logo

পড়লে হাই ওঠে, তবু সচিন তো

  • August 13th, 2022
Books, Suman Nama

পড়লে হাই ওঠে, তবু সচিন তো

পড়লে হাই ওঠে, তবু সচিন তো

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আত্মজীবনী লেখার অধিকার আছে কার? প্রচলিত ধারণা, একমাত্র কেষ্টবিষ্টুদের৷ যদিও ‘হনু’ না হলে আত্মজীবনী লেখা যাবে না বা যায়নি, এটাও সত্য নয়৷ আত্মজীবনী লিখেই নীরদচন্দ্র চৌধুরী অখ্যাতি থেকে খ্যাতির আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন৷ গ্রন্থটির নামকরণেও ছিল তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত৷ ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’৷ এক অখ্যাত ভারতীয়ের আত্মকথন৷

সব বিখ্যাত ব্যক্তিই যে আত্মজীবনী লেখার তাগিদ অনুভব করেন, এমনটা নয়৷ স্টিফেন হকিং যেমন অনেক দিন আগেই দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী লেখার কোনও বাসনাই তাঁর নেই৷ কেন? না তাঁর ব্যক্তিগত জীবন জনগণের সম্পত্তি হয়ে যাক, সেটা তাঁর একেবারেই কাম্য নয়৷ আত্মজীবনী লেখার বিপক্ষে ভি এস নইপলের যুক্তিটা আবার তাঁর বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের মতোই৷ ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি ক্যান ডিসটরট, ফ্যাকটস ক্যান বি রিঅ্যালাইনড৷ বাট ফিকশন নেভার লাইজ, ইট রিভিলস দ্য রাইটার টোটালি৷’ বিতর্কিত মিডিয়া-মোগল রূপার্ট মারডক আবার লোক ভাড়া করে দু’মাস ধরে তাঁকে নিজের জীবনের নানা কাহিনি শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘোর বিরক্তিতে রণেভঙ্গ দিয়েছিলেন৷ কেননা তাঁর মনে হয়েছিল, নিজের কথা বলতে বলতে তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন৷ ‘ইট ওয়াজ লাইক সেয়িং, দিস ইজ দ্য এন্ড৷ আই ওয়াজ মোর ইন্টারেস্টেড ইন হোয়াট ওয়াজ কামিং দ্য নেক্সট ডে অর দ্য নেক্সট উইক৷’

আবার আত্মজীবনী যদি লিখতেই হয়, তা হলে তার চরিত্রটাই বা কেমন হওয়া উচিত? এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে গেলে পরমহংসের সেই অমর উক্তিটির আশ্রয় নিতে হয় অনোন্যোপায় হয়েই৷ যত মত, তত পথ৷

এ ব্যাপারে জর্জ অরওয়েল আর টেনিস তারকা বরিস বেকার মোটামুটি একই মতের পন্থী৷ অরওয়েলের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, কোনও আত্মজীবনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলে তাতে ‘ডিসগ্রেসফুল’ কিছু না কিছু থাকতেই হবে৷ কোনও মানুষ যদি নিজের সম্পর্কে কেবল ভালো ভালো কথা বলেন তা হলে ধরে নিতে হবে তিনি মিথ্যাচার করছেন৷ কেননা, জীবনের গভীরে প্রবেশ করে কেউ যদি সৎভাবে আলো ফেলতে চায়, তা হলে দেখা যাবে জীবন আসলে পরাজয় আর বিপর্যয়ের সরণি ছাড়া আর কিছুই নয়৷ একই কথা একটু অন্য ভাষায় শোনা গিয়েছিল বরিস বেকারের গলায়৷ একটি আত্মজীবনী কেবল কয়েকটি ছবির চিত্র-মালা নয়৷ আত্মজীবনীর মানে সারি সারি গল্প, সততা এবং যতটা পারা যায় অন্যের ব্যক্তিগত জীবনের কোনও রকম ক্ষতি-সাধন না করে সত্যি কথাগুলো বলে যাওয়া৷

সহজ কথা যেমন সহজে বলা নিদারুণ কঠিন, ঠিক তেমনি নিজের কাছে আ-নখশির সৎ থেকে আত্ম-কথন করতে পারাটাও৷ পশ্চিমের তুলনায় এই অভাগা দেশে জীবনী বা আত্মজীবনীর নামে যা সচরাচর প্রকাশিত হয়ে থাকে, অরওয়েল বা নইপলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে তার বেশির ভাগই পাতে দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না৷ ইতি-উতি দু’-একটি সাহসী ব্যতিক্রম চোখে পড়লেও (যেমন অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহের আত্মজীবনী) আত্মজীবনীতে আত্ম-গোপনের প্রবণতা ভারতীয়দের জাতীয় ব্যাধি৷ ফলে জীবনী হয়ে দাঁড়ায় নিছক, অনাবশ্যক উপাসনা আর আর আত্ম-জীবনী পর্যবসিত হয় আত্ম-প্রবঞ্চনায়৷

আশ্চর্যের বিষয়, জীবনী অথবা আত্মজীবনী লেখায় সাধারণ ভাবে ক্রিকেটাররা বেশ দড়৷ এমনকী ভারতীয় ক্রিকেটাররাও৷ সবজান্তা উইকিপিডিয়ায় চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলাম ১৯৫১ থেকে ২০১৪, এই ৬৩ বছরে প্রতি বছর নিয়ম করে কোনও না কোনও ক্রিকেটারের হয় জীবনী নতুবা আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে৷ তবে আত্মজীবনীর সংখ্যাই তুলনায় অনেক বেশি৷ কোনও কোনও বছরে আবার একাদি ক্রমে পাঁচটি বইও প্রকাশিত হয়েছে৷ যেমন ২০০২ সালে বেরিয়েছে একে একে গ্যারি সোবার্স, শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়া, ড্যারেন গাও, মায় ফজল মেহমুদের আত্মজীবনী৷ ২০০৪-এ এই তালিকায় আছেন, অন্য কয়েকজনের সঙ্গে জাভেদ মিয়াঁদাদ, নাসের হুসেন, ড্যারেন লেমান, অ্যালেক স্টুয়ার্ট, গ্যারি কার্স্টেন৷ অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের তুলনায় সংখ্যাটা কম হলেও একেবারে পিছিয়ে নেই ভারতীয়রাও৷ যেমন এরাপল্লি প্রসন্ন, সুনীল গাভাসকার, যুবরাজ সিং এবং কপিল দেব৷ বিবিধ ‘ঘোস্ট রাইটার’ আর প্রকাশক জুটিয়ে ইতিমধ্যে তিন-তিনটি আত্মজীবনী লিখে ফেলে কপিল প্রমাণ করেছেন ছেলেবেলা থেকে গ্যালন গ্যালন দুগ্ধ-সেবন তাঁর একেবারেই বৃথা যায়নি৷ এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সচিনের ‘ম্যাগনাম ওপাস’, শিরোনাম ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’৷

অধিকাংশ ক্রিকেটারই আবার নিজের জীবন-কাহিনি লিখেছেন নিজেই৷ টনি লুইস, ব্রায়ান লারা, ডেভিড বুন, রিচি বেনো, মার্ক টেলর, কোর্টনি ওয়ালশ, গ্যারি সোবার্স, শেন ওয়ার্ন, ডেনিস লিলি, জাভেদ মিয়াঁদাদ, মাইক আথারটন, নাসের হুসেন, স্টিভ ওয়া, ইয়ান বথাম, গ্লেন ম্যাকগ্রা নির্ভর করেননি কারও উপর৷ অনেকেই আবার নিজের লেখার ব্যাপারে ষোলো আনা আত্মবিশ্বাসী হতে না পারায় সাহায্য নিয়েছেন পেশাদার লিখিয়ের এবং নিঃসঙ্কোচে তাঁদের নামও এনেছেন নিজের সঙ্গে একই বন্ধনীতে৷ যেমন বার্মিংহাম পোস্টের প্রাক্তন ক্রিকেট লিখিয়ে প্যাট্রিক মারফি আত্মজীবনী লেখার কাজে সাহায্য করেছেন পাঁচ দিকপাল ক্রিকেটারকে-ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রম, অ্যালান ডোনাল্ড, ভিভ রিচার্ডস এবং গ্রাহাম গুচ৷ এখানেও ব্যতিক্রম তেন্ডুলকার৷ ইচ্ছে করলে তিনি দুনিয়ার যে কোনও সু-লেখককে অনুরোধ করতে পারতেন তাঁর আত্মজীবনী লেখার জন্য, সকলেই সাগ্রহে সেই অনুরোধ শিরোধার্যও করতেন অবধারিত ভাবে৷ কিন্ত্ত সচিন সেই চেনা ও পরীক্ষিত রাস্তায় না হেঁটে এ কাজের জন্য বেছে নিয়েছেন তরুণ বঙ্গজ ইতিহাসবিদ বোরিয়া মজুমদারকে৷ কেন, সে প্রসঙ্গে আসছি পরে৷

এঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন অরওয়েলিয় সংজ্ঞা মেনে যাঁরা ‘ডিসগ্রেসফুল’ কথাবার্তা লিখে নিজেদের ভাবমূর্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কাজই শুধু করেননি, মিডিয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি করে কতকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই নিজের বইয়ের প্রচার ও বিক্রি তেজি করতে চেয়েছেন৷ যেমন শোয়েব আখতার, ইয়ান বথাম, হার্সেল গিবস, জিম লেকার৷ লেকারের আত্মজীবনী ‘ওভার টু মি’ প্রকাশিত হওয়ার পরে ইংল্যান্ডে এমন বিতর্কের ঝড় উঠেছিল যার মাশুল শেষ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল ইংরেজ ক্রিকেটারটিকেই৷ প্রথমে নিজের কাউন্টি তার পরে জাতীয় দল থেকে তিনি অবসর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ গিবস নিজের চারিত্রিক ‘গুণাবলি’র কথা অকপটে তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি এক ছটাকও৷ তিনি সাহস দেখিয়েছিলেন দেশের হয়ে খেলতে খেলতেই৷

ওয়াসিম আক্রম, জাভেদ মিয়াঁদাদ এবং পাকিস্তানের ক্রিকেট কর্তাদের এক হাত নেওয়ার পরে শোয়েবও স্বীকার করেছেন বল ট্যাম্পারিং-এর কথা৷ ঠিক যেমন বথামও তাঁর ক্রিকেট জীবনের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের নানা অপকর্মের কথা জানিয়ে দিয়েছেন একান্ত নিজস্ব বেপরোয়া ভঙ্গিতেই৷ এসেছে মারিজুয়ানা সেবনের প্রসঙ্গ, যৌন-জীবন, ইমরান খানের সঙ্গে তাঁর সেই বিখ্যাত মামলার প্রসঙ্গও৷ প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রতিটি বই সাময়িক ভাবে চলে এসেছিল বেস্ট সেলারের তালিকায়৷

এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সচিনকেও খোঁচা দিতে ছাড়েননি৷ যেমন শোয়েব আখতার লিখেছিলেন এক বার তাঁর বিদ্যুৎ-গতির একটা বল দেখে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানটিও নাকি ভয় পেয়ে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিলেন৷ একই ভাবে অস্ট্রেলিয়ায় হরভজন সিং আর অ্যান্ড্রূ সিমন্ডসের বচসার (মাঙ্কিগেট কেলেঙ্কারি নামে বিখ্যাত) প্রশ্নে সচিনের বয়ানের কড়া সমালাচনা করেছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট৷ বচনবাগীশ শোয়েবকে নিজের আত্মজীবনী লেখার সময় ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাননি সচিন৷ তবে মাঙ্কিগেট নিয়ে নিজের ভাষ্যটি বিস্তারিতেই লিখেছেন৷ বলেছেন তাঁর ব্যাটিং পার্টনার হরভজন সে দিন বচসার মধ্যে সিমন্ডসকে মাঙ্কি বলে ডাকেননি৷ বলেছিলেন ‘তেরি মা কি’৷ ‘মা-কি’-টাই উচ্চারণ দোষে হয়তো শুনিয়েছিল মাঙ্কি৷ তাঁর বক্তব্যের সরাসরি বিরুদ্ধে গেলেও গিলক্রিস্ট কিন্ত্ত সচিনের এই ভাষ্য পড়ে মোটেই বিরক্ত অথবা ক্রুদ্ধ হননি৷ বরং কিছুটা মজা করেই বিলেতের ডেইলি টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গিলক্রিস্ট বলেছেন, ‘সচিন, রিকি, আমি, ম্যাথু হেডেন এবং অনিল কুম্বলে প্রত্যেকেই ওই ঘটনার নিজের মতো ভাষ্য দিয়েছি৷ তার মধ্যে কোনটা যে সত্যি, তা কে-ই বা বলতে পারে?’

রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটে বল না লাগা সত্ত্বেও এক বার উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে গিলক্রিস্ট কট বিহাইন্ডের আবেদন করে অ-খেলোয়াড়োচিত মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন বলে লিখেছেন সচিন৷ গিলক্রিস্ট তাতেও কোনও অন্যায় দেখেননি৷ তাঁর কথায়, ‘আত্মজীবনী হল ব্যক্তির নিজস্ব স্মৃতি-চারণ৷ ফলে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়ন থাকতেই পারে৷ আমি মনে করি, এটা সচিনের নিজস্ব মতামত এবং সেই মতামত জানানোর অধিকার সে নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছে৷’

মাঙ্কিগেট কাণ্ডের মতো এমন খুচরো মশলা, অনেক অজানা গপ্পো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সচিনের পাঁচশো-পাতার আত্মজীবনীতে৷ আছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের নানা চমৎকার কাহিনিও৷ তবু আত্মজীবনী বলতে যাঁরা ওই অরওয়েলিওয় সংজ্ঞাকেই ধ্রুব-জ্ঞান করেন, পাতার পর পাতায় মশলা খুঁজে না পেলে যে সব ক্ষত্রিয়-সমালোচকের ক্ষুধা তৃপ্ত হয় না, আত্মা-অতৃপ্ত থাকে, তাঁরা বলছেন, বইটা পড়তে পড়তে নাকি হাই ওঠে, মনে হয় চোখের সামনে যা দেখে ফেলেছি, যা কিছু আমাদের জানা তারই ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নেই৷ সাংবাদিক-ভাষ্যকার হর্ষ ভোগলে একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘সচিন যে দিন ব্যাট হাতে সফল হয়, ভারতবর্ষ সে দিন ঘুমোতে যায় শান্তিতে৷’ এ বার সচিনের আত্মজীবনী পড়ে হাই তুলে গুটিকতক ভারতবাসী যদি নিদ্রায় ঢলে পড়তে পারেন, ক্ষতি কী!

প্রায় সিকি শতক ক্রিকেট খেলেছেন সচিন, বস্ত্তত জন্মাবধি ক্রিকেট খেলা ছাড়া এই ভারত-রত্নটি আর কিছুই করেননি৷ যতদিন খেলেছেন কোনও বিতর্ক, কোনও কলঙ্কের ছোঁয়া নিজের গায়ে লাগতে দেননি তিনি৷ বল ট্যাম্পারিংয়ের জন্য মাইক ডেনেস একবার তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পরে সচিন প্রমাণ করে দিয়েছিলেন শারীরিক উচ্চতাটা তাঁর পাঁচ-ফুট-পাঁচ-ইঞ্চি হলেও চরিত্রের ঋজুতা অশ্বত্থের গুঁড়ির মতোই৷ ক্রিকেট সচিনের কাছে নিছক খেলা ছিল না, ছিল নিবিষ্ট, নিবেদিত উপাসনা৷ খেলতে গিয়ে অবশ্যই তিনি একটার পর একটা দুর্লঙ্ঘ রেকর্ড গড়েছেন, যশ আর বৈভবের চূড়োয় পা রেখেছেন, সওয়া ’শো কোটি দেশবাসীর প্রত্যাশা নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন নীরবে, এ সব কথাই ঠিক৷ কিন্ত্ত তার মধ্যে দিয়ে একান্ত নিজস্ব একটা জীবন-চর্চা ও জীবনাদর্শকেও তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন প্রতি-নিয়ত৷ এমন একটা জীবনচর্চা যা সৎ, সংযমী এবং সর্বোপরি মধ্যবিত্ত-মূল্যবোধের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত৷ পাঁকের গন্ধ তিনি পেয়েছেন ঠিকই, কিন্ত্ত পাঁক-চর্চা থেকে নিজেকে রেখেছেন কয়েক আলোকবর্ষ দূরে৷

এই পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রাখলেই বোঝা যায়, সচিনের আত্মজীবনীটিও একেবারে সচিনের মতোই৷ তিনি রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেসের মতো বেসামাল ঝোড়ো হাওয়া নন, ইমরানের মতো প্লে-বয়ও নন, বিখ্যাত নন শেন ওয়ার্ন বা বথামের মতো যৌন ব্যভিচারের জন্যও৷ ফলে নিজের ক্রিকেট জীবনের গন্ধমাদন থেকে তিনি সেইটুকুই বেছে নিয়েছেন, যেটুকু তাঁর মনে হয়েছে বিশল্যকরণী৷ সেটা তাঁর ক্রিকেট। বাইশ গজের বাইরের কোনও বিষয়ে তাঁর কোনও আগ্রহই নেই৷

যখন খেলেছেন ইতিহাসকেই মাথায় রেখেছেন সচিন৷ খেলার শেষে যখন আত্মজীবনী লেখার কথা ভেবেছেন তখনও ঠিক একই ভাবে ওই ইতিহাসের কথাই ভেবেছেন নিজের মতো করে৷ তাঁকে যাঁরা খেলতে দেখেছেন শুধুমাত্র তাঁদের জন্যই লেখেননি সচিন, লিখেছেন সেই ভাবী প্রজন্মের কথা ভেবে যাঁরা এক দিন শুধু তাঁর গল্প শুনবেন এবং শুনতে শুনতে মনে হবে কই দেখি তো নিজের খেলা সম্পর্কে নিজে কী লিখে গিয়েছেন ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানটি৷ সচিন জানেন, সাহিত্য রস স্রষ্টার দায় বিধাতা তাঁকে দেননি৷ বইয়ের পাতায় পাতায় বিতর্ক সৃষ্টি করার দায়ও নেই তাঁর৷ তাঁর প্রয়োজন একজন ইতিহাসের কারবারির, যিনি ক্রিকেট-সাহিত্য রচনার চোরাবালি এড়িয়ে গিয়ে বস্ত্তনিষ্ঠ ভাবে তথ্যকে লিপিবদ্ধ করতে পারবেন৷ সে জন্যই দুনিয়ায় এত লোক থাকতে ক্রীড়া-ঐতিহাসিক বোরিয়াকে বেছে নিয়েছেন তিনি৷ সচেতন ভাবেই সচিন চেয়েছেন তাঁর ক্রিকেট জীবনের একটি প্রামাণ্য দলিল, শেষ পর্যন্ত যা যত্ন করে রাখা থাকবে গ্রন্থাগারে, অপেক্ষা করবে ভবিষ্যতের গবেষকের জন্য৷

অন্যেরা মনে করেছেন ‘কনট্রোভার্সি-মার্কেটিং’-ই তাঁদের পাথেয় হওয়া উচিত৷ সচিন ভেবেছেন ঠিক উল্টোটা৷ অর্থাৎ তিনি বিতর্ক সৃষ্টি করবেন, চর্চিত বিতর্ক সম্পর্কে কোনও রকম মন্তব্য না করেই৷ হয়েছেও তাই৷ অযথা বিতর্ক এড়িয়েই সচিন হারিয়ে দিয়েছেন ড্যান ব্রাউন বা রাওলিংয়ের মতো বিশ্ব-রেকর্ড করা লিখিয়েদের৷ আত্মজীবনী নিয়ে ইংরেজ সাহিত্যিক কোয়েন্টিন ক্রিস্পের সেই মজার উক্তিটিও নিশ্চয়ই সচিনকে আগেভাগে শুনিয়ে রেখেছিলেন কেউ৷ ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি ইজ অ্যান অবিচুয়ারি ইন সিরিয়াল ফর্ম উইথ দ্য লাস্ট ইনস্টলমেন্ট মিসিং৷’

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *