logo

কলকাতার করোনা ডাকাতেরা

  • August 13th, 2022
Suman Nama, Troubledtimes

কলকাতার করোনা ডাকাতেরা

শুভেন্দু দেবনাথ

এই জীবনে অভিজ্ঞতা তো কম হল না। কত রকম ডাকাতের সঙ্গে মিশলাম, জানলাম, দেখলাম। কিন্তু এমনটি আর দেখলাম না যেমনটি এই করোনাকালে চোখে পড়ল। কৈশোরে যখন প্রথম সিগারেট খেতে শিখেছিলাম, মফস্‌সলের ছেলে বলে বাড়ি থেকে দু-তিন কিলোমিটার উজিয়ে সেই চন্দননগর বা ব্যাণ্ডেল চার্চের মাঠে সিগারেট খেতে যেতে হত। বাড়ির বড়রা তো দূর, পাড়ার দাদা-কাকা-জ্যাঠারা দেখলেও চড়-চাপড় লাগিয়ে দিত। তখন এসব ছিল,

এখনকার মতো নয়। বাড়ির লোক খুশিই হত পাড়ার কেউ শাসন করলে। তো এই ব্যাণ্ডেল চার্চের আড্ডা মারতে মারতেই পরিচিত হলাম ব্যাণ্ডেল ঝুগ্গির (ঝুপড়ি বা বস্তি) অ্যান্টিসোশ্যালদের সঙ্গে। তাদের কেউ ওয়াগন বেকার, কেউ বা অন্য ধরনের ক্রিমিনাল, কেউ আবার কয়লা পাচারকারী। এদের সঙ্গে মিশলেও কেউ কোনও দিন আমরা যারা পড়াশুনা জানা তথাকথিত ভদ্রলোকের ছেলে তাদের কোনও রকম অপরাধ বা ঝুট ঝামেলায় জড়াতে দিত না, আগলে রাখত। বলত – ‘তোরা এসবের মধ্যে আসিস না, তোরা ভালো ছেলে। তোদের যে কোনও ঝামেলায় আমাদের ডাকিস’।

আবার একবার হাওড়া থেকে চুঁচুড়া অফিস ফেরতা ট্রেনে ভিড়ের জন্য লেডিস কম্পার্টমেন্টে চড়ায় ধরা পড়ে একরাত লকআপে থাকার সময়েও রেল-অপরাধীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের মধ্যেও দেখেছি মানবিক রূপ। আর সাংবাদিকের কাজ করার সুবাদে ভারতের সবচেয়ে বড় বড় দুর্ধর্ষ ডাকাতদের তো একদম সামনে থেকে দেখেছি, একসঙ্গে খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। একেবারে চম্বলের মালখান সিং, মোহর সিং, রেণু যাদব, নীলম গুপ্তাদের সঙ্গে ঘর করেছি বলা চলে। এরা কেউ দারিদ্র্যের কারণে নইলে ভুল বুঝিয়ে বিপদে পড়ার কারণে ডাকাত হয়েছে, আর চম্বলের তো ইতিহাস হয়ে গিয়েছে বঞ্চনার, অত্যাচারের প্রতিবাদে ডাকাত হওয়ার পরম্পরা।

কিন্তু খাস কলকাতার বুকে ভদ্র জামাকাপড় পরা, শিক্ষিত ডাকাত যে দেখতে হবে তা কস্মিনকালেও ভাবিনি। এসব ডাকাতরা তথাকথিত ওইসব দুর্ধর্ষ অপরাধীদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পশ্চিমবঙ্গের বুকে আছড়ে পড়া ইস্তক চারদিকে শুরু হয়েছিল হাহাকার। যে হাহাকারের পিছনে ছিল মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত বাঙালির প্যানিক ম্যানিয়া। বুদ্ধিমান সবজান্তা বলে খ্যাত বাঙালির এই সবজান্তা মনোভাবই একদল ডাকাতের জন্ম দিয়েছে কলকাতার বুকে। জ্বরজারি, আমাশা, মাথা ব্যথা হলে ওষুধের দোকান থেকে নাম জানা কিছু চেনা পরিচিত ওষুধ কিনে রোগ সারাই করা বাঙালি করোনাকেও বোধ করি সামান্য অসুখ ভেবে বসেছিল। ফলে সামান্য শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন স্যাচুরেশন সামান্য ফ্ল্যাকচুয়েট হতেই তারা ধরে নিল, সকলের অক্সিজেন চাই। এমনকী করোনা পজিটিভ রিপোর্টে পজিটিভ আসা মাত্র শুরু হয়ে গেল অক্সিজেনের সিলিন্ডার বাড়িতে মজুত রাখার চেষ্টা। ফলত একদল মানুষ লেগে পড়ল অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত করতে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দেয় দাম। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না।

গত বছরও করোনার প্রথম ধাপে যেখানে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হত ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায়, একটা ফ্লো মিটার বিক্রি হত ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে, সেখানে আচমকাই এ বছর করোনার দ্বিতীয় ধাপে তা বেড়ে দাঁড়ালো আকাশ ছোঁয়া। একটা বি টাইপ ১০ লিটারের অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ২০-২৫ হাজার টাকা থেকে বিক্রি হওয়া শুরু হয়ে ৭০-৭২ হাজার হয়ে ক্রমে ক্রমে বেড়ে দাঁড়াল এক লক্ষ টাকায়। ফ্লো মিটারের দাম বেড়ে দাঁড়ালো ৪৫০০ হাজার টাকায়। সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি ফ্লো মিটার-সহ অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে শুরু করল ৭২ হাজার টাকায়। ফলত অক্সিজেন সিলিন্ডার, ফ্লো মিটার চেপে দিয়ে রাজ্য জুড়ে এবং পাল্লা দিয়ে দেশজুড়ে তৈরি করে দেওয়া হল অক্সিজেনের হাহাকার।

আইন আছে, তেমনি আইনের ফাঁকও আছে। ফলে অক্সিজেন ডিলাররা সকলের চোখের সামনে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে আইনের সাহায্য নিয়েই বুক ফুলিয়ে ডাকাতি করতে শুরু করল। আইনের রক্ষকরা সব দেখলেন, জানলেন, কিন্তু ঠুঁটো জগন্নাথটি সেজে রইলেন। তাদের উত্তর, দেশে সিলিন্ডারের অভাব, কী করা যাবে, এঁরা তবু তো দিচ্ছেন। অর্থাৎ চুরি করছেন কিন্তু এই আকালে পরিষেবাও তো দিচ্ছেন গোছের স্তোকবাক্য আর কি। আর বাঙালিও হুজুগে পড়ে ঘটিবাটি বিক্রি করে, ধার-দেনা-কর্জ করে হলেও অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়িতে কিনে আনতে লাগল। কতটা লাগবে সেটা বড় কথা নয়, ওই যে পাশ না করা নিজস্ব ডাক্তারি বুদ্ধিতে সিলিন্ডারটি তার চাই। এমনকী কারও কারও করোনা সেরে গেলেও সিলিন্ডারটি বাগিয়ে বসে রইলেন, সেটি বেচে কোভিড চিকিৎসায় হওয়া খরচ তুলবেন বলে। আর তার ফল? দেখা দিল এক রকম মেডিক্যাল মন্বন্তর।

‘নগরের পথে পথে দেখেছ অদ্ভুত এক জীব

ঠিক মানুষের মতো

কিংবা ঠিক নয়,

যেন তার ব্যঙ্গ-চিত্র বিদ্রূপ-বিকৃত!

তবু তারা নড়ে চড়ে কথা বলে, আর

জঞ্জালের মত জমে রাস্তায়-রাস্তায়।

উচ্ছ্বিষ্টের আস্তাকূড়ে ব’সে ব’সে ধোঁকে

আর ফ্যান চায়”।

৪৩ এর মন্বন্তর যারা দেখেননি, শুনেছেন বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই কবিতার মাধ্যমে পড়েছেন, তারা দেখল শিক্ষিত-অশিক্ষিত-ধনী-দরিদ্র বাঙালির কলকাতা নগরের পথে পথে অক্সিজেনের হাহাকার। সবচেয়ে বেশি হাহাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা মানুষগুলোর। মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের তবু মেডিক্লেম আছে, টাকা আছে তারা কিনতে পারে। কিন্তু এই দুই শ্রেণির না আছে মেডিক্লেম আর না আছে টাকা। ফলে হাহাকার বাড়তে থাকল, আর আমরা যারা পাশে এসে দাঁড়ালাম তাদের বাড়ল মাথা ব্যথা। কোথায় অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে রে, কম দামে পাওয়া যাচ্ছে, ব্ল্যাক হচ্ছে না খুঁজে বার করা, অথবা ক্রাউড ফান্ডিং করে নিজেরাই বেশি দামে সিলিন্ডার কিনে তা বিনামূল্যে এই দুই শ্রেণির মানুষকে দেওয়া দায় হয়ে দাঁড়ালো আমাদের।

হাহাকার বাড়তে বাড়তে যখন চরমসীমায়, ডাকাতির লভ্যাংশ যখন দ্বিগুণ ছাড়িয়ে তিনগুণ- চারগুণে ছুঁলো, তখন আইন রক্ষক এবং সরকারবাহাদুরের মনে হল এবার কিছু একটা করা দরকার। অতএব অক্সিজেন ডিলারদের নিয়ে মিটিং হল, বৈঠক হল, নির্দেশিকা জারি হল। হাহাকার কম হল। হাসপাতালে বেড বাড়ল, দালাল চক্র সরে দাঁড়াল, ওষুধ ব্ল্যাকাররা পিছনে সরে গেল। এই তো এসে গেছে সরকারি পরিষেবা।

আর এদের চেয়ে একটু নিচু জাতের ডাকাতদেরও আমদানি হল। যে জিনিস কোভিড রোগীর কাজে লাগবে না, সেটা নিয়ে ভুল বুঝিয়ে শুরু হল ডাকাতি। অক্সিজেন ক্যান বা স্প্রে। একদম মানুষ না জেনেই শুরু করল ক্রাউড ফান্ডিং করা। সেই টাকায় তারা কিনল অক্সিজেন ক্যান এবং দিতে শুরু করল রোগীর বাড়ির লোকজনকে। কোথায় বিন্যামূল্যে আবার কোথাও যথেষ্ট বেশি দামে। আসলে চেষ্টা হচ্ছিল স্রোতের বাজারে এই অক্সিজেন ক্যান নামক বস্তুটিকে ভিড়িয়ে দেওয়ার।

অক্সিজেন ক্যান নামক বস্তুটিকে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এখনও পর্যন্ত অনুমোদন দেয়নি। ফলে এটা কনজিউমার প্রোডাক্ট সেফটি কমিশনের আওতায় পড়ে না। তাই বিনা প্রেসক্রিপশনেই এটা পাওয়া যায় কিনতে। তবে এই ধরনের অক্সিজেন ক্যান একমাত্র কার্যকরী তাঁদের ক্ষেত্রে যাঁদের বেশি উচ্চতায় (high altitude) সমস্যা আছে, বা খেলাধুলার ক্ষেত্রে, অথবা ট্রেকিং বা মাউন্টেনিয়ারিং-এর সময় ক্যানড অক্সিজেন উচ্চতার কারণে আসা ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, মাথা যন্ত্রণা, বমিভাব কাটায়। এবার কোভিডে যাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে অক্সিজেনটা টানা দিতে হয়। যাদের অক্সিজেন লেভেল ৯০ এর নীচে নেমে যাচ্ছে তাদের এই অক্সিজেন ক্যান কোনও সাহায্যই করতে পারে না। কারণ অক্সিস্প্রে-র একটি ২ লিটারের ক্যান অর্থাৎ পকেট সাইজের ক্যানের অক্সিজেন ব্যবহার করা যাবে ৪০*১ সেকেন্ড। একই ভাবে ৩ লিটারের ক্যান ৬০ সেকেন্ড, ৫ লিটারে ১০০ এবং ১০লিটার ক্যানে ২০০ সেকেন্ড। ফলে বোঝাই যাচ্ছে কোভিডের কারণে নামতে থাকা অক্সিজেন স্যাচুরেশনের সমাধান এই ক্যান দিয়ে হবে না। এই অজ্ঞতার জন্য দাম বাড়ছে অক্সিজেন ক্যানেরও।

ফলে শহুরে কলকাতায় দেখা গেল নানা ধরনের ডাকাতদের চলে ফিরে বেড়াতে কলার উঁচু করে। তারপর তারা অপরাধ করল, পারও পেয়ে গেল এবং সে সব ঢেকে দেওয়া হল বাচ্চা ভোলানোর মতো করে। আর আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ৪৩-এর মন্বন্তরকে আরও একবার প্রত্যক্ষ করলাম। তফাৎ শুধু সেদিন পেটের খিদে মেটাতে সামান্য ফ্যানের চাহিদা ছিল আর আজ মানুষের প্রাণবায়ু।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *