logo

আজ ফেলুদা যদি থাকতেন…

  • August 13th, 2022
Suman Nama

আজ ফেলুদা যদি থাকতেন…

আজ ফেলুদা যদি থাকতেন...

সুমন চট্টোপাধ্যায়

ছেলেবেলায় শাসন করার সময় আমার মাকে প্রায়শই বলতে শুনতাম, ‘যা-ই করিস না কেন, একটা কথা সর্বদা মনে রাখবি যে তুই ভদ্দরলোকের ছেলে’৷

মা যে অর্থে ভদ্রলোক শব্দটি উচ্চারণ করতেন, তার সঙ্গে আভিধানিক অর্থের বিশেষ একটা মিল নেই৷ অক্সফোর্ড অভিধান মোতাবেক, ভদ্রলোক বলতে সাধারণত সেই বাঙালিকে বোঝায় যিনি ধনী, সফল, সুশিক্ষিত, একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণিভুক্ত এবং সমাজে যাঁর অবস্থান বিশেষ সম্মানের৷ মায়ের কাছে বোধহয় এই সম্মানের বিষয়টিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাকিগুলি ততটা নয়৷ আবার সেই সম্মানবোধের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে থাকত একটি বিশেষ আচরণ-বিধি ও জীবনবোধ, সেটাই ছিল ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা৷ ভদ্দরলোকের ছেলে মানেই বড়লোক হতে হবে এমন কোনও কথা নেই কিন্তু পেটে বিদ্যে থাকা আবশ্যিক৷ আর আবশ্যিক সেই মূল্যবোধ যা তাকে ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে তারতম্য বিধান করতে শেখায়৷ যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে সে-ই ভদ্রলোক যে সাধারণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত কিন্তু চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে উচ্চমার্গীয়৷ সে কারণে কিঞ্চিৎ উন্নাসিক৷

সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা চরিত্র প্রদোষ মিত্তির ওরফে ফেলুদায় বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের প্রায় সব কয়টি চরিত্রগুণই প্রতিফলিত৷ ফেলুদা সৎ,শিক্ষিত,অনুসন্ধিৎসু,যুক্তিবাদী, সাহসী এবং রুচির প্রশ্নে অবশ্যই নাক উঁচু৷ সে জন্যই লালমোহন গাঙ্গুলি সেকেন্ড হ্যান্ড মার্ক টু অ্যাম্বাসাডর কিনেছেন শুনে ঘোর বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি৷ জটায়ুকে তিনি পরিষ্কার বলে দেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই গাড়ির জঘন্য, কর্কশ হর্নটির বদল হচ্ছে, তার জায়গায় একটা সভ্য হর্ন লাগানো হচ্ছে, ততদিন সেই চারচক্রযানটি ফেলুদাদের পাড়ায় অর্থাৎ রজনী সেন রোডে ঢুকতে পারবে না৷ ফেলুদা তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেন, এত শীঘ্র জটায়ু যে হিন্দি আর মাদ্রাজি ছবিতে প্রভাবিত হবেন, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি৷ অর্থাৎ প্রদোষ মিত্তিরের তালিকায় যা কিছু ভদ্র-পদ-বাচ্য বলে গণ্য হয় না, তার সর্বাগ্রে আছে হিন্দি আর মাদ্রাজি ছবি৷

ভদ্দরলোকের ছেলে যদি হও, এদের প্রভাব মুক্ত হয়ে থাকো৷

ফেলুদা ভদ্রলোক আইকন হলে ছোটলোক কেমন হয়, সত্যজিৎ সেটাও প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মগনলাল মেঘরাজ বা ভবানন্দর মতো খল-নায়কের চরিত্রগুলিতে৷ ছোটলোক মানে গোদা, অশিক্ষিত, অসভ্য। যাকে দেখলে ভয় যতটা, প্রায় ততটাই বিবমিষা হয়৷ সাধারণত সে মাতলামি করে, মুখ খিস্তি করে, ভদ্রতার ধারই ধারে না৷ এই রকম একটা লোকের হাতে যখন উদ্বৃত্ত কিছু টাকা আসে, সে প্রথমেই ক্যাটকেটে সবুজ রঙের, ভয়ঙ্কর হর্ন-ওয়ালা একটা গাড়ি কিনে বসে৷ এর বেশি কিছু সে যে ভাবতে পারে না, সেটা হিন্দি সিনেমা দেখার ফল৷ লালমোহনবাবুকে ফেলুদা অবশ্যই ছোটলোকের দলে ফেলেননি বা ফেলতে চাননি। যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে তাঁর শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করেছেন মাত্র৷ আপাদমস্তক ছোটলোক যদি কেউ হয়ে থাকে, তা হলে সে মগনলাল মেঘরাজ কিংবা ভবানন্দ৷

সেই লুম্পেনের চেহারাটা কেমন? ফেলুদার বর্ণনা অনুসারে কোটরগত দুটো চোখ ঘন জঙ্গলের মতো ভ্রূযুগলের তলায় লুকিয়ে থাকা, থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট, ছুঁচলো চিবুক৷ সে-ও কুর্তা-পায়জামা পরে কিন্তু তার কুর্তার বোতামগুলি হিরের৷ তার চেয়েও যেটা বেশি করে নজর কাড়ে, তা হল তার দু’হাতের দশটি আঙুলের মধ্যে আটটিতেই হরেক রকমের পাথর৷ গোয়েন্দাকে বাগে আনতে প্রথমে সে টাকার বান্ডিল ছুড়ে দেয়, তারপরে চমকায়৷

চারপাশে তাকান, ফেলু মিত্তিরদের বিশেষ একটা খুঁজে পাবেন না আজকের বাংলায়৷ আক্ষরিক অর্থেই তারা এখন প্রায় অবলুপ্ত হতে বসা প্রজাতি৷ হিন্দি কিংবা মাদ্রাজি ছবি তো তার হেঁসেলে জায়গা করে নিয়েছে সেই কবেই, এক্কেবারে মুম্বাইয়া স্টাইলে তৈরি হওয়া বাংলা সিরিয়ালগুলো ফি-সন্ধ্যায় না দেখলে পরে রাতে তার বাতকর্ম বেড়ে যায়৷ যে গায়ক যত বেসুরো গায় কিংবা জোরে জোরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাতে গিটার নিয়ে হুক্কাহুয়া করতে পারে তার কাছে সে তত বেশি জনপ্রিয়৷ সিনেমায় বোলবোলা শ্রী-হীন নানাবিধ শ্রী অন্ত্যাক্ষরধারীদের৷ আর কাব্য-সাহিত্য-নাট্য চর্চায়? যে যত বড় চামচা সে তত বড় কবি, তত বড় গল্পকার, তত বড় নট! বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এখন হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতিরেকে নেই-মেধার লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড৷ এমন কর্দমাক্ত ডোবায় শালুক ছাড়া আর কিছুই ফোটে না৷ বাঙালির তাই আজ ফেলু মিত্তিরের মতো উন্নাসিক হওয়ার অবকাশটুকুই নেই৷

ফেলু মিত্তিরদের দিন শেষ, এখন বাজার কেবল মেঘরাজ নয় ভবানন্দদের৷ যে দিকে তাকাবেন, অনিবার্য ভাবে তাদের দেখতে পাবেন৷ সময়ের নিয়মে তাদের চেহারা, সাজসজ্জা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। কেবল হাতের দশ আঙুলের দামি পাথরগুলো সমান জ্বলজ্বলে৷ নতুন সংযোজন দু’কানের জন্য অন্তত চারটি স্মার্টফোন৷ হিন্দমোটরের কারখানায় যেখানে বড়লোকের আবাসন তৈরি হচ্ছে, সেখানে ক্যাটকেটে সবুজ-রঙা কেন, অ্যাম্বাসাডর কেনারই কোনও উপায় নেই৷ তার জায়গা নিয়েছে বাহারি সব এসইউভি৷ সবুজের বদলে এখন সাদার রবরবা৷ ফেলুদার বাংলায় মেঘরাজদের বলা হত ভিলেন, আজকের বাংলায় তারাই নায়ক৷ তারাই সব, তারাই আরাধ্য, গোটা প্রাণিজগৎ তাদেরই দাসানুদাস৷ সাহস হারানো, মেরুদণ্ড হারানো, মূল্যবোধ খোয়া যাওয়া বঙ্গজীবনের আজ তারাই অভিভাবক৷

সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় দিয়ে কোথাও মাথা গোঁজার একটা স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করতে যান, কোনও না কোনও মেঘরাজ দেখবেন ঠিক আপনার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে৷ হয় ইট-পাথর-চুন-সুড়কি তার কাছ থেকে বাজারের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হবে নতুবা এক লপ্তে অনেকগুলি গান্ধিজির ছবি আঁকা কাগজ তার হাতে গুঁজে দিয়ে শান্তি ক্রয় করতে হবে৷ দু’টোর একটিও যদি না করতে চান, তা হলে ইহকালে নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরির কল্পনাকে সঙ্গে করেই উঠতে হবে চুল্লিতে৷ প্রতিকারের উপায় খুঁজতে যদি প্রতিবেশীর দ্বারস্থ হন দেখবেন তিনি প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো আপনাকে আপস করার পরামর্শ দিচ্ছেন৷ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনি নিজেও একই কাজ করেছেন ৷ আরও সাহসী হয়ে যদি থানায় পা রাখেন, শুনবেন বিরক্ত মেজবাবু কিংবা সেজবাবু আপনাকে তাঁর মূল্যবান সময় নষ্ট না-করার ঝাঁঝালো পরামর্শ দেবেন৷ যদি বলেন আইনের আশ্রয় চান, এফআইআর করতে চান মেঘরাজদের বিরুদ্ধে, মেজবাবু আপনার দিকে এমন ঘোর বিস্ময়ে তাকাবেন যেন আপনি রক্ত-মাংসের মানুষ নন, মঙ্গলগ্রহ থেকে তাঁর থানায় অবতীর্ণ হওয়া কোনও ‘অ্যালিয়েন’৷
লেখাপড়া শিখে, মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতায় সফল হলে তবে চাকরি পাওয়া যায়, এমন ধ্যান-ধারনাও আজকের বাংলায় নোটবন্দির আগের নোটের মতো তামাদি হয়ে গিয়েছে৷ এখানেও সাফল্যের চাবিকাঠি স্রেফ ওই মেঘরাজদের হাতে৷ তাও সরল বিশ্বাসে এলি-তেলি মেঘরাজের হাতে টাকা তুলে দিলে হবে না। কাজটা করিয়ে দেওয়ার যোগ্যতা ও সেটিং ঠিক কোন মেঘরাজের আছে, রীতিমতো গবেষণা করে আপনাকে তা আগে খুঁজে বের করে নিতে হবে৷ তারপরেও যে চাকরি হবে, সেই গ্যারান্টি নেই। চাকরি না হলে টাকা ফেরত পাবেন, সেই গ্যারান্টি তো নেই-ই৷ এমন হতে পারে, আরও বেশি মাল দিয়ে আরও বিচক্ষণ কোনও চাকরিপ্রার্থী চিলের মতো ছোঁ মেরে আপনার চাকরিটা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে নতুবা এত ছেলেপিলে মাল দিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত তাদের সবাইকে খুশি করা যায়নি৷ মাল গেল অথচ চাকরিও হল না, গোপন এই কথাটি বাধ্য হয়ে আপনাকে গোপনেই রেখে দিতে হবে, জনসমক্ষে আনতে পারবেন না৷ আর মেঘরাজের কাছে গিয়ে ধনে-প্রাণে শেষ হয়ে যাওয়ার আকুতি জানাবেন, সেই প্রশ্ন তো ওঠেই না৷

মেঘরাজদের হাত কত যে বড়, তাদের কী বিপুল প্রতিপত্তি, আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না৷ সর্বদা যে কাজ করানোর জন্য মেঘরাজদের টাকা দিতে হবে, তেমন কোনও কথাও নেই৷ বাজারে এমন বেশ কয়েকজন মেঘরাজ আছে যারা ‘ক্রস-সাবসিডাইজ’ করে চলার নীতি পালন করে অক্ষরে অক্ষরে৷ এরা নানা কাজে নানা অছিলায় নানা সূত্র থেকে যে মাল তোলে, তার একটা অংশ নিয়ম করে খরচ করে থাকে গরিবের দান-খয়রাতিতে৷ চিকিৎসার খরচ বহন করার টাকা নেই, পরিজনের দেহ সৎকারের টাকা নেই, প্রবল অর্থাভাবে মেয়েকে পাত্রস্থ করা যাচ্ছে না — দয়ালু মেঘরাজ আপনার পাশে দাঁড়াবেন৷ হয় এক ধমকে তিনি হাসপাতালের বেড পাইয়ে দেবেন কিংবা শববাহী শকটের ব্যবস্থা করে দেবেন নতুবা কিছু নগদ অবশ্যই গুঁজে দেবেন আপনার হাতে৷ খোঁজ খবর নিয়ে দেখবেন, কিপটে বলে মেঘরাজদের বাজারে কোনও দুর্নাম নেই৷ টাকা তোলার ব্যপারে সে যতটা রুক্ষ আর নির্মম, খরচের ব্যাপারে ততটাই দরাজ৷

মেঘরাজ-রাজ্যে বাস করতে করতে কখনও সখনও মনে হয়, আজ ফেলুদা কলকাতায় থাকলে কী করতেন? হয় তিনি গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে মোৎসার্ট-বিটোভেন শুনতেন, ইংরেজি ক্লাসিক পড়তেন নতুবা তোপসেকে ডেকে বলতেন, ‘চল, এ শহর থেকে পাততাড়ি গোটাই৷’

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *