logo

কী চেয়েছি আর কী বা পেলাম

  • August 13th, 2022
Suman Nama

কী চেয়েছি আর কী বা পেলাম

সুমন চট্টোপাধ্যায়

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর জীবনীকারকে একবার বলেছিলেন, ‘যে কোনও মানুষের আসলে তিনটি জীবন থাকে। প্রথমটি পাবলিক, দ্বিতীয়টি প্রাইভেট, তৃতীয়টি সিক্রেট।’ এ কথা শুনে দক্ষিণভারতের এক প্রবাদ-প্রতিম রাজনীতিক তাঁর জীবনীকারের কাছে মার্কেজের তালিকায় আরও একটি জীবন জুড়ে দিয়েছিলেন। ‘যে জীবন আমি যাপন করতে চেয়েছিলাম।’

পড়তে পড়তে অবধারিত ভাবে আতস কাচের তলায় মেলে ধরলাম নিজের জীবনকে। যে বয়সে আমি পৌঁছে গিয়েছি, যার পশ্চাৎ আছে অগ্র নেই, সেটাই তো আত্মানুসন্ধানের যথার্থ সময়। সত্যিই কি আমি যে জীবনটা পার করে এলাম সেটাই আমার প্রার্থিত ছিল? নাকি ভুলে ভরাই রয়ে গেল এমন দুর্লভ মানব-জনম?

আমার পিতৃদেবের মনে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র কোনও সংশয় ছিল না। তিনি ইংরেজি সাহিত্য পড়তে ও পড়াতে চেয়েছিলেন, দুর্বিপাকে পড়ে তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। তাঁকে পড়তে ও পড়াতে হয়েছিল ইতিহাস। পড়ানোর কর্তব্যে তাঁর ছিটে ফোঁটাও অবহেলা ছিল না। কিন্তু যে প্রেয়সীর সঙ্গে তিনি ঘর করতে চেয়েছিলেন তাঁকে না পাওয়ার মনস্তাপ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাবাকে কষ্ট দিয়েছিল। প্রসঙ্গ উঠলেই তাঁর ট্রেড-মার্ক মন্তব্য ছিল, ‘অল মাই লাইফ আই হ্যাড টু ক্যারি আদার মেন’স বার্ডেন।’ সারাটা জীবন ধরে অন্যের বোঝা আমায় বয়ে বেড়াতে হল!

আমার তেমন অনুযোগ করার কোনও উপায় নেই, যা চেয়েছি, যে ভাবে চেয়েছি, তাই পেয়েছি। বরং নির্দয় হয়ে কেউ যদি বলেন প্রাপ্যের বেশিই পেয়েছি তাহলে আমি পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে যাব না। নিজের কথা বলতে বাধো বাধো ঠেকে, কান দু’টি এখনও যথাস্থানে আছে বলে। একজন খবরওয়ালা তার কর্মজীবনে যা যা প্রত্যাশা করে থাকে, পরমেশ্বর তার একটি থেকেও আমাকে বঞ্চিত করেননি। যখন রিপোর্টারি করেছি, চুটিয়ে করেছি, দেশে করেছি, বিদেশে করেছি, গৃহযুদ্ধ কিংবা সাম্রাজ্য পতন উভয়েরই সাক্ষী থাকতে পেরেছি। আবার যখন দায়িত্ব বদলে গিয়েছে, রীতিমতো রংবাজি করে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। প্রথমে আনন্দবাজারে, তারপর নিজের কাগজ একদিনে, সবশেষে এই সময়-এ। বাংলার দু’-দুটো খবরের চ্যানেল ভূমিষ্ঠ হয়েছে আমার নেতৃত্বেই। এবিপি আনন্দ ও কলকাতা টিভি। কয়েক মাসের জন্য তারা টিভি-তেও খেপ খেলেছি। গুটি কতক বই লিখেছি, ইংরেজিতে একটি আত্মজীবনী আছে, আছে অসংখ্য প্রতিবেদন। এমন একটি বায়োডেটা নিয়ে যমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি যদি বলি অতৃপ্ত আত্মা হয়ে এসেছি, আমাকে নরকে চালান করে দেওয়া হবে সঙ্গে সঙ্গে। খেতে পেয়েছি, শুতে পেয়েছি, সঙ্গে কোল-বালিশও। আমার তো নাচতে নাচতে কেওড়াতলায় যাওয়া উচিত।

এ পর্যন্ত কিচ্ছুটি বলার নেই। মন খারাপ করে যখন ভাবি, ঘোষণা করে অবসরের সুযোগ আমি পেলাম না, সহকর্মীদের কাঁধে চেপে এতদিনের পরিচিত মাঠকে আলবিদা করতেও পারলাম না। আমি, আমার অন্তরাত্মা আর ওপরওয়ালা জানে এটা আমার প্রাপ্য ছিল না। নিজের বিবেকের কাছে আমার তাই জবাবদিহি করার কোনও দায় নেই, বহির্বিশ্বের কাছে তো নয়ই। সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির একক লড়াই ডেভিড-গলিয়াথের লড়াইয়ের চেয়েও অসম, এক তরফা। কর্মজীবনের পড়ন্ত বেলায় গুম ঘরে চালান হয়ে এই সত্যটি আমি উপলব্ধি করেছি। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মেনে নিয়েছি জীবনের পথ কখনও পুরোটা কুসুমাস্তীর্ণ হয় না, পায়ে কাঁটা ফুটবেই। হয়তো বেশি সাফল্য পেয়েছি বলে কষ্টটাও হয়েছে সমানুপাতিক। আমরা সভ্য দেশের নাগরিক হলে বুক চিতিয়ে এখনই বলে দিতাম আইনের অগ্নি-পরীক্ষায় আমি বিশুদ্ধ প্রতিপন্ন হবই। কিন্তু এদেশে নিয়ম ও সময় মাফিক বিচার বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই। তাই হয়তো আমি নই, আমার সন্তানই একদিন কলার তুলে আদালত-কক্ষ থেকে বের হবে বাবার শাপমোচন পর্ব সাঙ্গ হলে।

নিজের কর্মজীবনের আনন্দ বা সাফল্য অনেক সময় একেবারে অর্থহীন মনে হয়, আজকের মিডিয়ার উলঙ্গ চেহারাটি প্রত্যক্ষ করে। জরুরি অবস্থার কিছুকাল পরে আমরা যখন এই পেশায় আসি, সেটা ছিল ভারতীয় সাংবাদিকতার সুনামের তুঙ্গ মুহূর্ত। মিডিয়া তখন সাবালকত্বের পথে, সাহসী, প্রত্যয়ী, কিঞ্চিৎ বেপরোয়া, ক্ষমতাধরের মুখের সামনে আয়না তুলে ধরায় সদা উৎসাহী। রাজনীতিকরা তখন খবরওয়ালাদের সম্ভ্রমের চোখে দেখেন, ক্ষেত্র বিশেষে ভয়ও পান। মিডিয়া সরকার বিরোধী খবর করে, সংসদ-বিধানসভায় সেটাই হয়ে ওঠে বিরোধীদের আক্রমনের অস্ত্র। সম্পর্কের সেই ইকুয়েশনটা হঠাৎই যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। আজ মিডিয়া রাজনীতিককে ভয় করে এইটুকু বললে হিমশৈলের চূড়োটুকুও ভালো করে দেখানো হবে না। রাজনীতিকরাই আজ মিডিয়ার আসল মালিক, অনেক ক্ষেত্রে তাদের অন্নদাতা আর খবরওয়ালারা বড় জোর তাদের খানসামা। কেউ ইউনিফর্ম পরা, কেউ নয়। পিছনে ফিরে যখন ভাবি এমন মর্মান্তিক পরিণতির কথা আগাম আন্দাজ করতে পারলে কি সাংবাদিক হতাম, জানা উত্তর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। অতীতটাকে তখন মায়াজাল বলে বিভ্রম হয়, নিজের সাফল্য-ব্যর্থতার ধোপার লিস্ট তখন কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। মধুরেণ সমাপয়েৎ তো হলই না, হাতে পেন্সিলটুকুও আর রইল কই?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *