- August 13th, 2022
আর কত মা-ঠাকুমা করবেন!
বিশেষ প্রতিবেদন: সেই মহাকাব্যের যুগ বেয়ে আজকের এই সুপারসনিক এজ অবধি রান্নাবান্না এক অনবদ্য শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। যে শিল্প মঞ্জুষা অঙ্কনশৈলী কিম্বা পুতুলনাচের মতো ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যাবে না কোনও দিন। কারণ সে শিল্প শ্রেণী, বর্ণ, বিত্ত, লিঙ্গ নির্বিশেষে আমাদের সব্বার প্রতিদিনের জীবনচর্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেউ স্রষ্টা হিসেবে, কেউ বা ভোক্তা হিসেবে আঁকড়ে ধরে আছি এ শিল্পকে। এ শিল্প পেটের সিংহদুয়ার দিয়ে ঢুকে পাকাপাকি ভাবে দখল করে বসে মনকে।
এমন সর্বজনীন আবেদন যে শিল্পের, তার ডকুমেন্টেশনের গুরুত্বও স্বাভাবিক ভাবেই অপরিসীম। ভারতবর্ষের মতো বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের দেশে ভাষা, মত, পরিধানের মতো খাদ্যাভ্যাসও বিভিন্ন এবং বিচিত্র। আর সেই সব খাবার-দাবারের ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ও রন্ধনপ্রণালী নিয়ে লেখালেখির ধারাটিও অতীব সমৃদ্ধ। সেই প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, পূর্ণিমা ঠাকুর, রেণুকা দেবীচৌধুরানি থেকে মীনাক্ষী-রাখীপূর্ণিমা দাশগুপ্ত, মধুর জাফরি, জিগস কালরা, তরলা দালাল হয়ে আজকের প্রিয়া কৃষ্ণ কিম্বা সোনাল বেদ.... তবু বাকি থেকে যায় আরও অনেক নাম। এছাড়াও রমরমিয়ে চলছে অজস্র জনপ্রিয় ফুড ব্লগ, যার মধ্যে উমা রঘুরামনের 'মাস্টারশেফ মম', নন্দিতা আইয়ারের 'স্যাফ্রন ট্রেইল', নিধি কাণ্ডারির 'পাপী পেট' উল্লেখযোগ্য।
রন্ধনশিল্প ও রন্ধনপ্রণালী নিয়ে ভারতীয় মননে এই যে বিপুল আবেগ ও অক্ষরব্যয়, তার অনেকখানি জুড়ে আছে কিন্তু পুরোনো দিনের রান্না, ঠাকুমা-দিদিমাদের আমলের সময় ও শ্রমসাধ্য জটিল রন্ধনপ্রণালী, বনেদী পরিবারের হেঁসেলের নানা পদ। সবচেয়ে মোক্ষম উদাহরণ, ঠাকুরবাড়ির রান্না। জনপ্রিয় পত্রপত্রিকার রান্নাবান্নার পাতাই বলুন কিম্বা বাঙালি খাবারের কেতাদুরস্ত রেস্তোরাঁ, কিছু রেসিপি 'ঠাকুরবাড়ির রান্না' নামে চালিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! নির্ভেজাল বাঙালিয়ানা আর শিকড়ের কাছাকাছি ফিরতে চাওয়ার যে রোমান্টিকতা, তা এ ভাবেই ব্যবহৃত হয়ে চলছে ব্যবসায়িক স্বার্থে।
পুরোনো মাত্রই খাঁটি, এই স্টিরিওটাইপটা, যে কোনও স্টিরিওটাইপের মতোই, বিরক্তিকর হয়ে ওঠে একটা পর্যায়ের পর। শুধু তাই না, সত্যের অপলাপও ঘটায়। আজকের ছেলেমেয়েরা কোনও কল্পিত প্রপিতামহীর রেসিপি থেকে নয়, রান্না শেখে ইউটিউব ভিডিয়ো দেখে।
এ কথার অর্থ কিন্তু এই নয় যে পূর্বনারীদের সব রন্ধনপ্রণালী দুচ্ছাই বলে ভুলে যেতে হবে আমাদের। সে সব তো শুধু নুন, হলুদ, পোস্ত আর পাঁচফোড়নের গপ্পো নয়, মানুষেরও গল্প, রান্নাঘরে বিশ্বদর্শনের গল্প। তার আর্কাইভাল মূল্য অপরিসীম। যেমন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর 'আমিষ ও নিরামিষ আহার', পূর্ণিমা ঠাকুরের 'ঠাকুরবাড়ির রান্না'। যেমন লন্ডনের দার্জিলিং এক্সপ্রেস রেস্তোরাঁর মালকিন ও শেফ আসমা খানের 'আসমা'স ইন্ডিয়ান কিচেন' যেখানে তিনি রন্ধনশিল্পে তাঁর অনুপম উত্তরাধিকারের কথা বলেছেন, যা তৈরি হয়েছে হায়দরাবাদ ও বাংলার মোগলাই রান্না, স্ট্রিট ফুড এবং কলকাতার বাবুশ্রেণি যে ক্লাব-সংস্কৃতির ধারক, সেখানকার বিশেষ বিশেষ রন্ধনপ্রণালীর মিশেলে।
পুরোনো দিনের রান্নাবান্নার মধ্যে যা বিরল, ব্যতিক্রমী, অসাধারণ, তাকে যত্নে সংরক্ষণ করা দরকার। যেমন ধরুন, কমলালেবুর খোসা দিয়ে যে ক্ষীর বানাতেন আমার ঠাকুমা, কিম্বা রাজস্থানের নাম না জানা ফল দিয়ে যে আচার তৈরি করে আত্মীয়-পড়শীমহলে প্রভূত সুখ্যাতি আদায় করেছিলেন আপনার দিদিশাশুড়ি… সেই সব। তার বদলে ঠাকুমা-দিদিমার রেসিপির নামে ঢ্যাঁড়শের ছেঁচকি, তেকোণা পরোটা কিম্বা কাটাপোনার ট্যালট্যালে ঝোলের রেসিপি পেলে কেমন লাগে বলুন দিকি!
মোদ্দা কথা হল এই যে, রান্নাঘরের চার-দেওয়ালের মধ্যে ভোর থেকে মাঝরাত্তির অবধি, দিনের পর দিন, উনুনে আঁচ তুলে, কুটনো কুটে, মশলা বেঁটে, রেঁধে বেড়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একান্নবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্যের পাতে নানা সুস্বাদু পদ তুলে দেওয়া যেসব নারীকে আমরা দেখেছি কিম্বা গল্প শুনেছি যাঁদের, তাঁরা ছাড়াও অনেকে ছিলেন, অলীক মনে হলেও তাঁরাও সত্যি! কেউ ঔপনিবেশিক প্রভাবে রোজমেরি, থাইম ব্যবহার করতেন রান্নায়, কেউ স্বামীর সঙ্গে সাহেবী ক্লাবে যেতেন নিয়মিত, ডাক্তার, প্রযুক্তিবিদ, আইনজীবী ইত্যাদি পেশায় পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছিলেন কেউ কেউ। সময়ের পায়ে পা মিলিয়ে আজকের ঠাম্মা-দিদুরাও লুচি-আলুভাজা কিম্বা মাংসের সিঙারা বানানোর বদলে ডমিনোজ থেকে পিৎজা আনিয়ে দিচ্ছেন কলেজ-ফেরত নাতিকে, বড়দিনের ছুটিতে আদরের দৌহিত্রী এলে ফ্লুরিজের ইংলিশ ব্রেকফাস্ট আনিয়ে নিচ্ছেন ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে। সময়-শ্রম, দুয়েরই সাশ্রয়, জেন ওয়াই ও খুশি!
গত অর্ধশতকে বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিকতার প্রভাবে আমার দেশ বদলে গিয়েছে আমূল, স্বাভাবিক ভাবেই পাল্টেছে খাদ্যাভ্যাস এবং খাদ্য-সংস্কৃতি। বার্গার আর ম্যাগি নুডলস তার নিজস্ব খাদ্য-সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিরায়ত রন্ধনপ্রণালীতেও নতুনত্ব এসেছে। বনেদী রান্নাবান্নার ধারাটি সম্পূর্ণ ভাবে কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে এমন নয়, তা কাম্যও নয় একেবারেই, তবু যে সব খাবার আমাদের রোজকার খাদ্যাভ্যাসের অংশ, বেঁচে থাকে সেগুলোই। দু-চারজন লেখালেখি করলেই কোনও রন্ধনপ্রণালীকে সজীব রাখা যায় না, সজীব থাকে যখন সে সব খাবার অনেক মানুষ নিয়মিত ভাবে রান্না করে, খায় এবং খাওয়ায়।
অল্পবয়সী ভারতীয় ছেলেমেয়েরা তো বটেই, তাদের মম গ্র্যান্ডমমরাও এখন নতুন নতুন রেসিপির সন্ধানে হানা দিচ্ছেন ইউটিউব, টিকটক, হোয়্যাটস্যাপ-এ এবং ফুড ব্লগগুলোতে। নারীজন্ম মানে রান্নাঘরেই তার মোক্ষ, এ ক্লিশে ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছে বহুদিন, অতএব কেউ হয়তো লেখাপড়া বা পেশার চাপে রান্নাঘরে মন দিতে পারেননি কিম্বা হয়তো সে কাজটায় আগ্রহই ছিল না তাঁর কোনও। ভালোলাগা তৈরি হতে পারে দেরিতেও, প্রয়োজনে কিম্বা শিকড়ের প্রতি প্রবল টানে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শুধু মা নন, অনেক বাবা ও সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব নিচ্ছেন, রান্না করে খাওয়াচ্ছেন, একা হাতে। সিঙ্গল মাদাররা সংসার সন্তান চাকরি সামলে কম খরচে, কম সময় ও পরিশ্রমে পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার বানাতে চাইছেন। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কর্মসূত্রে যাওয়া ছেলেমেয়েরা দেশীয় বিদেশী উপাদানের মিশেলে নতুন নতুন রেসিপি উদ্ভাবন করছে। এই সমস্ত মানু্ষের রান্না খাওয়া আর খাওয়ানোর আলাদা আলাদা গল্প জায়গা করে নিক আজকের রান্নার বইপত্রে, রন্ধন সাহিত্যে।
নতুন স্বর, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী, নতুন নতুন রন্ধনরীতি উঠে আসুক। মা, ঠাম্মা, ফুলপিসি, রাঙামামীমারা ঐতিহ্যের গুরুভার থেকে মুক্তি পেয়ে খানিক হাঁফ ছাড়ুক আমাদের রন্ধন সংস্কৃতি!


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

