- August 13th, 2022
 
হাফসোল-৪
যে ফুল না ফুটিতে
সুবীর বিশ্বাস
তরাইয়ের ছোট চা বাগানে কেটেছে স্কুল জীবন। তিন মাইল দূরে খড়িবাড়িতে স্কুল; সাইকেলে, কখনও বা হেঁটেই যেতাম। সে থাকত আর এক চা বাগানে, খড়িবাড়ি থেকে মাইলদুয়েক দূরে, অন্যদিকে।
ওদের চা বাগানের অবস্থা ভালো ছিল, ওদেরও। তখনকার দিনে মেলামেশার জন্য এ সব ব্যাপার একেবারে তাচ্ছিল্য করার মতো ছিল না। রোমান্সের সুগন্ধ আনতে মেলামেশা শব্দটা ব্যবহার করলাম, আদতে আমরা ছিলাম পরস্পরের সহপাঠী, কো-এড স্কুল, ক্লাস নাইন। সে আমলে জুনিয়র হাই বলে এক ধরনের স্কুল ছিল, ক্লাস এইট পর্যন্ত। ওদের চা বাগানের কাছে বাতাসিতে তেমনই একটা স্কুলে ও পড়ত। সেখান থেকেই আমাদের স্কুলে নাইনে ভর্তি হয়েছিল। মাস্টারমশাই না থাকলে মেয়েরা ক্লাসে থাকত না, কমনরুমে চলে যেত। সেখানে থাকতে হতো মেট্রনের কড়া নজরদারির মধ্যে। যেটুকু দেখা ক্লাসেই। মন খুলে কথা বলার সুযোগ সেই অ্যানুয়াল স্পোর্টস আর রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রস্তুতি পর্বে। বেশি কথাবার্তার সুযোগ ছিল না। ও হয়তো জিজ্ঞেস করল, কোন শাড়িতে আমাকে তোর ভালো লেগেছে? যেটা স্পোর্টসের দিন পরেছিলাম সেটা, না স্কুল প্রতিষ্ঠার দিন পরা শাড়িটা? খেয়াল করিসনি, না?
ক্লাস টেনে আমি ক্যাপটেন আর ও সহকারী। অল্প বাড়তি সময় পাওয়া যেত একসঙ্গে থাকার। দু’জনে বসে দুষ্টু সহপাঠীর লিস্ট বানাচ্ছি এমন সময় ও বলে উঠল, ‘তুই আল্পনার দিকে অমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস কেন রে? ভেবে পেলাম না, কখন তাকাই!’
পড়াশোনায় আমি ভালো ছিলাম। ওকে অঙ্ক আর ইংরেজি দেখিয়ে দিতাম। ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠলাম, দুজনেই। আমাদের অঞ্চলে বর্ষার খুব দাপট ছিল। গরম সেরকম পড়ত না। স্কুলে গরমের ছুটির বদলে বর্ষাকালে একমাস ছুটি থাকত। সেই বর্ষার ছুটিতে ও একদিন ভাইকে নিয়ে কিছু খাতাপত্তর সমেত কোনও খবর না দিয়েই আমাদের কোয়ার্টারে হাজির। ওদের থানঝোড়া চা বাগান থেকে ডুমুরিয়া নদী পেরিয়ে কোনাকুনি আমাদের খড়িবাড়ি চা বাগানে আসা যেত, অপেক্ষাকৃত কম সময়ে। ওই পথেই ও এসেছিল। সেইদিন আমাদের বাড়িতে খেয়ে আনমনে জানতে চেয়েছিল আমার পরবর্তী পড়াশোনার পরিকল্পনার কথা।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মোটামুটি মেধাবী ছেলের পরিকল্পনা সে সব দিনে ছিল বড়ই একমুখী। স্কুল-ফাইনাল পাশ করে প্রি-ইউনিভার্সিটি, তারপর ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বা ম্যাথস অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন। তারপর, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড করা, কমপিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি; নিদেনপক্ষে এমএসসি পড়া।
তার মানে, আরও চার থেকে পাঁচ বছর অন্তত! ওর অস্পষ্ট স্বর কানে এল। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু ছিল না, তাই চুপ করেই থাকলাম।
টেস্ট পরীক্ষার পর দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে গেল, যোগাযোগও বন্ধ। বেশ কিছুদিন পর, ফর্ম-ফিল আপের দিন দেখা। বলতে গেলে, সেটাই শেষ দেখা। ফাইনাল পরীক্ষার সেন্টার ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা। যাওয়ার আগে আমার হাত ধরেছিল ও। একটা চিঠিও দিয়েছিল আমায়। অনেক কথা ভরা সেই চিঠি বহুদিন আমার দিক্-নির্দেশক ধ্রুবতারা হিসেবে জ্বলজ্বল করেছে।
কালচিনির এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। শিলিগুড়িতে ফিজিক্স অনার্স পড়ার সময়ও ওর খোঁজ পেতাম। কলকাতায় চাকরি পেয়ে চলে আসার পর খোঁজখবর তেমন আর পাইনি । আমি জানতাম, সেইসময় সমবয়সি বিয়ের চল ছিল না, মেয়েদের অপেক্ষা করার মতো সামাজিক স্থৈর্য ছিল না, ছেলেদের ভবিষ্যৎ জীবন নিশ্চিত ছিল না। এই ভাবেই বহু প্রথম প্রেম প্রথম হাফ-সোলের দীর্ঘশ্বাস হয়ে বয়ে যেত।
আমি আজও হলফ করে বলতে পারি, সেই চিঠি বহুদিন ফায়ার-ওয়ালের কাজ করেছিল আমার জীবনে। তবু, আজকের নিরিখে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে হাফ-সোল তো বটেই।

	
							
Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

