logo

যত দোষ কোচ ঘোষ

  • November 28th, 2022
Suman Nama

যত দোষ কোচ ঘোষ

সুমন চট্টোপাধ্যায়

দ্বিতীয় গোলটি হজম করার পরে গ্যালারির মেক্সিকান অংশটি থেকে একটি স্লোগান বারেবারে উঠছিল, আপনারা শুনেছেন কি? ‘ফুয়েরা তাতা’, ‘ফুয়েরা তাতা।’মানে ‘ফায়ার তাতা’। তাতাকে তাড়াও, পারলে এক্ষুনি, পারলে ঘাড় ধরে।

মেক্সিকোতে এই স্লোগান অনেক দিন ধরেই উঠছে।সেদেশের জাতীয় দলের কোচ জেরার্দো তাতা মার্তিনোর বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক কালে মেক্সিকো প্রত্যাশা মতো ভাল খলতে না পারার যাবতীয় দায় গিয়ে পড়েছে তাতার ওপর, সেই যত দোষ, নন্দ ঘোষের গপ্পো আরকি!

জেরার্দো তাতা মার্তিনো

প্লেয়াররা ভালো খলতে না পারলে কোচের ওপর দোষ চাপানোর ব্যাধিতে গোটা দুনিয়া জুড়েই সমর্থককুল আক্রান্ত, ফুটবল নিয়ে যাদের আবেগ যত বেশি, ততো সমানুপাতিক হারে গালমন্দ হজম করতে হয় কোচকে। কলকাতার ময়দানেও আমরা এ জিনিস ঘটতে দেখেছি হরবকৎ। দল জিতলে কোচকে মাথায় তুলে রাখা হবে, হারলে পপাত ধরণীতলে।

আর্জেন্টিনা-সৌদি আরবের খেলার দিন হাফ টাইমের সময় সৌদির ফরাসি কোচ হার্ভে রেনার্ড কী রকম টেবিলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে গলা সপ্তমে চড়িয়ে, নাটকীয়ভাবে প্লেয়ারদের ভ্যর্ৎসনা করছিলেন সেই ভিডিও ক্লিপটা দেখে সাতের দশকের প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে গেল। রেনার্ড গাল দিচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে একই রকম উচ্চকিত কন্ঠে তা আরবিতে তর্জমা করে দিচ্ছেন এক সৌদি ভদ্রলোক। সৌদি প্লেয়াররা চুপটি করে গালাগাল হজম করার পর দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্তিনাকে দু’গোল দিয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরে অমন দীর্ঘদেহী রেনার্ডকে মাথায় তুলে লাফালাফি করলেন। এমন ভোকাল টনিক যে প্রথমার্ধে যাদের বেতো ঘোড়া মনে হচ্ছিল তারাই ম্যাজিকের মতো হাফটাইমের পরে টাট্টু ঘোড়া বনে গেলেন।

কাতার বিশ্বকাপে এবার যে কয়জন কোচকে দেখলাম বার্নার্ড প্রশ্নাতীতভাবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে আবেগ প্রবন, মেজাজি ও রঙীন চরিত্র, অনেকটা পুরোনো ব্রাজিল দলের ম্যানেজার লুই ফিলিপে স্কোলারির মতো।পরের ম্যাচেই পোলান্ডের বিরুদ্ধে সৌদিরা পুনর্মূষিকভব হয়ে গেলেও রেনার্ডের চাকরি যাবে বলে মনে হয়না, কেননা সৌদিদের কাছে আর্জেন্তিনাকে হারানো বিশ্বকাপ জয়েরই সমতুল। কিন্তু জেরার্দো তাতা মার্তিনোর সেই সৌভাগ্য হবে কিনা সন্দেহ। এমনকী নিশ্ছিদ্র ব্যক্তিগত সুরক্ষার আগাম ব্যবস্থা না করে তিনি হয়ত মেক্সিকোর মাটিতে আর পা রাখার সাহসও পাবেননা। একে মা মনসা তায় ধুনোর গন্ধ। একে হার তদোপরি তাতা নিজেও যে আর্জিন্তিনীয়!

পরিহাস হোল, মেক্সিকান ফুটবলের বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছিল আর্জেন্তিনীয় কোচের তত্ত্বাবধানেই।নয়ের দশকে, সিজার লুই মেনোত্তি যখন কোচের দায়িত্ব নিলেন। তাঁর কোচ-গিরির মেয়াদ ছিল বড়জোর বছর দু’য়েক, তার মধ্যেই মেনোত্তি মেক্সিকান ফুটবলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন। গায়ের জোরের বদলে স্কিল, এই ছিল তাঁর বীজমন্ত্র। তবে কোনও বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে তিনি মেক্সিকোর কোচের দায়িত্বে ছিলেননা। এখন তিনি স্বদেশে জাতীয় দলের ডিরেক্টর যদিও মেক্সিকো এখনও তাঁকে শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গেই স্মরণ করে।

১৯৭৮ সালের যে আর্জেন্তিনীয় দলটি বিশ্বকাপ জিতেছিল, মেনোত্তি তার অধিনায়ক ছিলেন। কোচের দায়িত্ব পালন করতে মেক্সিকোয় পা দিয়েই তিনি রিপোর্টারদের বলেছিলেন তাঁর প্রথম কাজটিই হবে মেক্সিকোর আত্মার গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করা। কেন? মেনোত্তির দার্শনিক সুলভ জবাব ছিল, ‘Because the only way you can lead a national team is by understanding how it is inextricably linked to the country’s inner life.’

মেনোত্তির চেহারাটাও ছিল দর্শনীয়। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দু’গালে সাইড বার্ণ, খেলার সময় সাইডলাইনের ধারে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেতেন। পরণে রং-বেরঙা কোট-প্যান্ট, কথা বলতে বসলে সাহিত্য এমনকী রাজনীতির প্রসঙ্গও টেনে আনতেন অবলীলায়। মেক্সিকোর কোচ হিসেবে তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে মেনোত্তির দাবি ছিল, এখন আমি অনেক মেক্সিকানের চেয়েও মেক্সিকোকে ভালো বুঝি।

মেনোত্তি

তারপর দু’-দু’জন আর্জেন্তিনীয় মেক্সিকো দলের কোচ হয়েছেন, কারও কপালে মেনোত্তির তুলনীয় শ্রদ্ধা-সম্মান জোটেনি। প্রথমজন আন্তোনিও লা ভপে, ২০০২ থেকে চার বছর, অর্থাৎ ২০০৬-এ জার্মানির বিশ্বকাপ পর্যন্ত। স্টাইলে তিনি ছিলেন মেনোত্তির একেবারে বিপরীত মেরুতে, তাঁর গুরুমন্ত্রটি ছিল আকাশপথে নিজের ডিফেন্স থেকে উঁচু ভলি করে বলটা প্রতিপক্ষের অর্ধে পাঠিয়েই তড়িৎ বেগে আক্রমন শুরু কর। ২০০৫-এর কনফেডারেশন কাপে তিনি মেক্সিকোকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত টেনে তুলেছিলেন, তারপর আর্জেন্তিনার ম্যাচে পেনাল্টি শুটআউটে হেরে যায়।ঠিক তার পরের বছরেই বিশ্বকাপে সেই আর্জেন্তিনার কাছে হেরে মেক্সিকো প্রতিযোগিতা থেকেই ছিটকে যায়।

ব্যস, তারপর থেকেই লা ভপের বাপ-বাপান্ত শুরু হয়ে যায়, মেক্সিকোর প্রতি তাঁর আনুগত্য ঠিক কতখানি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। মেক্সিকান মিডিয়া হাত ধুয়ে তাঁর পিছনে পড়ে যায়, লা ভপেও তাঁদের ঘেন্না করতে আরম্ভ করেন। একবার দলের ট্রেনিং সেশনের পরে ক্রুদ্ধ কোচ অপেক্ষারত রিপোর্টারদের গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে বসেছিলেন।

আর্জেন্তিনীয় কোচেদের সম্পর্কে এমন শ্রদ্ধা ও ঘৃণার মিশ্র অনুভূতির মধ্যে জেরার্দো তাতা মার্তিনো মেক্সিকোর দলের কোচের দায়িত্ব নিয়ে আসেন, তাঁর তত্ত্বাবধানেই এবার কাতারে বিশ্বকাপের মূল পর্বে মেক্সিকোর প্রবেশ।

দলের দায়িত্ব নিয়েই তাতা মেক্সিকান ফুটবলের সুপারস্টার জেভিয়ার হার্নান্দেজকে ছেঁটে ফেলে দেন। সাময়িক সংযম প্রদর্শনের পরে ফের শুরু হয় কোচের সমালোচনা, জাতীয় দলের উপর্যুপরি ব্যর্থতার জন্য তাতাকে কাঠগড়ায় তোলা শুরু হয়। নাদান মার্কিন ফুটবল দলের কাছে হারার পরে সমালোচনার পারদ চড়চড় করে চড়তে শুরু করে। এরপরে একটি ছবি প্রকাশিত হয় যেখানে দেখা যায় তাতা আর্জেন্তিনীয় কোচ লায়োনেল এসকালোনির সঙ্গে খুবই অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা বলছেন। এই সর্ষের মধ্যে ভূত দেখাটা ছিল অহেতুক বাড়াবাড়ি কেননা ওঁরা দুজনেই যে ক্লাব থেকে ফুটবলার জীবন শুরু করেছিলেন তারই একটি অনুষ্ঠানের ছবি ছিল এটি।অবশ্য যারে দেখতে নারি তার চলন তো ট্যারা-ব্যাঁকা লাগবেই।বলা শুরু হোল তাতা আসলে ঘর শত্রু বিভীষণ, মেক্সিকোর শিবিরে আর্জেন্তিনীয় চর।

মেক্সিকোর ফুটবলের সর্বকালের সেরা তারকা অবশ্যই হুগো সাঞ্চেজ। ই এস পি এন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করে বসেন, মেক্সিকান নন এমন কেউ মেক্সিকো দলের কোচ হোন এটা তিনি ঘোরতর অপছন্দ করেন। ব্যস ঘি পড়ে ক্ষোভের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে। এরপর একদিন স্টেজিয়ামে মেক্সিকান সমর্থকদের মুখে ‘ফুয়েরা তাতা’ স্লোগান শুনে খুবই আশাহত হয়ে মার্তিনো সাংবাদিকদের বলেন, ‘ দেখে শুনে মনে হচ্ছে, আমি যেন মেক্সিকোর পাবলিক এনিমি নম্বর ওয়ান।’

আর্জেন্তিনা-মেক্সিকো ম্যাচে কাতারের স্টেডিয়ামে ফের শোনা গেল একই স্লোগান। তাতা এবার নিজে থেকেই মেক্সিকোকে টা টা করেন নাকি উল্টোটা হয় বলা মুশকিল!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *