logo

অনিল বিশ্বাস: বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য

  • August 13th, 2022
Reminiscence, Suman Nama

অনিল বিশ্বাস: বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য

অনিল বিশ্বাস: বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য

সুমন চট্টোপাধ্যায়

(ভোট চলছে বঙ্গে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁদের সরব উপস্থিতি ব্যতিরেকে বঙ্গে ভোট-রঙ্গের কথা ভাবাই যেত না। তাঁরা নেই, আবার আছেনও, আমার স্মৃতি ও সত্তায়। তেমনই কয়েকজন বঙ্গ-রাজনীতির মহারথীদের নিয়ে আমার এই সিরিজ। প্রথমে অনিল বিশ্বাস। প্রথম পর্ব)

অনিল বিশ্বাস বেঁচে থাকলে কি বঙ্গীয় সিপিএমের এমন করুণ হাল হত?

জানি, ইতিহাস এমন একটি অবান্তর প্রশ্নকে ছুঁয়েও দেখবে না৷ কী হলে কী হতে পারত ঐতিহাসিকের কাছে তা আদৌ বিবেচ্য নয়৷ তবে জনতার সরণিতে এবংবিধ স্বপ্নিল জল্পনা-কল্পনা হামেশাই ঘোরাফেরা করে, বাক্‌-বিতণ্ডা হয়, দীর্ঘশ্বাসও পরে৷ অনিল বিশ্বাস সম্পর্কে এ হেন মন্তব্য বারেবারে শুনে থাকি বোধহয় সেই কারণেই৷

ঐতিহাসিক সারবত্তা না থাক, একজন মানুষের মৃত্যুর এত দিন পরেও তাঁকে ঘিরে কমরেড বা সমর্থকের মনস্তাপ প্রকারন্তরে তাঁর অপরিসীম গুরুত্বেরই সূচক৷ কাকাবাবু থেকে সূর্যকান্ত পর্যন্ত রাজ্য সিপিএমের সম্পাদক হয়েছেন অনেকেই৷ তাঁদের প্রায় সকলেরই অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল, তাঁরা বিশেষ সজ্জন মানুষও ছিলেন৷ যেমন সরোজ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন দাশগুপ্ত কিংবা বিমান বসু৷ কিন্তু ডাকাবুকো সংগঠক, দলের প্রকৃত কাণ্ডারি হিসেবে আলোচিত হয়ে থাকে স্রেফ দু’টি নাম - প্রমোদ দাশগুপ্ত আর অনিল বিশ্বাস৷ গুরু-শিষ্য৷

প্রমোদবাবুর সঙ্গে অনিলদার তুলনা টানা কতটা সমীচীন হবে বলতে পারব না৷ কেননা যে-কোনও ব্যক্তির সাফল্য অথবা ব্যর্থতা সমসাময়িকতার মানদণ্ডেই বিচার হওয়া উচিত৷ সেই কারণেই ফুটবলার হিসেবে কে বড় চুনী গোস্বামী না বাইচুং ভুটিয়া, বা কে বড় ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাসকার না শচিন তেন্ডুলকর, এ ধরনের তুলনার যেমন কোনও অর্থ হয় না, ঠিক তেমনি সংগঠক হিসেবে কে বড় প্রমোদবাবু না অনিলদা সেই তুলনাটিও নিরর্থক৷ কংগ্রেসি জমানায় অবিশ্বাস্য প্রতিকূলতার মধ্যে প্রমোদবাবু শক্ত হাতে দলের হাল ধরে রেখেছিলেন, সেটা রাজ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংগ্রামের পর্ব৷ আর অনিলদা রাজ্যে সিপিএমের কাণ্ডারি হয়েছিলেন বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার ২১ বছর পরে, ১৯৯৮ সালে৷ কোন কাজটা বেশি কঠিন, দলকে ক্ষমতায় আনার পথ প্রশস্ত করা না দীর্ঘদিন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করা দলের সহস্র ছিদ্র বুজিয়ে বুজিয়ে ঐক্য বা সংহতি রক্ষা করতে পারা, বলা কঠিন৷

প্রমোদবাবুর সঙ্গে অনিলদার তুলনা টানা কতটা সমীচীন হবে বলতে পারব না৷ কেননা যে-কোনও ব্যক্তির সাফল্য অথবা ব্যর্থতা সমসাময়িকতার মানদণ্ডেই বিচার হওয়া উচিত৷ সেই কারণেই ফুটবলার হিসেবে কে বড় চুনী গোস্বামী না বাইচুং ভুটিয়া, বা কে বড় ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাসকার না শচিন তেন্ডুলকর, এ ধরনের তুলনার যেমন কোনও অর্থ হয় না, ঠিক তেমনি সংগঠক হিসেবে কে বড় প্রমোদবাবু না অনিলদা সেই তুলনাটিও নিরর্থক৷ কংগ্রেসি জমানায় অবিশ্বাস্য প্রতিকূলতার মধ্যে প্রমোদবাবু শক্ত হাতে দলের হাল ধরে রেখেছিলেন, সেটা রাজ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংগ্রামের পর্ব৷ আর অনিলদা রাজ্যে সিপিএমের কাণ্ডারি হয়েছিলেন বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার ২১ বছর পরে, ১৯৯৮ সালে৷ কোন কাজটা বেশি কঠিন, দলকে ক্ষমতায় আনার পথ প্রশস্ত করা না দীর্ঘদিন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করা দলের সহস্র ছিদ্র বুজিয়ে বুজিয়ে ঐক্য বা সংহতি রক্ষা করতে পারা, বলা কঠিন৷

জ্যোতি বসুর সক্রিয় সমর্থন ব্যতিরেকে অনিলদা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হতেন না৷ যদিও তিনি রাজ্য সম্পাদক হওয়ার মাত্র দু’বছরের মাথাতেই জ্যোতিবাবু মহাকরণকে আলবিদা জানিয়ে তাঁর শূন্যস্থানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বসিয়ে দিয়েছিলেন৷ ২০০১-এর বিধানসভা ভোটের মাত্র ছয় মাস আগে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে জ্যোতি বসুর ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা অনিল বিশ্বাসই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দলের কার্যালয়ে বসে করেছিলেন৷ তার অনেক আগে থেকেই প্রবীণ মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যেই অবসর নেওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করে আসলেও দলের ভিতরে-বাইরে অনেকেই ছিলেন যাঁরা জ্যোতিবাবুর অভিপ্রায়কে তেমন একটা গুরুত্ব দিতে চাননি৷ এক দলের ধারণা ছিল ইস্তফা দিলে জ্যোতিবাবু সেই সিদ্ধান্ত নেবেন একেবারে বিধানসভা ভোটের বাদ্যি বেজে যাওয়ার পরে৷ দ্বিতীয় দলের ধারণা ছিল, বৃদ্ধের অপারগতার অজুহাত আসলে সহানুভূতি কুড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদে থেকে যাওয়ার কৌশল মাত্র, তিনি কিছুতেই মহাকরণ ছাড়বেন না৷ আসলে দলে ও সংগঠনে জ্যোতিবাবুর অপরিহার্যতা ধীরে ধীরে এমন একটি নির্বিকল্পতার বিন্দুতে পৌঁছেছিল যে তাঁকে ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সিপিএম বা বামফ্রন্ট ভাবাই যেত না৷ পিছন ফিরে এখন মনে হয় সেই অপরিহার্যতাবোধের কারণেই জ্যোতিবাবুর অবসরের সিদ্ধান্ত সে সময় নানা অনাকাঙ্খিত জল্পনার জন্ম দিয়েছিল৷ বাংলার মিডিয়ার একাংশ স্বভাবসুলভ ভাবে ধুনো দিয়েছিল সেই সব জল্পনায়৷

যেমন একটি জল্পনা ছিল অনিল-বুদ্ধ-বিমান নাকি প্রায় সামরিক কায়দায় অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এই ভাবে আকস্মিক ঘোষণার মাধ্যমে জ্যোতি বসুকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করিয়েছেন৷ কারণ তাঁদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে দলের ভীষ্ম পিতামহ স্বেচ্ছায় বানপ্রস্থে যাওয়ার কথা মুখে বললেও কার্যত সে কাজ করবেন না৷ ব্যক্তিগত ভাবে আমি কোনও দিন এমন একটি আজব, অবাস্তব তত্ত্বে বা ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করিনি৷ কেন না কমিউনিস্ট পার্টি কী ভাবে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেয় আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বামপন্থী দলগুলি কভার করার সুবাদে সে সম্পর্কে আমার কিছুটা কাণ্ডজ্ঞান ছিল৷ তাছাড়া জ্যোতিবাবুর সঙ্গে অনিল বিশ্বাসের ব্যক্তিগত স্তরেও কেমন পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল সে ব্যাপারেও আমি ষোলো আনা ওয়াকিবহাল ছিলাম৷

এমনটি সত্যিই ঘটলে কিছুতেই তা চাপা থাকত না এবং দলের ভিতরে-বাইরে তার প্রভাব হত সুদূর-প্রসারি৷ ১৯৯৬ সালে দল তাঁকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়ার কিছুকাল পরে জ্যোতিবাবুই প্রকাশ্যে সিপিএমের এই সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করেননি৷ পরেও কখনও সরে আসেননি তাঁর এই মন্তব্য থেকে৷ অতএব সারাটা জীবন দলের অনুগত সৈনিক হিসেবে কাটিয়ে দেওয়ার পরে দল যদি তাঁকে সত্যিই এই ভাবে অর্ধচন্দ্র দিত জ্যোতিবাবু তাঁর মতো করে প্রতিবাদ জানাতেনই জানাতেন৷ কিন্তু যা ঘটেইনি, কোনো দিন ঘটা সম্ভবই ছিল না, তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর মানুষ ছিলেন না রাজ্য সিপিএমের শাহেনশা৷ একবার সাহস করে অস্ফুট ভাবে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ব্যাপারটা সত্যি কি না৷ জবাব দেওয়ার বদলে জ্যোতিবাবু শুধু ঠান্ডা দু’টো চোখে এমন ভাবে ফিরে তাকিয়েছিলেন যে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল৷ সেই দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে জ্যোতিবাবু বোধহয় আমাকে একটি কথাই বলতে চেয়েছিলেন, ‘তুমিও যে বাপু এত বড় মূর্খ, আমি তা বুঝতে পারিনি৷

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর সম্পর্কে নানা চড়াই-উতরাই ছিল অবশ্যই৷ তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে হঠাৎ রেগেমেগে ইস্তফা দিয়ে বুদ্ধদেব মুখ্যমন্ত্রীকে যে রকম বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন জ্যোতিবাবুর দীর্ঘ-জীবনে কোনো কমরেড তা করেছেন কি না সন্দেহ৷ অবশ্য সেই জ্যোতিবাবুই অনুজকে পরে ক্ষমা করে দিতে কোনও কুণ্ঠা বোধ করেননি৷ মহাকরণে নিজের ঘরে হাসতে হাসতে উত্তরসূরিকে নিজের হাতে নিজের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলেন৷ অবশ্য বুদ্ধদেববাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কে যে খুব একটা উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল তা নয়৷ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে দল ও সরকার যখন জেরবার হয়ে উঠেছে, সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনে বিস্মৃতির আঁধারে দিন গুজরান করা জ্যোতিবাবুকে শোনা গিয়েছিল মনস্তাপ করতে৷ ‘কই বুদ্ধ তো কখনও আমার কাছে পরামর্শের জন্য আসে না৷’

জ্যোতি-অনিলের সম্পর্কে তেমন বড় টানাপোড়েন ঘটেনি কখনও৷ প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ভোটাভুটিতে অনিলদা অবশ্যই জ্যোতিবাবুর পক্ষ নেননি, কিন্তু সেটা তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কে আঁচড়টুকুও কাটতে পারেনি৷ কমিউনিস্ট পার্টি করলে দলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত যে মানতেই হবে জ্যোতিবাবু তা বিলক্ষণ জানতেন, বস্তুত এই অনুশাসনবোধ তাঁর ধাতেই ছিল৷ মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে অনেক সন্ধ্যায় জ্যোতিবাবু বাড়ি ফেরার পথে অনিলদার ফ্ল্যাটে গিয়ে সময় কাটাতেন, গল্প-গুজব করতেন, কখনও-সখনও খাওয়া-দাওয়াও৷ শুধু অনিলদার নন তিনি ছিলেন গোটা বিশ্বাস পরিবারেরই একান্ত সম্মাননীয় অভিভাবক৷ জ্যোতি-প্রমোদ উভয়েরই স্নেহাস্পদ ছিলেন অনিল বিশ্বাস৷ 

তাঁদের অবর্তমানে দল এবং সরকারের হাল কারা ধরতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের সেই সব সম্ভাবনাময় যুবাদেরও প্রমোদবাবুই চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন৷ তাঁদেরই দু’জন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং অনিল বিশ্বাস৷ প্রথম জনের জন্ম শহর কলকাতায় সুরক্ষিত মধ্যবিত্ত আবহে, দ্বিতীয় জনের নদীয়ার সীমান্তবর্তী ক্ষুদ্র জনপদ করিমপুরে, অবর্ণনীয় দারিদ্র আর কৃচ্ছসাধনের মধ্যে৷ বুদ্ধদেব ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, তাঁর বিষয় ছিল বাংলা৷ অনিল গিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়তে৷ সেখানে আমার বাবা সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের বড় স্নেহাস্পদ ছাত্র ছিলেন তিনি৷ অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার সূত্রটি সেখানেই৷ অনিলদা বিলক্ষণ জানতেন আমি আপাদমস্তক বুর্জোয়া, বাজারি সাংবাদিক, ক্ষমতাহীন মালিকের চামচা, তাঁদের ঘোরতর শত্রু৷ তবু তো স্যারের ছেলে!

কেন জানি না, আমার পিতৃ-পরিচয়টি অনিলদা বড় মুখ করে জনে জনে বলে বেড়াতেন৷ বিদেশে থাকাকালীন একদিন কথায় কথায় খোদ জ্যোতিবাবুও সেই প্রসঙ্গটি তোলায় আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম৷ ‘আমি জানি অনিল আমাকে বলেছে ও তোমার বাবার ছাত্র৷ হি রেসপেক্টস ইওর ফাদার এ লট৷’

পাসকোর্সে ইতিহাসের ক্লাসে পড়ানোর মাঝখানে উঠে দাঁড়িয়ে বিনত প্রতিবাদ জানিয়ে প্রথম বাবার নজর কেড়েছিলেন ছাত্র অনিল৷ ‘আমি পড়াতাম ইংরেজিতে৷ হঠাৎ দেখি পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া একটি খর্বাকৃতি রোগা প্যাংলা ছেলে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ কী ব্যাপার জানতে চাইলে মিহি গলায় সে বলল, স্যার ইংরেজির বদলে আপনি বাংলায় পড়ালে খুব ভালো হয়৷ এই ক্লাসে আমার মতো অনেক ছেলে আছে যারা ইংরেজিতে ততটা স্বচ্ছন্দ নয়৷ আমি তো হতভম্ব৷’

ছাত্রটিকে বাবা ভর্ৎসনা করেননি, বরং ওইটুকু ছেলের তেজ আর সাহসকে সম্মান জানিয়ে সেই ক্লাস থেকেই বাবা পড়াতে শুরু করেছিলেন বাংলায়৷

ছাত্র হিসেবে অনিল বিশ্বাস আহামরি কিছু ছিলেন না৷ তবু আমার বাবার মতো সে সময়ের কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের কয়েকজন অধ্যাপক তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন ছেলেটি দারিদ্রের কাছে হার স্বীকার না করে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে বলে৷ বাবার মুখেই শুনেছি, কলেজে থাকাকালীন অনিলদার সম্বল বলতে ছিল একটা সস্তার পাঞ্জাবি আর পায়জামা৷ রোজ রাতে হস্টেলে ফিরে সেগুলো কেচে দিতেন, পরের দিন সকালে আবার পড়বেন বলে৷ বই কিনবেন সে সামর্থ ছিল না, সেই অভাব পূরণ করে দিতেন মাস্টারমশাইয়েরা৷ ছাত্র-আন্দোলন করার কারণে একবার দিন কয়েক হাজতে থাকতে হয়েছিল অনিলদাকে৷ মাস্টারমশাইরা তখনও নোট তৈরি করে, খাবার-দাবার নিয়ে জেলে গিয়েছেন প্রিয় ছাত্রটিকে সাহায্য করবেন বলে৷ ছাত্র-শিক্ষকের এমন নিকটাত্মীয়ের সম্পর্কই ছিল সে কালের বিদ্যায়তনের রীতি৷ সেই রাম, সেই অযোধ্যা, উভয়েই আজ অন্তর্হিত৷

পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে আর্শীবাদ চেয়ে অনিলদা প্রথম ফোনটি করেছিলেন বাবাকেই৷ বাবা সক্রিয় ভাবে কোনও রাজনৈতিক দল করতেন না, কিন্ত্ত মনে-প্রাণে অবশ্যই ছিলেন বামপন্থী৷ ছেলেবেলায় মফঃস্বলে থাকার সময় দেখতাম শহরে বামপন্থীদের কোনও সভা-সমাবেশ থাকলে হেঁসেলে আমার মায়ের সক্রিয়তা কিঞ্চিৎ বেড়ে যেত৷ কয়লার উনুনে ঘুঁটের চোখ-জ্বালানো কুণ্ডলির মধ্যে বসে বসে তিনি রুটি বানাতেন আর তরকারি করতেন৷ তারপর খবরের কাগজে মোড়া রুটি-তরকারির প্যাকেট চালান হয়ে যেত কোনও অপরিচিত, অভুক্ত কমরেডের পেটে৷ তখন এক আশ্চর্য, ছোঁয়াচে রোমান্টিকতা ছিল বামপন্থায়, বামপন্থী যাঁরা পরনের পাজামা-পাঞ্জাবি আর কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলা দেখে তাঁদের সহজে চিহ্নিত করা যেত৷ সংশয় হলে ভালো করে দেখে নিতে হত তিনি সিগারেট ফুঁকছেন না বিড়ি৷ দ্বিতীয়টি হলে সাক্ষাৎ কমিউনিস্ট, মানে শ্রদ্ধা আর সম্মানের পাত্র৷ সময়টা ষাটের দশকের শেষার্ধ, কংগ্রেসি নাইয়া ডুবুডুবু, প্রফুল্ল-অতুল্যের ছবিতে জুতোর মালা!

অনিল বিশ্বাস সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হওয়ায় বাবা সত্যিই খুশি হয়েছিলেন কি না কোনও দিন বুঝতে পারিনি৷ কেননা ততদিনে তাঁর সিপিএমের উপর ভক্তি অনেকটাই চটে গিয়েছে৷ বোধহয় অনিলদাকে মৃদু ভর্ৎসনাই করেছিলেন তিনি, সিপিএমের অধঃপতন নিয়ে হয়তো দু’-চার কথা শুনিয়ে দিয়েও থাকবেন৷ ওপার থেকে অনিলদা কী জবাব দিয়েছিলেন জানতে পারিনি, জানতে চাইওনি৷ মাঝে-মাঝেই বাবার সঙ্গে কথা হত তাঁর, কান খাড়া করে থাকলে হয়ত দু’-চারটে বড় খবরের টিপসও পাওয়া যেত৷ কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে সেটা হত অনধিকার চর্চা৷ বাবার কাছে অনিল বিশ্বাস ছাত্র৷ আমার কাছে তো সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকটাই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়৷

অনিলদার বক্তব্য ছিল, তিনি সংগঠনে কাজ করতে চান না ভোটে লড়তে চান, যৌবনের গোড়ায় প্রমোদবাবু তাঁর কাছ থেকে পরিষ্কার জানতে চেয়েছিলেন৷ তিনি দ্বিধাহীন ভাবে রায় দিয়েছিলেন সংগঠনের পক্ষে কেননা বিধানসভা বা মহাকরণে মন্ত্রীর ঘর তাঁকে নাকি কোনও দিন আকৃষ্ট করেনি৷ বুদ্ধদেববাবু অবশ্য হাসতে হাসতে অনিলদার এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ ‘শুনুন আমাদের কারও ঘাড়ে দু’টো মাথা ছিল না যে প্রমোদদাকে গিয়ে বলব আমি এটা করতে চাই বা এটা করতে চাই না৷’

দু’জনের মধ্যে কে ঠিক বলেছিলেন আজ এতদিন পরে সে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক৷ সত্যিটা হল ঠিক এক দশক আগে মারা যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত অনিল বিশ্বাসকে কেউ কোনও দিন মহাকরণের ছায়াও মাড়াতে দেখেনি৷ এই দাবিটি অবশ্য ওই দলে আর একজনও করতে পারেন৷ বিমান বসু৷ একমাত্র বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হতে পারে কি না, তা নিয়ে সঙ্গত বিতর্ক থাকতেই পারে৷ তবে কমিউনিস্ট দলে পরিষদীয় শাখা নয়, সাংগঠনিক শাখাই সব ক্ষমতার আধার৷ হতে পারে বুদ্ধিমান অনিল বিশ্বাস তাই পছন্দের প্রশ্নে বিশেষ একটা ভুল করেননি৷ দলের রশি নিজের হাতে নেওয়ার পরে তিনি রাজ্য সিপিএমকে চালিয়েছিলেন এক্কেবারে নিজস্ব স্টাইলে৷

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *