- August 17th, 2022
বুদ্ধং শরণং (পর্ব-১৩)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট ছিলেন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করেছেন, জীবনের একটা সময় দারুণ কৃচ্ছ্রসাধন করেছেন, সবই ঠিক। একই সঙ্গে আবার এটাও ঠিক, জীবনটাকে কী ভাবে উপভোগ করতে হয়, সেটাও তিনি জানতেন বিলক্ষণ। সুখাদ্য আর সু-পানীয়র প্রতি তিনি আকৃষ্ট ছিলেন, এ নিয়ে কোনও লুকোচাপায় বিশ্বাস করতেন না, তবে পরিমিতি বোধটুকু কখনও হারাননি।
কলকাতায় আমরা যে জ্যোতিবাবুকে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, বিদেশে গেলে তাঁর সেই রূপ একেবারে বদলে যেত। দিনের শেষে লুঙি আর শার্ট চাপিয়ে তিনি হাতে পানীয়র গ্লাস নিয়ে সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন, হাসি-ঠাট্টাও হতো, তারপর চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় সহকারে নৈশভোজটি সারতেন। তখন জ্যোতিবাবু অনেক কাছের মানুষ, ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে, প্রাণে যা আসে তাই তাঁকে জিজ্ঞেস করা যায়, এমনকী সুরাপানে তাঁর সঙ্গীও হওয়া যায়। জাতে বাঙালি, আচরণে পাক্কা সাহেব। একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, তিনি জীবনে কখনও ধূমপান করেননি, করার ইচ্ছাও করেনি কখনও।
আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন চেইন স্মোকার। কোনও সভা-সমাবেশে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে হলে তিনি ছটফট করতেন সিগারেটে একটা টান দেওয়ার জন্য। ধূমপানহীন জীবন ছিল বলে জ্যোতিবাবু নিজের ইনিংসটাকে চুরানব্বই পর্যন্ত টানতে পেরেছিলেন। আর অতি-ধূমপান করার কারণে বুদ্ধবাবুকে অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি হয়ে যেতে হল একেবারে অপরিণত বয়সে। দলীয় সঙ্কটে ঠিক যে সময় তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল তখনই তাঁকে দিন কাটাতে হচ্ছে অসহায় দর্শকের ভূমিকায়। আমি নিজেও দীর্ঘদিন যাবৎ সিওপিডি-র রোগী, ওই অতিরিক্ত ধূমপানের কারণেই। ফলে বুদ্ধবাবুর সমস্যাটা দূর থেকে হলেও আমি ভালোই বুঝতে পারি।
আড্ডার আসরে মধ্যমণি হয়ে বসার মানুষ ছিলেন না বুদ্ধদেব। দিনের কাজ ফুরোলে তিনি হোটেলে নিজের ঘরে গিয়ে খিল তুলে দিতেন পরের দিন সকাল পর্যন্ত আর তাঁর দর্শন পাওয়া যেত না। ঘরে বসেই তিনি নৈশাহার সারতেন, ব্রেকফাস্টও। ইতালির মিলানে তখন ফ্যাশন উৎসব চলছে, গোটা শহরটা আনন্দে মাতোয়ারা, সারা রাত ধরে নাচা-গানা-খানা-পিনা হৈ-হট্টগোল, আর যাইহোক হোটেলের ঘরে বন্দি হয়ে থাকার সময় নয়। বুদ্ধবাবুর ব্যক্তিগত সচিব অরুণ ভট্টাচার্যর উদ্যোগে আমরা সফরসঙ্গী কয়েক জন স্থির করলাম সে রাতে কোনও ওপেন এয়ার পানশালায় বসে আড্ডা দেব। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল বুঝিয়ে সুঝিয়ে ১০ মিনিটের জন্য হলেও মুখ্যমন্ত্রীকে সেখানে আনার। অনেক অনুনয়, বিনয় করলাম, বললাম আমাদের সঙ্গে কয়েকটা মিনিট বসলে আপনার জাত যাবে না, কেউ ছবি তুলবে না। ভবীকে ভোলানো গেল না কিছুতেই। বুদ্ধবাবু নিজের ঘরে বন্দি থাকার সময় একমাত্র অভীক দত্তের তাঁর ঘরে প্রবেশাধিকার ছিল, সেই লুকিয়ে চুরিয়ে, সকলের নজর এড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর খাওয়ার ব্যবস্থা করত। দেখে আমার হাসি পেত, রাগও ধরত। মুখ্যমন্ত্রী কী খেলেন, সেটাও যেন ক্ল্যাসিফায়েড সিক্রেট। যত সব বোকা বোকা ব্যাপার।
জ্যোতি বসুর সঙ্গে বিদেশে থাকা মানে রিপোর্টারের ওপর কোনও চাপ নেই। সারা দিনে মুখ্যমন্ত্রী হয়তো একটি অনুষ্ঠানে গেলেন আবার হয়তো কোথাও গেলেনই না। জ্যোতিবাবু বিশ্বাস করতেন, বি এ রোমান হোয়েন ইন রোম। আর বুদ্ধবাবু? রিমেইন এ ভেতো বাঙালি ইভন হোয়েন ইন রোম। তাঁর সফরসূচিতে সাইট সিয়িং-এর ব্যবস্থা রাখলে জ্যোতিবাবু কিছুই মনে করতেন না। ইজরায়েলে একটা পুরো দিন আমরা কাটিয়েছিলাম ইতিহাসের অলি-গলিতে ঘুরে বেরিয়ে। জেরুজালেম থেকে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ‘ডেড সি’, স্বাস্থ্যোদ্ধারের ঠিকানা। ওই সমুদ্রের জল, মাটি, লবণ সবই উপকারী, ব্যথা-বেদনা উপশমে দারুণ কার্যকর। সফরসঙ্গীদের অনেকেই মাড-কিওর ম্যাসাজ নেবে বলে এক একটা চৌখুপ্পিতে ঢুকে পড়লেন, কেউ আবার কেনাকাটায় মন দিলেন, সমুদ্রের দিকে মুখ করে জ্যোতিবাবু শরীরটাকে এলিয়ে দিলেন আরাম কেদারায়। সঙ্গে শ্রবণ টোডি আর আমি। একটু পরেই মুখ্যমন্ত্রী টোডিকে বললেন, ‘একটা জিন অ্যান্ড টনিক অর্ডার দাও তো দেখি।’ সঠিক সময়ের সঠিক বাছাই।
ডেড সি রিসর্টে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা প্রথমে গেলাম বেথলেহেম যা আবার প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ড। যীশু খ্রীষ্ট যে ঘরটিতে জন্মেছিলেন বলে মানুষের বিশ্বাস, সেখানে একবার উুঁকি-ঝুঁকি দিয়ে সোজা ওয়েলিং ওয়ালের সামনে। দেওয়াল জুড়ে অজস্র ফুটো তাতে মনস্কামনা লেখা চিরকুটের স্তূপ। আমাদের গাইড জ্যোতিবাবুর কাছে জানতে চাইলেন তাঁর কোনও মনস্কামনা আছে কি না। স্বভাবসুলভ ঢঙে তিনি প্রশ্নটি ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। পিছনে আলাস্কা মসজিদ, দিনান্তের আলোয় ঝলমল করছে তার সোনার গম্বুজ। মুসলিমদের বিশ্বাস এই মসজিদ থেকেই মহম্মদ বেহস্তে গিয়েছিলেন। সবার শেষে ভায়া ডেলা রোসা, ক্রশবিদ্ধ করার পরে যীশুকে যে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই পথ। অনেক চড়াই-উতরাই, সিঁড়ি ভাঙা। একেবারে শেষের দিকে বর্ষীয়ান মুখ্যমন্ত্রী একটু হাঁফিয়ে উঠেছিলেন, আমিই তাঁর হাত ধরে ধীর লয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি। আসার পথে একটাই মন্তব্য করলেন জ্যোতিবাবু, ‘এইটুকু জায়গার মধ্যে দুনিয়ার তিনটি গ্রেট রিলিজিয়নের জন্ম হয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে।
আর বুদ্ধবাবু? কলকাতায় থাকলে যিনি এত বড় ‘নান্দনিক’, ইতালির মতো পায়ে পায়ে শিল্প আর স্থাপত্যের দেশে (দুনিয়ার সমগ্র শিল্প-কর্মের ৭০ শতাংশ এই একটি দেশেই আছে) তাঁর মন শিল্পকলায় নয়, অন্য ধরনের শিল্পে নিবদ্ধ। রোমে গিয়ে ভ্যাটিকান না দেখলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে তিনি সেখানে যেতে রাজি হলেন। পিছনে পিছনে আমরা। এত দ্রুত পায়ে বুদ্ধবাবু চক্কর কাটলেন যে মনে হল বুঝি ওয়াকিং রেসে নাম লিখিয়েছেন। কোথাও দু’দণ্ড দাঁড়ানো নয়, লেফট-রাইট, লেফট-রাইট করার ফাঁকে শুধু একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা। ভাবলাম এই রকম ঊর্ধ্বশ্বাসে ভ্যাটিক্যান দেখার চেয়ে তো না দেখলেই ছিল ভালো। বুদ্ধবাবুর চোখে তখন মিচেলেঞ্জেলোর চেয়ে গুচ্চি কোম্পানির গুরুত্ব অনেক বেশি।
পুঁজির সন্ধানে জ্যোতি বসু যদি একটি সফর করে থাকেন তাহলে সেটা মার্কিন মুলুকে, ১৯৯৫ সালে। অর্থাৎ রাজ্যে নতুন শিল্পনীতি পেশ হওয়ার পরের বছর। তার আগে থেকেই অবশ্য সোমনাথবাবু বিদেশে চর্কি কাটা শুরু করেছেন, আমেরিকায় জ্যোতিবাবুর সফরসঙ্গী হওয়ার আগে তিনি গিয়েছিলেন জার্মানির ডুসেলডর্ফে। সে যাত্রায় আমিও ছিলাম তাঁর সঙ্গে, সেখান থেকে লন্ডনে এসে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে আমরা উঠি ওয়াশিংটনের বিমানে। রাজ্যের শিল্পায়ণ প্রচেষ্টায় সোমনাথবাবুর উদ্যম ও আন্তরিকতা কারও চেয়ে এক ছটাক কম ছিল না। যদিও যে সামনে এল তার সঙ্গেই একটা চুক্তি করে বসে তিনি ‘মৌ’ দাদার উপাধি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সম্পদ বলতে ছিল ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর, স্বচ্ছন্দ ইংরেজি আর ভনিতাহীন আবেদন। সব বক্তৃতার শেষে নিয়ম করে তিনি বলতেন, ‘উই হ্যাভ কাম হেয়ার টু সিক ইওর হেল্প অ্যান্ড ব্লেসিংস। অল আই অ্যাম সেইং ইজ, গিভ বেঙ্গল এ চান্স, সি ইফ উই ক্যান ডেলিভার।’
জ্যোতি বসুর এ সবের বালাই ছিল না, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বা ব্রিগেডের জনসভায় তিনি যা বলতেন আমেরিকায় উজিয়ে গিয়ে মেরিল লিঞ্চের দেওয়া ভোজসভাতেও শুনলাম একই কথা বলছেন। সেই কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক আচরণ, মাশুল সমীকরণ নীতি, সর্বক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। বাংলায় যারা পুঁজি ঢালবে তাদের কাছে এ সব কথা যে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, কেন পুঁজি ঢালবেন তার ব্যাখ্যা শোনার জন্যই যে শ্রোতারা উপস্থিত হয়েছেন, জ্যোতিবাবু এ সবের ধার ধারতেন না। কেউ যে তাঁর ভুলটা ধরিয়ে দেবে প্রতিনিধি দলে তেমন হিম্মতও ছিল না কারও। বরং আমার মনে হয়েছিল, জ্যোতিবাবুর বক্তৃতায় লাভ তো হতোই না, বরং শিল্পমহলে বিভ্রান্তি বাড়ত।
বুদ্ধবাবু নো ননসেন্স বক্তৃতা দিতেন। অনেকক্ষণ ধরে বলতেন না, লম্বা চওড়া দাবি করতেন না, কোন কোন কারণে তাঁর রাজ্য বিনিয়োগের উপযুক্ত তার নাতিদীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলার কমিউনিস্টদের সম্পর্কে বিদেশিদের যে সব সঙ্গত ভয়-ভীতি আছে তা এক এক করে দূর করার চেষ্টা করতেন। সিঙ্গাপুরে বুদ্ধবাবুর ভাষণ শুনে স্থানীয় এক শিল্পপতি মন্তব্য করেছিলেন, ‘হি সিমস টু বি অ্যান অনেস্ট পার্সন হু নোজ হোয়াট ইজ হি ডুয়িং।’ (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

