logo

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির দেশ

  • December 13th, 2022
Suman Nama

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির দেশ

সুমন চট্টোপাধ্যায়

মহিনের ঘোড়াগুলির নায়ক গৌতম চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি অবিস্মরণীয় গানে একটি প্রশ্ন উসকে দিয়েছিলেন, ‘ভেবে দেখেছ কী, তারারাও কত আলোকবর্ষ দূরে?’ আগামী বুধবার আর্জেন্তিনা সেমি-ফাইনাল খেলতে নামার আগে তেমনি একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আমার। ভেবে দেখেছ কী মেসিদের বিশ্বকাপ দলে কেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ও নেই ?

সত্য কবুল করছি, এ যাবৎ এমন একটি প্রশ্ন আমার মনেও কদাচ জাগেনি। আরও মর্মন্তুদ সত্যটি হোল, উত্তরটি হৃদয়ঙ্গম হওয়ার পরে আর্জেন্টিনা দেশটির প্রতি আমার আ-কৈশোর প্রেম চটকে অ্যায়সি কি তেইসি হয়ে গেল। মূর্তির পিছনে খড়ের কাঠামোটি দেখলে যেমন হয়।

নিবন্ধটি হেজিপেজি কেউ লেখেননি, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী কোনও সাংবাদিকও নন। তিনি নিজেও আর্জেন্তিনিয়ান, টেক্সাসের আল পাসো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত গবেষক-অধ্যাপক, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন। তাঁর একটি সাড়া জাগানো গ্রন্থের নাম,’ Hiding in Plain Slight, the Black women, the Law and the Making of a White Argentine Republic’। লেখকের নাম এরিকা ডেনিস এডওয়ার্ডস।

ব্রাজিল সহ অন্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলির কথা নাহয় হিসেবের বাইরে রাখা গেল, অধুনা শ্বেতাঙ্গ ইউরোপেও ‘অল হোয়াইট টিম ‘ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ফ্রান্সের আজকের ফুটবল দলে শ্বেতাঙ্গ ফরাসি খুঁজে বের করতে হলে দূরবীনের সাহায্য প্রয়োজন। বিবিধ ইউরোপিয়ান ফুটবল লিগের প্রথম সারির দলগুলির ক্ষেত্রেও কি একই সত্য অক্ষরে অক্ষরে প্রযোজ্য নয়? তাহলে আর্জেন্তিনা কত বড় তালেবর যে এই নিয়মে ব্যতিক্রম সেজে নিজেকে সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গদের দেশ বলে পরিচয় দেয়, একজন কৃষ্ণাঙ্গকেও দলে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনা ? যে কোনও আর্জেন্তিনীয়কে এই প্রশ্নটি করুন, শুনবেন সব শেয়ালের এক রা’। দেশে যাদের অস্তিত্বই নেই তাদের দলে নেওয়ার প্রশ্নটাই বা উঠছে কী করে?

স্বদেশে বিদেশি

এরিকা ডেনিস তন্নতন্ন তথ্য-তালাশ করে প্রমাণ করে ছেড়েছেন এটি একটি কাচ্চি ঘানির সর্ষের তেলের মতো বিশুদ্ধ ঢপ যার উৎসে আছে ২০১০ সালে আর্জেন্তিনীয় সরকার প্রকাশিত একটি সেনসাস রিপোর্ট যেখানে বলা হচ্ছে সেদেশের জনসংখ্যার মাত্র দেড় লাখ দেশবাসী কালা আদমি, মানে মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম। এই পরিসংখানই তো বলে দিচ্ছে আর্জেন্তিনা আদতে আপাদমস্তক একটি শ্বেতাঙ্গ দেশ।

ইতিহাস কি একে সমর্থন করে? এরিকা বলছেন স্পেনের উপনিবেশ থাকাকালীন কোনও এক সময় দুই লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ বন্দী একসঙ্গে রিও দে লা পন্তে বন্দরে অবতরণ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত আর্জেন্তিনার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। এরিকার ভাষায়, ‘Indeed not only is the idea of Argentina as a white nation inaccurate, it clearly speaks to a longer story of Black erasure at the heart of the country’s self- definition.’

জ্বলজ্যান্ত মানুষ কি কাগজের ওপর পেন্সিলে আঁকা স্কেচ নাকি যে ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা যায়? আর্জেন্তিনীয়রা সাধারণভাবে তিনটি মিথ অথবা গপ্পো প্রচার করে থাকে যার মধ্যেই নাকি লুকিয়ে আছে কালো-অন্তর্ধান রহস্য। প্রথমটি হোল এই রকম। ঊনবিংশ শতকে আর্জেন্তিনায় যে লাগাতার যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছিল তাতে কালা আদমিদের ব্যবহার করা হত ‘ক্যানন ফডার’ হিসেবে, মানে প্রতিপক্ষের ছোঁড়া কামানের গোলার মুখে তাদেরই ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হোত। তার ফলে এই জনজাতির একটি বড় অংশই যুদ্ধের বলি হয়ে স্বর্গে চলে গিয়েছে। স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে (১৮১০-১৮১৯) আর্জেন্তিনার বিদ্রোহী সেনাদলে দলে দলে কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা নাম লিখিয়েছিল সুস্পষ্ট এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে যে দেশ স্বাধীন হলে তাদেরও শৃঙ্খলমুক্ত করে দেওয়া হবে।

যুদ্ধে দলে দলে নিহত হওয়ার তত্ত্ব যে অনেকটাই আজগুবি এরিকার গবেষণার অনেক আগে অন্য ঐতিহাসিকেরা তার পর্দা ফাঁস করে দিয়েছেন। তাঁরা হিসেব করে দেখিয়েছেন, আর্জেন্তিনার হয়ে ভাড়াটে সেনা হয়ে লড়তে গিয়ে যতজন কৃষ্ণাঙ্গের প্রাণহানি হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, আর জন্মস্থানে ফেরেননি, বিশেষ করে পেরুর লিমা শহরে। ১৮২৯ সালে একটি ছোট আফ্রিকান ইউনিটের রোলকল নিয়ে দেখা গিয়েছিল মাত্র ৩১ জন যেখানে যুদ্ধে মরেছেন, ৮০২ জন সেখানে আপনি বাঁচলে বাপের নাম করে রণেভঙ্গ দিয়েছেন। তবে দেশান্তরি হয়েছিলেন যারা সময় গেলে তাদের বেশিরভাগ আবার ফিরেও এসেছেন। আর্জেন্তিনার সবচেয়ে জনবহুল শহর বুয়েনস আইরেসে ওই একই সময়ে ( ১৭৭৮ থেকে ১৮৩৬) আফ্রিকান বংশধরেদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছিল। এমনি এমনি!

দ্বিতীয় গপ্পোটি আরও মজার। তা হোল ঊনবিংশ শতকের যুদ্ধবিগ্রহে অসংখ্য কালা আদমির মৃত্যুর পরে কৃষ্ণাঙ্গিনীদের সামনে একটি রাস্তাই খোলা ছিল, হয় ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের বিয়ে করা অথবা সহবাস করা। এর ফল হয়েছে এই যে ধীরে ধীরে কালো গাত্রবর্ণটাই একদিন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। এমন সংমিশ্রনের ফলে একটি নতুন প্রজাতির জন্ম হয়েছে যারা গতরে হাল্কা কিন্তু প্রায় শ্বেতাঙ্গ। এর থেকে পরিষ্কার আর্জেন্তিনার কৃষ্ণাঙ্গিনীরা একটি দমনমূলক রাষ্ট্রের হাতের খেলনা হয়ে উঠেছিলেন, রাষ্ট্রের কথায় ওঠা-বসা করতে তাঁরা বাধ্য ছিলেন।

এখানেই গপ্পোগাছায় যতিচিহ্ন টানা যাচ্ছেনা। তৃতীয় মিথটি হোল যুদ্ধের পাশাপাশি ১৮৭১-এর ইয়েলো ফিভার মহামারিতেও অনেক কালা আদমির মৃত্যু হয়েছিল। একাংশের যুক্তি এই মহামারি সর্বগ্রাসী চেহারা ধারণ করেছিল বুয়েনস এয়ার্সের কালো মহল্লাগুলিতেই, দারিদ্রের কারণে তারা নিজেদের ঘেটো থেকে বেরোতে পারেনি। পরে অবশ্য এই মনগড়া তত্ত্বটিও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানে খানখান হয়ে গিয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে ইয়েলো ফিভার গায়ের রঙ দেখে আক্রমন করেনি।

বাস্তব সত্যটি হোল, শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গের ভিটেমাটি ছিল আর্জেন্তিনা। এদের মধ্যে একটা অংশকে গায়ের জোরে আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস বানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, বাকিরা এসেছিল জাহাজের খালাসি অথবা সস্তার মজুরের কাজ নিয়ে। ১৯৩০ এবং চল্লিশের দশকেও তাদের দেখা মিলত এই লাতিন আমেরিকান দেশটিতে।

এই যে ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ মাখিয়ে কালোদের সাদা বলে চালানোর প্রয়াস এটা ছিল দীর্ঘদিন যাবৎ আর্জেন্তিন রাষ্ট্রের সুপরিকল্পিত নীতি। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এর সূচনা করেছিলেন ডমিনিগো ফস্টিনো সারমিয়েন্টো। তাঁর চোখে শ্বেতাঙ্গ হওয়াটা ছিল আধুনিকতার সমার্থক। তাঁর ‘ Facundo, Civilization and Barbarism’ শীর্ষক গ্রন্থে সারমিয়েন্টো তাঁর এমতো বর্ণবিদ্বেষী বিশ্বাসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর সুচিন্তিত মতামত ছিল আর্জেন্তিনাকে তার অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠে ‘সভ্য’ দেশে রূপান্তরিত হতে হবে, সেটা সম্ভব হতে পারে একমাত্র ইউরোপীয় দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। পাশাপাশি আরও দুটি যে ঐতিহ্য একই সঙ্গে বহমান, কৃষ্ণাঙ্গ এবং আমেরিনডিয়ান, তাকে তিনি গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেননি। ১৮৫৩ সালে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরে আর্জেন্তিনার একমাত্র নক্ষ্য হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় ধাঁচের আধুনিকতা, কেননা তাতেই হবে মোক্ষলাভ। এই অভীষ্ট পূর্ণ করতে গেলে সামনে একমাত্র অন্তরায় কালা আদমি যাদের সঙ্গে করে সভ্য অথবা আধুনিক কোনওটাই হওয়া যায়না। ফলে আর্জেন্তিনা দু’হাত তুলে ইউরোপীয়দের আহ্বান জানাতে শুরু করল তাদের দেশে এসে বসতি গড়ার জন্য, ইউরোপিয়ান ইমিগ্রেশন হোল সরকারের বহুল প্রচারিত ঘোষিত নীতি।

একথা অনস্বীকার্য, ব্রাজিল, উরুগুয়ে কিংবা কিউবার মতো লাতিন আমেরিকান দেশগুলিও এমন ‘হোয়াইট ওয়াশিং’-এর নীতি গ্রহন করেছিল। তবে তারা আর্জেন্তিনার মতো সফল হয়নি। বরং প্রেসিডেন্ট সারমিয়েন্টো স্বাভাবিক অবজ্ঞা আর ঔদ্ধত্যের সঙ্গে কটাক্ষ করেছিলেন,’ Twenty years hence, it will be necessary to travel to Brazil to see Blacks.’ তাঁর পরিষ্কার চেতাবনী ছিল, আর্জেন্তিনার কালা আদমিদের রাষ্ট্র আর বেশিদিন স্বীকৃতি দেবেনা। অনতিকালের মধ্যেই সেদেশের ল্যান্ডস্কেপ আমূল বদলে গেল, সরকারের ডাকা সাড়া দিয়ে ১৮৬০-৭৪ এর মধ্যে চল্লিশ লাখ ইউরোপীয় এল আর্জেন্তিনায়। সেই অভিবাসী স্রোত এখন ফল্গুধারা তবে আর্জেন্তিনার সংবিধানে এখনও জ্বলজ্বল করছে উদ্বাহু হয়ে শেতাঙ্গ আবাহনের ডাক।

ডমিনিগো ফস্টিনো সারমিয়েন্টো

এমতাবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গ অথবা আমেরিনডিয়ান জনগোষ্ঠী মজবুর হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যেটা করণীয় সেটাই করেছে। সীমানার ফাঁক গলে ভারতে আসা বাংলাদেশিরা যেমন প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে নিজেদের ভারতীয় এবং হিন্দু বলে পরিচয় দেয়, মুসলিম মেয়ে সিঁথিতে সিঁদুর দেয় অনেকটা তেমনি আর্জেন্তিনার কৃষ্ণাঙ্গরা বলতে শুরু করল তারা কৃষ্ণাঙ্গ নয়, সাদা-কালোর মিশ্রনে তৈরি হওয়া মিশ্র জনগোষ্ঠীর একজন। এমন অর্ধসত্য তাদের বলতেই হবে অন্যথায় সরকারি কোনও ররম সুযোগ সুবিধের নাগাল তারা পাবেনা।

ফলে শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি হরেকরকমবা মিশ্র জনগোষ্ঠী আছে আর্জেন্তিনায়। একদলকে বলে ‘ক্রিয়োলো’, যাদের পূর্বপুরুষেরা হয় স্প্যানিশ নতুবা আমেরিনদিয়ান। আছে ‘মরোচো’ (তামাটে গাত্রবর্ণ), ‘পার্দো’( বাদামি গায়ের রং), এবং ‘ত্রিগুয়েনো’ ( গমের মতো গাত্রবর্ণ)।

শ্বেতাঙ্গরা এদের স্বজন বলে মনে করে তা নয়, করার প্রশ্নই বা কোথায়। তবে এই মিশ্র পরিচয়ের জোরে এরা টিকে আছে, সরকারি সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে। হাজার হোক তাদের তো আর কেউ কালা আদমি বলছেনা। আর সেটাই তো এদের কাছে অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম ও শেষ শর্ত।

তার মানে আর্জেন্তিনার শ্বেতাঙ্গ দেশ হওয়ার দাবি কিছুটা কষ্টকল্পিত, বেশিটা আরোপিত। এই সত্য প্রতিফলিত সে দেশের ফুচবল দলেও।বরং ধবধবে সাদা পলেস্তরার পিছনে লুকিয়ে আছে যে মর্মান্তিক সত্য সেটাও ইতিহাস। ময়ূরের পুচ্ছ ধারণ করে কাক কি কখনও ময়ূর হতে পারে?

“মরোচো” তবু আরাধ্য

কথায় আছে ভগবানের মার, দুনিয়ার বার। নিজেদের মাদার ডায়েরির দুধের মতো বিশুদ্ধ সাদা বলে হ্যাংলামি করে যে আর্জেন্তিনা, তাদের আরাধ্য কিন্তু আই এস ও সার্টিফায়েড কোনও শ্বেতাঙ্গ নন। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি নীতির ফসল এক ‘মরোচো’, যাকে এই পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতিটি দ্বিপদ প্রাণী এক ডাকে চেনে, ভক্তি করে, পুজো করে, কেউ কেউ আবার মূর্তি গড়ে তোলে। তার আলোতেই আলোকিত আজ আর্জেন্তিনা এবং এখনও।

দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা ফ্রাঙ্কো।

3 comments

  1. বর্ণবিদ্বেষ এভাবে তুলে আনার জন্য আপনাকে শতকোটি নমন।🙏

  2. ‘টু-ইন-ওয়ান’!
    বিশ্বকাপকে ঘিরে, খেলার কথা, দেশের অতীত ইতিহাস আমরা জানতে পারছি।
    কিন্তু মন বলে —- প্রেমে ( ফুটবল) মজিলে মন, কিবা কালা( আর্জেন্তিনা ব্রাজিল …) কিবা ধলা….

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *