- August 16th, 2022
বুদ্ধ ও নির্বাণ (পর্ব-২)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
বুদ্ধবাবুর তরফে আমার ওপর ক্রদ্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কেননা আমি আমার কলামে নিয়মিত তাঁর সমালোচনা করতাম, তাঁর অহংবোধ আর ঔদ্ধত্যকে উপহাস করতাম, মোটের ওপর আমি বিশ্বাস করতাম সুভাষ চক্রবর্তী জন-নেতা হিসেবে বুদ্ধদেবের চেয়ে অনেক বড়, অনেক বেশি তাঁর জনপ্রিয়তা, অথচ রাজ্য সিপিএমে তিনি গেঁয়ো যোগী, প্রাপ্যের অনেক বেশি গুরুত্ব পান বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কেন না তিনি ‘বিপ্লবী আধা-কবির প্রেসিডেন্সিতে বাংলা অনার্স পড়া ভ্রাতুষ্পুত্র।’
মধ্য-ষাটের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এমন বল্গাহীন, অসংযত ভাষা ব্যবহারের জন্য আমার অনুতাপ হয়, বুঝতে পারি কাজটা একেবারেই ঠিক হয়নি। একই সঙ্গে এ কথাও মানি এত বছর পরে কনফেশন বক্সে দাঁড়ানোটাও সম্পূর্ণ অর্থহীন। অনুতাপে হৃদয়ের বোঝা কিছুটা হাল্কা হয়, তার বেশি কিছু তো নয়।
তবে হ্যাঁ, সে সময় বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমার অঘোষিত দ্বৈরথ একেবারে চরমে উঠেছিল। অপছন্দটা ছিল পারস্পরিক। মহাকরণে কখনও-সখনও আমার সহকর্মীদের কাছে বুদ্ধদেববাবু আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতেন, আমার কানে সে সব কথা ঝড়ের গতিতে পৌঁছে যেত। যেমন একবার আমার কলামে আমি অধীর চৌধুরীর প্রশংসা করে কিছু লিখেছিলাম। সেটা পড়ে আমার এক সহকর্মীকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘আপনার বসকে বলে দেবেন রতনে রতন তো চিনবেই।’ সহকর্মীটিকে বললাম কাল বুদ্ধবাবুকে গিয়ে বলবি, শুয়োরে চেনে কচু। আমাদের এমন পারস্পরিক ঠোকাঠুকি এ ভাবে লেগেই থাকত।
কোভিড থেকে বাঁচতে ইদানিং ক্রিকেটারদের যেমন ‘বায়ো বাবলের’ মধ্যে থাকতে হয়, বুদ্ধবাবুও তাঁর পাশে তেমন একটি বাবল তৈরি করে নিয়েছিলেন যা ভেদ করে তাঁর কাছে পৌঁছন চাট্টিখানি বিষয় ছিল না। দিল্লিতে প্রায় নয় বছর ছিলাম, সিপিএম কভার করতে হতো, এক বুদ্ধবাবু ছাড়া বাকি প্রায় সকলের সঙ্গে সদ্ভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেন্ট্রাল কমিটি অথবা পলিটব্যুরোর বৈঠকে যোগ দিতে বাংলার প্রথম সারির সিপিএম নেতারা বছরে তিন চারবার দিল্লিতে আসতেন, রিপোর্টারদের সঙ্গে অনেকেই কথা বলতেন, মায় জ্যোতি বসুও, একমাত্র অধরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর শরীরের ভাষা বুঝিয়ে দিত আমাদের তিনি মনুষ্যপদবাচ্য বলেই মনে করেন না। আমাদের সঙ্গে কথা বলা মানে অযথা সময় নষ্ট করা। তাঁর এমন দুর্বোধ্য উন্নাসিকতা প্রথমে দূরত্ব রচনা করল তারপর সরাসরি বিদ্বেষ।
বুদ্ধদেব বুনো ওল হলে আমিও বাঘা তেঁতুল।
এমন নয় বুদ্ধদেববাবু কোনও সাংবাদিককেই পাত্তা দিতেন না। তাঁর পছন্দের কয়েকজন সাংবাদিকের একটি ছোট্ট বৃত্ত ছিল। তাঁদের সঙ্গে তিনি বন্ধুর মতো মিশতেন, গল্প-গুজব করতেন, মহাকরণে অথবা নন্দনে। সেই এক্সক্লুসিভ ক্লাবের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা কী ছিল বলতে পারব না, তবে তাঁদের লেখাপত্রে বুদ্ধদেবের প্রতি পক্ষপাত বিলক্ষণ বোঝা যেত। একই ভাবে সংস্কৃতি জগতেও বাছাই করা কিছু মানুষের হাতে অ্যাকসেস কার্ড থাকত, নন্দনে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে বসে তাঁরা চা-সিগারেটের সঙ্গে কখনও খুরোসাওয়া বা ফেলিনির ছবি দেখতেন, কখনও লাতিন আমেরিকায় বামপন্থার নবোদয় নিয়ে আলোচনা করতেন, কখনও বা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সর্বশেষ উপন্যাসটি নিয়ে। হয়তো বুদ্ধবাবুর নিজের মায়াকোভস্কি অনুবাদের প্রসঙ্গও বাদ যেত না। সংবাদ অথবা সংস্কৃতি, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি বলার লোক ছিল হাতে গোনা। তাঁর কথা-বার্তা, চাল-চলন, পছন্দ-অপছন্দ থেকে একটি বার্তাই পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠত, ওহে মূর্খের দল, তফাৎ যাও। সর্বহারার দলে এ যেন এক বিচিত্র রাজপুত্র।
সরকার বাড়ির মাত্র দু’জনকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রীতিমতো শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সম্পাদক অভীক সরকারকে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু চিনতেন, মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন আর পরে আমাকে বলতেন তোমাদের মালিক মোটেই সুবিধের নয়। কিন্তু ওঁর গিন্নির হাতের রান্নাটা খাসা। খেতে ভালোবাসতেন জ্যোতিবাবু, তাঁকে খাইয়েও সুখ ছিল। কিন্তু রাজ্যের তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলার বৃহত্তম সংবাদপত্র গোষ্ঠীর সম্পাদক-মালিকের সাক্ষাৎ আলাপ পরিচয়ও ছিল না। অভীকবাবুর সঙ্গে কথায়-বার্তায় আমারও মনে হতো না, বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আলাপে তিনি আদৌ উৎসাহী। অন্যদিকে বুদ্ধবাবুর হাবভাব দেখে মনে হতো, আনন্দবাজার ভবনটিকে কামান দেগে উড়িয়ে দিলেই ভালো, সেটাই হবে যথার্থ কমিউনিস্ট সুলভ কাজ। মোদ্দা কথায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন তিনি, বোধহয় হোয়াইট হাউসের চেয়েও বেশি।
একা বুদ্ধবাবুকে কাঠগড়ায় তোলাটা ঠিক হবে না, আনন্দবাজার সম্পর্কে জাতক্রোধ সিপিএম নেতাদের ডিএনএ-তেই ছিল। পরে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বুঝেছি এমন মারমুখী ‘আমরা-ওরা’ জাতীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল অনেকটাই আনন্দবাজারের কমিউনিস্ট বিদ্বেষী সম্পাদকীয় নীতির জন্য যা কখনও সখনও হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছে যেত। সিপিএমের প্রতিক্রিয়া ছিল পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে— ‘এভরি অ্যাকশন হ্যাজ ইকুয়াল অ্যান্ড অপোজিট রিঅ্যাকশন’। ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে সরকার বাড়িকে সবক শেখাতে সিপিএম চরম জঙ্গিয়ানা দেখিয়েছে, গুন্ডামিও করেছে বারেবারে। একবার যাদবপুরের কাছে আনন্দবাজারের কাগজের ভ্যান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল চালককে বের হওয়ার কোনও সুযোগ না দিয়ে। ১৯৮৪ সালে টানা ৫৪ দিন আনন্দবাজার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আলিমুদ্দিনের মদতপুষ্ট হাতে গোনা কয়েকজন সিপিএমপন্থী কর্মচারি লাগাতার ধর্মঘট করে বসায়। আমি তখন আনন্দবাজারের রিপোর্টিং বিভাগে কাজ করি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের নামে লাল-গুন্ডামির যে বীভৎস চেহারা তখন আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি, কোনও দিন তা ভোলার নয়।
আবার ঘোষিত শত্রু থেকে গলায় গলায় বন্ধুত্ব হতেও দেখেছি। একদা আনন্দবাজারের সবচেয়ে কড়া সমালোচক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে। সেও এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। (চলবে)