- April 16th, 2024
বাংলাস্ফিয়ারের জন্মদিন
সুমন চট্টোপাধ্যায়
ঠিক দু’বছর আগে এই দিনে বাংলাস্ফিয়ার ইউ টিউব চ্যানেল শুরু হয়েছিল। গোড়ার দিকে সপ্তাহে একটি ভিডিও আপলোড করতাম, তারপর একেবারে অনিয়মিত হতে হতে বন্ধই হয়ে গেল। অবশেষে গত এক বছরের কিঞ্চিৎ অধিক কাল ফের ছন্দে ফেরা হয়েছে। কোনও কোনও দিন একাধিক ভিডিও পর্যন্ত আপলোড করেছি। আজ লিখতে বসার প্রাক মুহূর্তে খুঁজেপেতে দেখলাম ৮৫৪টি ভিডিও জমা হয়ে গিয়েছে চ্যানেলের নামের তলায়। নিজেই নিজেকে বাহবা দিলাম সকলের অগোচরে, সসঙ্কোচে।
এই ডিজিটাল পৃথিবীটির সঙ্গে তার আগে আমার কোনও পরিচয় ছিলনা, পরিচয়ের আকাঙ্খাও তেমন একটা ছিলনা। আমি আখবর কা নুমাইন্দে থেকেছি, সেটাই আমার বসতবাটি। তার আনাচে-কানাচে আমার মুখস্থ, চোখে ফেট্টি বেঁধেও আমি সেখানে স্বচ্ছন্দে এ ঘর সে ঘর করে বেড়াতে পারি। কাগজের মাঝে মাঝে অনতি অল্প সময় আমার টেলিভিশনে কেটেছে, সেটা সময় কাটানো খুচরো প্রেম, টা টা বলতে বুকে মোচড় লাগেনি।
২০০৫ সালে ৪৮ বছর বয়সে খবরের চ্যানেল করার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করার সময় আমার হিসেবে একটা মস্ত ভুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম মাধ্যম বদলাচ্ছি মাত্র, খবর তো খবরই থাকছে। মানে কাগজ হোক আর টেলিভিশন ‘কনটেন্ট রিমেইনস দ্য কিং’। মুম্বাইয়ে স্টার নিউজের হিন্দি চ্যানেলে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য দিন কতক কাটানোর সময় সেই ভ্রান্তি-বিলাস কেটে গেল, মনে হোল ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনও খানে।’ এত আওয়াজ, এত আলোর রোশনাই, এত হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি, এত চড়া রঙচং, যন্ত্রের কারসাজি, এর মধ্যে বাপু খবরটা কোথায়, করে কে? রইল ঝোলা চলল ভোলা করব বলে প্রায় মনস্থ করে ফেলেছিলাম।
দু’টি বোকাবোকা কারণে রণেভঙ্গ দেওয়া হলনা। স্টার নিউজের তখন সম্পাদক, আমার দেখা ভারতের সর্বোত্তম টেলিভিশন-ম্যান উদয়শঙ্করের বিহারি ভোকাল টনিক আর নিজের কাছে হেরে যাওয়ার আত্মগ্লানি। ফলে চ্যালেঞ্জটা নিয়েই নিলাম। সফল না ব্যর্থ বলতে পারবনা, সত্যটা হোল আমি সেভাবে সুযোগই পেলামনা। স্টার আনন্দ ছাড়তে হোল আত্মসম্মানটুকু বাঁচাতে আর নিজের হাতে গড়া কলকাতা টিভি থেকে অর্ধচন্দ্র জুটল আই এস ও সার্টিফায়েড ঠগবাজ মালিকের জন্য।হৃদয় হাল্কা করতে বসিনি পয়লা বোশেখের এই শুভ দিনে। আমি একটি আত্মকথা লিখতে শুরু করেছি, তাতে এ সব কথা বিস্তারিতেই থাকবে।
তার পরে প্রায় দু’টো দশক কাটতে চলল, আমি কেবল ডুবেছি আর কোনও মতে নাকের ডগাটুকু জলের ওপরে রেখে ভেসে থাকার চেষ্টা করেছি। আবার ডুবেছি আবার ভেসেছি। সমে এসে কোনও মতে নোংর করেছি নিজের খেয়াঘাটে। আমি পরম ভাগ্যবান কেননা আমার মতো করে বিশ্ব-দর্শনের সৌভাগ্য তো বেশি মানুষের হয়না। জীবনের অনেক সারসত্য, যা গজদন্ত মিনারে বসে থাকা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি, বিশ মাসের গুমঘর জীবন, তারপরের সাড়ে তিন বছরের উপর্যুপরি তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাকে তা পাখি পড়ানোর মতো করে বুঝিয়ে, শিখিয়ে দিয়েছে। আমি উপলব্ধি করেছি, বাড়ির বাইরের ঘরের চৌকাঠকে সীমানা ধরে নিয়ে আমাকে বাকি দিনগুলি কাটাতে হবে কেননা তার বাইরে গেলেই আমি ‘অড ম্যান আউট।’স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যে এমন অনির্বচনীয় আনন্দ আমি আগে তা বুঝতেই পারিনি।
গৃহকোণ আছি কিন্তু অন্তরাত্মাকে মরতে দিইনি। মানুষের দুর্দশায় এখনও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, মস্তিষ্কের অ্যান্টেনায় বহির্বিশ্বের সব সঙ্কেত পরিষ্কার ধরা পড়ে। এই দুইয়ের তাড়না আর হেরেও হার না মারার দুর্দমনীয় স্বভাবজাত পীড়ন সম্বল করে অচেনা, অজানা ডিজিটাল বিশ্বে আমার প্রবেশ। আমার ছবিতে আমিই নায়ক, খলনায়ক, পরিচালক, প্রযোজক, আলোকচিত্রী এবং চিত্রনাট্যকার। এভাবেই দেখতে দেখতে ক্যালেন্ডারের পাতায় দুটো বছর গড়িয়ে গেল। মাঝ দরিয়ায় একা হাতে ডিঙি নৌকো চালনায় এত মানুষের সাড়া পাব আমার কাছে সেটাই অপ্রত্যাশিত ছিল। এই অক্সিজেনটুকু থাকলে আমি এ রকম চালিয়েই খেলব উপরের আম্পায়ার আঙুল তোলা পর্যন্ত। সবাইকে ধন্যবাদ, প্রণাম, নমস্কার, কৃতজ্ঞতা।