- December 20th, 2022
আ্যান্ড দ্য ঊইনার ইজ…….(১)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
‘অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ….। কয়েক ন্যানো সেকেন্ড থামলেন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার। গম্ভীর থমথমে মুখ, বলিরেখায় অপরাধবোধ স্পষ্ট, কন্ঠস্বর কম্পমান। তারপরেই উচ্চারিত হোল তিন অক্ষরের এমন একটি দেশের নাম যাতে দ্যুলোক-ভূলোক-গোলক থরথর করে কেঁপে উঠল শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে। কাতার? এ আবার কীসের নাম, খাদ্যবস্তু না ভোজ্যতেলের? অ্যাটলাসে তন্ন তন্ন কপে খোঁজার পরে আবিষ্কৃত হোল একটি ছোট্ট মরুদেশ, কাজের দিনে কাজের বেলায় চৌরঙ্গি চত্বরে যত লোক ঘুরে বেড়ায় এমন আজব দেশের মোট জনসংখ্যা তার চেয়েও কম, তাদের মধ্যে আবার সত্তর-আশি শতাংশ ডলারে কামানোর ধান্ধায় আসা বিদেশি-অনাবাসী। খোঁজ শুরু হোল এই আরবি লিলিপুট আদৌ ফুটবল খেলে কিনা, খেললেও বিশ্ব-রাঙ্কিংয়ে তার স্থান কত নম্বরে। রেকর্ড বুক ঘেঁটে জানা গেল, ফুটবলে সে এমনই মহাশক্তিধর যাকে সামনে পেলে চামচিকেতেও কষে লাথি মারে, নিজেদের মাঠে ভারতের কাছেও ঘোল খায়।

তাহলে? তাহলে আবার কী, বারো বছর পরে ‘চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায়’ কেউ জানতে আগ্রহী নয় , নতুন করে জানানোর মতো কোনও গপ্পোও আর অবশিষ্ট নেই। একমাত্র যে অঙ্কটির সঠিক হদিশ এখনও পর্যন্ত কেউ দিতে পারলনা, তা কাতারি উৎকোচের সঠিক পরিমান। বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের মতো হিসেব করে দেখিয়েছিল কম বেশি দু’শ মিলিয়ন ডলার। যে দেশের রাজ-পরিবার বিশ্বকে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো বিশ্বকাপের আয়োজনে হাসতে হাসতে কম করে সাড়ে তিনশ বিলিয়ন উড়িয়ে দিতে পারে, দু’শো মিলিয়ন তো তাদের কাছে চিনে বাদাম কেনার খরচ! আরে বাবা মুকেশ আম্বানিই তো নীতাকে ‘সহি সালামৎ’ রাখার জন্য সম্বৎসরে এর চেয়ে বেশি খরচ করেন, মেয়ের জন্য আরব সাগর পাড়ের সুরম্য ভিলা বা বিলেতে ছুটি কাটানোর প্রাসাদ কিনতে আরও আরও বেশি।এক যুগ পরে তাহলে বেশ বোঝা যাচ্ছে কাতার-রাজ গুজরাতিদের চেয়েও ‘চতুর বানিয়া’, কাজ হাসিল করে নিয়েছেন তেমন ভারী গুনাগার না দিয়েই।
দিয়েছেন যাঁরা তাঁদের গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি। নিয়েছে ফিফার যে সব লোভী ক্যালানে মদনের দল তারা সবাই চাকরি খুইয়েছে, বেইজ্জতির চরম সহ্য করতে হয়েছে, কেউ কেউ ইত্যবসরে শ্রীঘরেও বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে এসেছে। জগৎজুড়ে মিডিয়ায় এদের নিয়ে ছিছিক্কার হয়েছে, নেটফ্লিক্স এমন বহুজাতিক কেচ্ছায় লাভের গন্ধ পেয়ে সিনেমাও বানিয়ে ফেলেছে, গেল গেল রবে বিদীর্ণ হয়েছে ফুটবল বিশ্বের আকাশ-বাতাস। তারপর যা অনিবার্য সেটাই হয়েছে, কেচ্ছার ঝুলিতে আরও একটি মহাকেচ্ছা সংযোজিত হয়েছে মাত্র।

মরুদেশে ময়দানবের কাজ-কারবার যখন শেষ, প্রথম ম্যাচের বাঁশি বেজে উঠতে কয়েক ঘন্টা বাকি, বারো বছরের অজ্ঞাতবাস থেকে হুকোমুখো হ্যাংলার মতো মুখটা বাড়িয়ে সেই সেপ ব্লাটার শুনলাম মিকি মাউসের মিনমিনে গলায় বলছেন,’ কাতারকে সেদিন বিশ্বকাপের ইজারা দেওয়াটা ঠিক হয়নি, এত ছোট্ট একটা দেশ।’ শুনে মনে হল একদা ফিফার অবিসম্বাদিত অঘোষিত সম্রাট কি মানসিক ভারসাম্য খোয়ালেন? নাহলে কি চোর পালানোর এক যুগ পরে কারও মাথায় বুদ্ধি গজায়? নাকি গির্জার পাদরির সামনে কনফেশন বক্সে দুরাচারীর সত্য কবুলের মতো অপচেষ্টা? নাকি বনবাস আর কিছুতেই সহ্য হচ্ছেনা এই সুইস বৃদ্ধের?
কলঙ্কিত নায়কের কথার ব্যবচ্ছেদ করে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। বরং কাতারের কাছে গোটা ফুটবল বিশ্বের ঋণী থাকা উচিত একটাই কারণে। ফিফা যে কোনও কালেই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের আশ্রয়স্থল রামকৃষ্ণ মিশন ছিলনা, আগাগোড়াই আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল, এক ঝটকায় এক ফালি একটি মরুদেশ গোটা দুনিয়ার সামনে সেই সত্যটি বে-আব্রু করে দিয়েছে। দেশটির নাম ফুটবল জগতের ব্রাত্যজনের না হলে কিংবা টেবিলের তলার দক্ষিণার পরিমানটা এত বড় অঙ্কের না হলে দুনিয়া জানতেই পারতনা ব্লাটার-প্লাতিনি অ্যান্ড কোম্পানির আসল চরিত্র।

কোন এক ইংরেজ সাংবাদিক লিখেছেন দেখলাম, Qatar marks the end of pretence and it was always a pretence, that there is any kind of innocence about Fifa’s World Cup, that this is anything other than a marauding city state, out there circling the globe looking for the next complaint and complicit host to share in its gluttony.” নির্মম, নৃশংস সমালোচনা। তবু অমোঘ সত্য।
বারো বছর পরে আজ বিশ্বকাপের কোলাহলমুখর আসর খাঁ খাঁ করছে দেখে আমার মনে হচ্ছে যা করেছে বেশ করেছে কাতার। ফিফা যে শালগ্রাম শিলা নয়, প্রয়োজনমতো ফুল বেলপাতা পেলেই ভক্তের ভৃত্য হয়ে যায়, এই সত্যটির সর্বজনীন স্বীকৃতির গুরুত্ব ঐতিহাসিক। তেল আর গ্যাসের ওপর ভাসতে থাকা বেদুইনদের দেশগুলি কমবেশি সবাই ধনী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ইরাক, ইরান, কুয়েত, কে নয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রয়োজনে রাতারের দ্বিগুন উৎকোচ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু অর্থ যদি সাফল্যের মুদ্রার একটি পৃষ্ঠা হয়, অন্য পৃষ্ঠে তাহলে থাকতে হবে অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা, দুর্জয় সাহস আর আত্মপ্রত্যয়। এই অগ্নি-পরীক্ষায় ওইটুকু মরুদেশ যে সর্বাংশে সফল গোটা বিশ্বকে নতমস্তকে তা মেনে নিতে হচ্ছে অবশেষে। দুর্নীতি, অনাবাসী শ্রমিক নিপীড়ন, সমকামীদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের জন্য গত বারো বছর ধরে যারা লাগাতার কাতারকে গাল দিয়ে গেল, কাঁরাও আজ বিস্ময়ে হতবাক। এর মানে একটাই।
‘অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ কাতার।’ মাঠে আর্জেন্টিনা। বাইরে দোহা।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How


অপূর্ব সুন্দর বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন।🙏
মুদ্রার অপর পিঠে — অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা, আত্মপ্রত্যয় ইত্যাদি যে বিরল গুণাবলী , তাই দিয়েই হয়তো স্পর্ধিত উচ্চারণে বলা যায় –‘ আমরা করবো জয় ‘ যা কাতার করে দেখিয়েছে । কাতার — ছোট বটে ( আয়তনে) তবু ছোট নয়। কাতারের বিশ্বকাপ ফুটবলে মহীরূহসম হয়ে ওঠার নির্বেদ, সুন্দর গল্প শুনলাম সুমন চট্টোপাধ্যায়ের বাঙ্ময় কলমে ।🙏