঝ সমুদ্রে দ্বিতীয় ঢেউ যে ফণা তুলছে, সেই ইঙ্গিত আমাদের কাছে ছিল, আমরা গ্রাহ্যের মধ্যে আনিনি। তারই পরিণতিতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় আমরা এখন খাবি খাচ্ছি। দিন কয়েক আগেও গোটা দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারের তলায় নেমে এসেছিল। জিওমেট্রিক প্রোগ্রেশনে বাড়তে বাড়তে চোখের নিমেষে সংখ্যাটা সোয়া কিন লাখে পৌঁছে গিয়েছে। বিশ্বের মানচিত্রে কোভিডের ‘এপিসেন্টার’ হয়ে উঠেছে ভারত।
কবে একটু স্তিমিত হবে এই মহা-প্রলয়! কৌতুহলী হয়ে টেলিফোন করি আমার ভ্রাতৃপ্রতিম, দীর্ঘদিনের চিকিৎসককে। তাঁর নিদান শুনে আমার হাত-পা পেটের ভিতর সেঁদিয়ে যাওয়ার অবস্থা। “তুমি কি ভাবছো দ্বিতীয় ঢেউয়েই এ গপ্পো শেষ হবে? এরপর আসবে তৃতীয় ঢেউ, তারপর চতুর্থ………।”
সাগরের ঢেউ গুণতে আর ইচ্ছেই করল না।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

