- August 17th, 2022
বুদ্ধং শরণং (পর্ব-৩)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
জ্যোতি বসু আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মধ্যে তফাতটা কোথায় দিল্লির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে নিজের অফিস ঘরে বসে লালকৃষ্ণ আদবানি একদা আমায় তা বুঝিয়ে ছিলেন। আদবানি তখন দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী, সহকর্মী জয়ন্ত ঘোষালের সৌজন্যে আমি তাঁর ঘরে প্রবেশাধিকার পাই। আদবানির দুই পুত্র, দু’জনের নামই জয়ন্ত। একজন আত্মজ, অন্যজন সাংবাদিক।
জরুরি অবস্থার পরে বিরোধী ঐক্য নিয়ে দিল্লিতে আলোচনা চলছে। সেই সূত্রেই আদবানির সঙ্গে জ্যোতিবাবুর বৈঠক করার কথা। আদবানি বললেন, ‘সকালে জ্যোতিবাবুর কাছ থেকে মেসেজ এল, আমাদের বৈঠকের কথা যেন কাকপক্ষীতেও না জানতে পারে। কোনও পরিচিত জায়গায় নয়, বৈঠক করতে হবে কোনও গোপন আস্তানায়।’
কেন এমন শর্ত আরোপ? কিঞ্চিৎ বিস্মিত আমি প্রশ্ন করে বসি।
আদবানি— কেন আবার, জাত চলে যাওয়ার ভয়। জ্যোতিবাবুর মতো একজন কমিউনিস্ট নেতা আরএসএস নেতার সঙ্গে বৈঠক করছেন, এ খবর কি বাইরে এলে চলে? আমি মনে করি, দিস ওয়াজ এ কাইন্ড অব হিপোক্রিসি। জলে নামব কিন্তু চুল ভেজালে চলবে না।
আর বুদ্ধবাবু?
কোনও ভড়ং নেই, ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। গটগট করে সবার সামনে দিয়ে আমার অফিসে আসেন, বৈঠক করে চলে যান। সোজা সাপটা কথাবার্তা, কী চাই আর কী চাই না সে সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ধারণা একেবারে স্পষ্ট। এ জন্যই আমি বুদ্ধদেবকে এত পছন্দ করি। ওঁর কোনও দাবি আমি ফেলতে পারি না।
আদবানি যে এক ছটাক অতিশয়োক্তি করছেন না, আমার সেটা জানা ছিল। কেন না বুদ্ধবাবু প্রকাশ্য সাক্ষাৎকারে একাধিকবার আমার কাছে আদবানির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধবাবুর সহজ সরল ব্যাখ্যায়, ‘রাজনীতির সঙ্গে প্রশাসনিক কাজকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। রাজনীতিতে অবশ্যই আমরা বিজেপি-আরএসএসের বিরোধী, ছিলাম, আছি, থাকব। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বাধ্যবাধকতাগুলো অন্য। আমার সাহায্য চাই, কেন্দ্র থেকে সেই সাহায্য আমায় আদায় করে আনতে হবে। এই মনোভাব নিয়েই আদবানিজির সঙ্গে আমি দেখা করি এবং উনি যে সর্বদা আমাকে সাহায্য করেন সেই সত্যটিও প্রকাশ্যে স্বীকার করি। আমি তো অন্তত এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখি না।’
জ্যোতি বসু আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বের তুলনামূলক আলোচনা কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সাংবাদিকের আনট্রেইনড সাদা-চোখে দু’জনকেই কাছ থেকে দেখে যেটুকু বুঝেছি তার সারাৎসারটি হতে পারে এই রকম। জ্যোতিবাবু ছিলেন আপাদমস্তক বাস্তববাদী, পার্থিব সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি দলীয় স্বার্থকে স্থাপন করেছিলেন। একবার রাজ্যে ক্ষমতা দখল করার পরে যেন তেন প্রকারেণ তাকে রক্ষা করাটাকেই তাঁর প্রধানতম কর্তব্য বলে মনে করতেন এবং সেই কারণে চালু স্থিতাবস্থায় বড় ধরনের আদল-বদল ঘটানোর প্রয়োজন অনুভব করতেন না। এক্কেবারে ক্লাসিকাল পলিটিশিয়ান।
বুদ্ধদেব ছিলেন স্বপ্ন-সন্ধানী, দলের ঊর্ধ্বে তিনি রাজ্যের সামগ্রিক স্বার্থের কথা ভাবতেন, সে জন্য অচলায়তনে জোর ধাক্কা দিতে অথবা প্রয়োজনে প্রকাশ্যে দলের সমালোচনা করতেও তিনি পিছপা হতেন না। পরিণতি অথবা প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবেই যে কোনও ইস্যুতে তিনি যেটাকে সত্য বলে মনে করতেন সেটাই বলে দিতেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বুদ্ধদেব স্থিতাবস্থার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে বসে থাকতে চাননি, তাঁর লক্ষ্য ছিল অনেক বড়, ইতিহাস তৈরি করা। জ্যোতিবাবু বেছে নিয়েছিলেন টিঁকে থাকার সহজ সরল পথ, বুদ্ধদেব গভীরে প্রোথিত একটি চালু ব্যবস্থার কায়েমী স্বার্থগুলির বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সংখ্যার বিচারে জ্যোতিবাবু সফলতর। কেন না তাঁর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার বুক চিতিয়ে ২৪ বছর ক্ষমতায় টিঁকে ছিল তেমন উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হয়েই। তুলনায় বুদ্ধদেবের সরকার আট বছরের মাথাতেই টলটলায়মান অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়ে তারও দু’বছর পরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল।
এতৎসত্ত্বেও বলা মুশকিল ইতিহাস দু’জনের মধ্যে কাকে বেশি নম্বর দেবে, কিংবা স্বপ্ন রূপায়ণে ব্যর্থতার মানদণ্ডেই কেবল বুদ্ধদেববাবুর মূল্যায়ণ হবে কি না। আমার দু’কড়ির মূল্যায়ণে আমি কিন্তু জ্যোতিবাবুর আগেই রাখব তাঁর উত্তরসূরিকে। কেন? না আমার মনে হয় সঠিক সংকল্পে স্থির থেকে, কায়মনোবাক্যে তা রূপায়ণের চেষ্টা করতে গিয়ে হেরে যাওয়ার মধ্যেও যে গৌরব আছে, কেবলই দলীয় স্বার্থ রক্ষার সাফল্যে তা নেই। অনেকটা যেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মতোই অবস্থা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। কেলেঙ্কারির পর কেলেঙ্কারিতে জেরবার দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শেষ দিকে মনমোহন সিংই ছিলেন সব আক্রমণের লক্ষ্য। ২০১৪-র লোকসভা ভোটের কিছুদিন আগে দিল্লিতে ডাকা এক সাংবাদিক বৈঠকে কিছুটা আবেগ মথিত গলাতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আমার প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছে, মনে হয় ইতিহাস আমার প্রতি ততটা নির্দয় হবে না।’ বুদ্ধদেবও একই কথা বললে তা অত্যুক্তি হতো না।
মাঝেমাঝেই বুদ্ধদেব এমন সব মন্তব্য করতেন যা অবধারিত ভাবে পরের দিন কাগজে হেডলাইন হতো। যেমন ‘ডু ইট নাও’। রাজ্যের শ্লথ, জরাগ্রস্ত সরকারি কর্মসংস্কৃতি যে উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বুদ্ধদেব তা মানতেন এবং বিশ্বাস করতেন দ্রুত এর পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী কোনও কথা বারেবারে বললে সরকারি স্তরে তার একটা প্রভাব পড়েই। এ ক্ষেত্রে যে খুব একটা প্রভাব পড়েছিল তা নয়, তবু সুযোগ পেলেই মুখ্যমন্ত্রী এই লব্জ উচ্চারণ করতেন বারেবারে।
কথাটা স্বেচ্ছা-বানপ্রস্থে থাকা ভীষ্ম পিতামহের কানেও পৌঁছেছিল। সে সময় একদিন স্রেফ সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে বিধাননগরের ইন্দিরা ভবনে যেতেই জ্যোতিবাবু মন্তব্য করলেন, ‘বুদ্ধ এ সব ডু ইট নাও-টাও বলছে কেন? আরে বাবা এত বছর ধরে আমরা যাদের বলে এসেছি, কাজ করার কোনও দরকার নেই কেবল দলের কথাটা ভুলো না, তারা কী এ সব কথা শুনবে? বেশি বেশি করে বললে ওরা তো চটেও যেতে পারে। বুদ্ধ এটা বুঝছে না কেন?’
আপাতদৃষ্টিতে নিছক রসিকতা। আবার দুই মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব ও কর্মপদ্ধতির পার্থক্যটুকু বোঝার সেরা নজির। (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

